বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (তৃতীয় পর্ব)
পর্ব ৩ : তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গোড়ার কথা
..........................................
উনিশ শতকের ইউরোপে পদার্থবিদ্যার মূল ধারায় যে ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছিল, তার মধ্যে প্রধান একটা দিক ছিল তড়িৎ আর চুম্বক নিয়ে কাজ। অন্যদিকে আলো, শব্দ বা পরমাণুবিদ্যা নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে আগ্রহ ছিলই। ওই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ক্যাথোড টিউব আবিষ্কার হওয়ার পর পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে জানবার কাজে গতি আসে। এবং সেই সঙ্গে এক্স রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় রশ্মি আবিষ্কৃত হওয়ার পর পরমাণুর ভেতরের গঠন আরও বেশি করে পরিষ্কার হতে থাকে বিজ্ঞানীদের কাছে। তবে সে সব অনেক পরের কথা।
ওই উনিশ শতকের একেবারে গোড়া থেকেই তড়িৎ আর চুম্বক নিয়ে যে ধরনের কাজকর্ম হতে শুরু করে, সে ব্যাপারে আমরা এবার আলোচনা শুরু করব। তবে তার আগে তরঙ্গ জিনিসটা কী, সেটা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। এটা ঠিক কথা যে বিশ শতকের পদার্থবিদ্যায় যে যুগান্তরের চেহারা আমরা দেখি কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা আর আপেক্ষিকতাবাদের হাত ধরে, তার মূল সূচনা কিন্তু হয়েছিল উনিশ শতকেই।
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আসলে কী? ছোটবেলায় আমাদের তড়িৎ (কারেন্ট) আর চুম্বক নিয়ে ইশকুলস্তরের পাঠ্য বিজ্ঞানবইয়ে কিছু-কিছু কথা পড়ানো হয়েছিল, অন্তত ইচ্ছে বা আগ্রহ না থাকলেও জানতে হয়েছিল প্রচুর হাবিজাবি তথ্য। তবে মোদ্দা কথা এই যে তড়িৎপ্রবাহ (বা ইলেকট্রিক কারেন্ট) যে তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের মতো ধাতুর তৈরি তারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়, আর এই প্রবাহের ফল হিসেবে আমরা বাল্ব থেকে আলো পাই বা ফ্যানের হাওয়া খেতে পারি বা টিভি-এসি চলে, এসব আমরা খুব ভালো বুঝি। এই যে ‘তড়িৎ’ কথাটা, এর প্রবাহের পেছনে আসলে ইলেকট্রন নামের এক অতি ক্ষুদ্র কণার গতিই দায়ী, আর এই ইলেকট্রনেরই একটা গুচ্ছ বা বাণ্ডিলকে ঋণাত্মক আধান বা নেগেটিভ চার্জের একক হিসেবে ধরা হয় (এককটির নাম ‘কুলম্ব’; ফরাসী বিজ্ঞানী চার্লস অগাস্টিন দ্য কুলম্ব-এর নাম অনুসারে); এর বিপরীতে আছে ধনাত্মক আধান বা পজিটিভ চার্জ, সেটারও একক ওই একই।
কোনও ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জ স্থির অবস্থায় থাকুক বা গতিশীল, সব সময়েই ওর চারপাশে এমন একটা এলাকা তৈরি হয়ে থাকে যেটাকে আমরা বলি তড়িৎক্ষেত্র (ইলেকট্রিক ফিল্ড), ওই এলাকায় অন্য একটা চার্জ এসে গেলে সে একটা টান অনুভব করে। ঠিক একইভাবে যে কোনও চুম্বক তার চারপাশে তৈরি করে চৌম্বকক্ষেত্র (বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড)। এই এলাকার মধ্যে অন্য একটি চুম্বককে আনা হলে সে একইভাবে বল অনুভব করে। এই তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্র ব্যাপারটা একটু বাদে খুব বড় ভূমিকা নেবে, এই শব্দদুটো মাথায় রাখা দরকার।
ওই বল বা টান আবার দু’রকম হতে পারে: আকর্ষণ বল এবং বিকর্ষণ বল। তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্র এই দুটোই ‘ভেক্টর’ রাশি, মানে এদের নির্দিষ্ট মান আর দিক আছে। এই দুই ক্ষেত্রের অন্য এক ভাবেও সংজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে— তবে সেটা এক্ষুনি আমাদের না জানলেও চলবে।
গাণিতিকভাবে সাধারণত তড়িৎক্ষেত্রকে ‘E’ অক্ষর আর চৌম্বকক্ষেত্রকে ‘B’ অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এখন কোনও এলাকায় যদি কখনও একইসঙ্গে এই তড়িৎ আর চৌম্বকক্ষেত্র নির্দিষ্ট একটা ছন্দে পাল্টাতে থাকে, সেখানে ওই দুটো ক্ষেত্রের ওঠানামার দুটো তলের সঙ্গে লম্বদিকে অন্য একটা তল-বরাবর তৈরি হয় এক ধরনের তরঙ্গ বা ঢেউ, এইটারই পোষাকী নাম ‘তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ’। বা ‘ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ’।
এমনিতে তরঙ্গ (বা ওয়েভ) জিনিসটা কল্পনা করা খুব সহজ। কোনও কিছু ঢেউয়ের মতো এগিয়ে যায় মানেই সেখানে এক ধরনের তরঙ্গ তৈরিই হল। জলে একটা ঢিল ফেললে যে ঢেউ তৈরি হয়, সেও এক ধরনের তরঙ্গেরই উদাহরণ। তবে তরঙ্গ যখন এগোয়, মাধ্যমের (মানে যার মধ্যে দিয়ে ওই তরঙ্গটা এগিয়ে যাচ্ছে, এখানে যেমন জল) কণার কিন্তু স্থানচ্যুতি হয় না; জলের ওপর ঢেউটা যখন পাশের দিকে এগোয় তখন জল ওঠানামা করে বটে, তবে কোনও জলের কণাই পাশের দিকে সরে যায় না কিন্তু। এটা এই ধরনের তরঙ্গের খুব বড় একটা বৈশিষ্ট্য।
