বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (দ্বিতীয় পর্ব)
পর্ব ২ : বিনা তারে সংযোগ স্থাপন : বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা
....................................
নিজেদের বক্তব্যকে দূরবর্তী কোনও জায়গায় পাঠাবার তাগিদ সভ্যতার আদিযুগ থেকেই অনুভব করে আসছে মানুষ। যে কারণে আগেকার দিনে রাজা-মহারাজারা বার্তা পাঠাবার উদ্দেশ্যে পায়রা ওড়াতেন। সেই পায়রার পায়ে বাঁধা থাকত সুতোয় জড়ানো চিঠি। পায়রা ঠিক চিনে-চিনে গন্তব্যে পৌঁছে যেত, চিঠি চলে যেত উদ্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে। সে সব রাজা-মহারাজাদের নিজস্ব দূতও থাকত, যারা রণ-পায় চড়ে পাড়ি দিত বহু দূরের পথ। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ যাঁরা পড়েছেন জানেন এমন দূতের কত বড় ভূমিকা ছিল সেই কাহিনির গতিপথ নির্ধারণে।
এ ছাড়া প্রচলিত ছিল ঘোড়ায় চড়ে খবর পৌছে দেওয়ার, বা মশালে আগুন জ্বেলে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার প্রাচীন পদ্ধতিও। তবে এর কোনওটাই নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়। আর আজকের দিনের মোবাইল-বার্তা বা টিভি সিগন্যালের মতো নয় তাৎক্ষণিকও। ওই সব আমলের মানুষেরা কি দূরতম কল্পনাতেও ভাবতে পারত যে এমন একদিন আসবে, যখন ছবি আর ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে হাজার-হাজার কিলোমিটার দূরের কোনও জায়গায়?
বিবর্তনের ধারায় বড় মাপের পদক্ষেপ নজরে এল উনিশ শতকে এসে, যখন চালু হল টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা। মোটামুটি উনিশ শতকের তিন আর চারের দশকের দিকে স্যামুয়েল মোর্স (Samuel Morse, ১৭৯১-১৮৭২) নামে এক আমেরিকান উদ্ভাবক (সফল ব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি ইনি সে দেশের রাষ্ট্রপতির ছবিও আঁকতেন) চালু করেন এই ব্যবস্থা। ততদিনে এটা সকলের জানা হয়ে গিয়েছে যে তড়িৎ আর চুম্বক পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, একটার সঙ্গে সম্পর্কিত যন্ত্রের গতি প্রভাবিত করে অন্যটাকে। এখন কোনও একটা জায়গা থেকে যদি তড়িৎ-প্রবাহের মাধ্যমে অল্পসময়ব্যাপী একটি সিগন্যাল (যাকে পালস সিগন্যাল বলা হয়ে থাকে) তৈরি করে সেটাকে তারের মাধ্যমে দূরের অন্য কোনও জায়গায় রাখা ধারক যন্ত্রের মধ্যে পাঠানো যায়, তবে ওই সিগন্যালের দৈর্ঘ্য কম-বেশি করার মধ্যে দিয়ে ওই দূরবর্তী স্থানে রাখা যন্ত্রের মধ্যে থেকে বের হওয়া সাড়ার সময়কাল কমবেশি হওয়ার মাধ্যমে বার্তা পাঠাবার কাজ সেরে ফেলা যায়।
হ্যাঁ, এটাই করেছিলেন স্যামুয়েল সাহেব। দুটো স্থানকে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে সংযোগ স্থাপন করে ওই তারের মাধ্যমে ইলেকট্রিক সিগন্যাল-বাহিত বার্তা পাঠাবার তাঁর আবিষ্কৃত এই পদ্ধতিটি বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একাধিক ডট (.) আর ড্যাশ (-) এবং স্পেস বা ফাঁকা জায়গার সজ্জার মাধ্যমে ইংরেজি বর্ণমালার সব কয়টি অক্ষর, যতিচিহ্ন এবং এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন তিনি। যেমন, যে সব অক্ষর বেশি ব্যবহৃত হয় (যেমন E) সেগুলোর জন্য ছোট সঙ্কেত (একটা মাত্র ডট) আর যেগুলো কম ব্যবহৃত হয় (যেমন Q)-সেগুলোর জন্য বড় আকারের সঙ্কেত (তিনটে ড্যাশ আর একটা ডট) ব্যবহৃত হত। তবে এখানেই বলে রাখা ভালো যে আরও কয়েক বছর পর কিছু ইউরোপীয় ভাষার অক্ষর নিয়ে সমস্যার কারণে এই কোড-চিহ্নগুলোকে বেশ কিছুটা বদলে ফেলে একটি আন্তর্জাতিক কোড-ব্যবস্থা চালু করা হয়।