আর এই বৈশিষ্ট্যের ওপরেই ভিত্তি করে তরঙ্গ দু’রকমের: অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ; যার উদাহরণ শব্দ, আর তির্যক তরঙ্গ; যেমন আলো। প্রথম ক্ষেত্রে তরঙ্গের গতির দিকেই মাধ্যমের উপাদান-কণাদের ওঠানামা ব্যাপারটা ঘটে, তাই অনুদৈর্ঘ্য, আর দ্বিতীয়টায় ওই জলের ওপর দিয়ে ঢেউ যাওয়ার মতোই ব্যাপার ঘটে। তবে এই দু-ধরনের তরঙ্গই এগিয়ে যাওয়ার সময় আসলে যেটা এগোয়, সেটা হল শক্তি, বা এনার্জি।
আপাতত আমরা এই তির্যক তরঙ্গের দিকেই নজর রাখব, কারণ আমাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয় যে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, সেটা আসলে তির্যকই। সব ধরনের তরঙ্গেরই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে; যেমন তার বিস্তার (amplitude), তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength), কম্পাঙ্ক (frequency), পর্যায়কাল (time period), শক্তি (energy) এরকম কয়েকটা। নিচের ছবিটায় তির্যক তরঙ্গকে সহজে দেখানো হয়েছে :
ছবি : এখানে পাতার বাম দিক থেকে ডানদিকে তরঙ্গের এগিয়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি দুটো ঢেউয়ের মাথার মধ্যে যে ফাঁকটুকু, ওটাই তরঙ্গদৈর্ঘ্য, যাকে প্রকাশ করা হয় গ্রিক অক্ষর ‘ল্যাম্বডা’ দিয়ে
তরঙ্গ এগিয়ে যাওয়ার সময় এক সেকেন্ডে যতগুলি ঢেউ কোনও নির্দিষ্ট বিন্দু অতিক্রম করে, সেই সংখ্যাকে বলে ওই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক। আর দুটো পাশাপাশি ঢেউয়ের মাথার মধ্যে যে দূরত্ব, ওটাই তরঙ্গদৈর্ঘ্য। একটু ভাবলেই বোঝা যায়, যে তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মানে ওই দূরত্ব যত বেশি, সে তত কম সংখ্যায় একটা বিন্দু দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ভেদ করে যাবে, তার মানেই তার কম্পাঙ্ক কম হবে। সহজ উপায়েই দেখানো যায় যে কোনও তরঙ্গের বেগ সবসময় তার কম্পাঙ্ক আর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের গুণফল। এখন আমরা যে কোনও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের শূন্যস্থানে বেগ কত সেটা জানি— সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। কারণ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের একটি পরিচিত উদাহরণ হল ‘আলো’। আর আলোর বেগ ওটাই।
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে ইংরেজিতে বলে ‘Electromagnetic Wave’। এই তরঙ্গ তৈরি হওয়ার একটা শর্ত আছে। এখানে কম্পমান তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্রকে পরস্পরের সঙ্গে সমকোণে থাকতে হয়, অর্থাৎ সে দুটোর মধ্যে কোণ হতে হবে ৯০ ডিগ্রি। আর সেক্ষেত্রে যে তরঙ্গ তৈরি হবে, সেটা এগিয়ে যাবে আবার এই দুটো ক্ষেত্রের সঙ্গেই সমকোণে; ব্যাপারটা হবে এইরকম:
ছবি : এখানে পরস্পরের সঙ্গে লম্বদিকে তিনটে অক্ষ দেখানো আছে— এক্স, ওয়াই আর জেড অক্ষ। ওয়াই দিক বরাবর কম্পিত হচ্ছে তড়িৎক্ষেত্র (‘E’ অক্ষর দিয়ে বোঝানো হয়েছে), জেড দিক বরাবর (যেটা বইয়ের বা মোবাইলের তলের সঙ্গে লম্বদিকে মানে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে) কম্পিত হচ্ছে চৌম্বকক্ষেত্র (‘B’ অক্ষর দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে) আর এক্স অক্ষের দিক বরাবর তরঙ্গটি এগোচ্ছে। ‘c’ অক্ষর দিয়ে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বেগ বোঝানো হয়। প্রত্যেক ইংরেজি অক্ষরের মাথায় একটা করে তীরচিহ্ন আছে, যেটা দিয়ে বোঝা যায় যে ওই রাশিটি ভেক্টর, মানে ওর মান ছাড়াও নির্দিষ্ট দিকও আছে।
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের কিছু সাধারণ ধর্ম রয়েছে, পরের পর্বে সেগুলো সম্বন্ধে আগে কিছু বলে নেওয়ার পর এই তরঙ্গ সংক্রান্ত নানা দিক নিয়ে কাজ করেছিলেন এমন কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম আর কাজের কথা আলোচনা করব আমরা। জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারের তাৎপর্য বুঝতে গেলে এঁদের কাজের কথা অবশ্যই জানা দরকার।
........................................
আগের পর্বগুলি পড়ুন :
১) বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (প্রথম পর্ব)
২) বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (দ্বিতীয় পর্ব)
........................................
লেখকের যোগাযোগ - ৭০৪৪৫৬৬৫৫০, ই-মেল: [email protected]
#Jagadish Chandra Bose #Radio #Radiowave #জগদীশচন্দ্র বসু #অর্পণ পাল