১৮৪৪ সালের ২৪ মে মোর্স সাহেব প্রথম তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে বার্তা পাঠালেন আমেরিকার ওয়াশিংটন থেকে বাল্টিমোরে, আর এর বাইশ বছর পরে আমেরিকা আর ইউরোপের মধ্যে আটলান্টিক বরাবর তার লাগানোর কাজটা সমাপ্ত হল। অবশ্য তার বেশ কিছু আগেই টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বার্তা পাঠাবার কাজে লেগে পড়েছিল ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশও, যেমন ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের মধ্যে ১৮৫১ সালে স্থাপিত হয় এই যোগাযোগ-ব্যবস্থা। ১৮৭০ সালে ব্যাপারটা আসে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে। লন্ডনের সঙ্গে তখনকার ভারতের রাজধানী কলকাতার যোগসূত্র স্থাপিত হল টেলিগ্রাফিক তারের মাধ্যমে। অবশ্য ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপিত হয়েছিল এর বেশ কিছু বছর আগেই: ১৮৫০ সালে কলকাতা আর ডায়মন্ডহারবারের মধ্যে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ সম্পূর্ণ হয়।
তবে বিশ শতকের সূচনাকাল থেকে বিনা তারে বার্তা প্রেরণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পরে এই পুরো বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থাটাই অনেক বেশি গতি পেল। পাশাপাশি দ্রুততা আর নিশ্চয়তার দিক থেকেও আগেকার সব ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে গেল বিনা তারে বার্তা পাঠানোর এই ব্যবস্থা। বহু দূর দেশ থেকে বার্তা আসতে লাগল মুহূর্তের মধ্যে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই রেডিও-ওয়েভ বা রেডিও তরঙ্গের সাহায্যে বার্তা পাঠানোরই অবিশ্বাস্য ফল আজকের মোবাইল, টিভি বা ইন্টারনেট। তবে সে বিবর্তনের ইতিহাস একটু পরে বলছি।
বিনা তারে বার্তা প্রেরণ নিয়ে পুরনো আমলের একটি ঘটনা
তারবিহীন উপায়ে বার্তা প্রেরণ প্রথম কে করেন বা কীভাবে, সেটা খুবই বিস্তারিত আলোচনা এবং বিতর্কিত এক বিষয়। ইতালির ইঞ্জিনিয়ার-উদ্ভাবক গুগলিয়েমো মার্কনিকেই আজকের দিনে সে কৃতিত্ব দেওয়া হলেও তাঁর জন্মেরও আট বছর আগে খুব ছোট আকারে এই ব্যাপারটা করে দেখিয়েছিলেন বছর চল্লিশেক বয়সী এক আমেরিকান দন্তচিকিৎসক। তাঁর এই প্রদর্শনের খবর খুব বেশি প্রচারিত না হলেও বিনা তারে বার্তা প্রেরণের আদি-উদাহরণ হিসেবে এই ঘটনাকেই আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে এখন।
সেটা ছিল ১৮৬৬ সালের অক্টোবর মাস। মাহলন লুমিস (Mahlon Loomis, ১৮২৬ - ১৮৮৬) নামের ওই আমেরিকান ডাক্তার ভদ্রলোক সেদিন হাজির হন ভার্জিনিয়া প্রদেশের ব্লু রিজ পাহাড়ের কাছে। এই ঘটনার বছর দুয়েক আগে থেকেই এই ভদ্রলোক নিজের ডায়েরিতে পরিকল্পনা করছিলেন বিনা তারে কীভাবে টেলিগ্রাফিক সিগন্যাল এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো যায় সে ব্যাপারে, চিন্তাভাবনার পাশাপাশি নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে আসছিলেন। তো সেদিন তিনি প্রায় তিরিশ কিলোমিটার ব্যবধানে দুটো পাহাড়ের মাথায় আলাদাভাবে বসালেন দুটো ঘুড়ি, সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল ছ’শো ফুট লম্বা ধাতব তার, এবং সেই তারের নীচের দিকে লাগানো রইল বিদ্যুৎ সিগন্যাল তৈরির যন্ত্র, এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি। একটা পাহাড়ের মাথা থেকে ছেড়ে দেওয়া বৈদ্যুতিক সিগন্যাল অ্যান্টেনার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে এবং অন্য পাহাড়ের মাথায় থাকা ঘুড়িতে ধরা পড়ে সেই সিগন্যাল। আর সেই ঘুড়ি সিগন্যালের উপস্থিতিতে নানাভাবে চলমান হয়ে ওঠে, যা স্পষ্টভাবেই বিদ্যুৎ-সিগন্যালের বাতাসের মধ্যে দিয়ে সঞ্চারণকেই প্রমাণ করে।
কিন্তু লুমিসের কপাল খারাপ, বিস্তর চেষ্টা করেও এই আবিষ্কারের জন্য সরকারি তরফে কোনও আর্থিক সাহায্য পাওয়া হয়নি তাঁর, সে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ডামাডোলের কারণে। তাঁর ওই পরীক্ষাটিও কাঙ্ক্ষিত গুরুত্ব পেল না এবং আরও কয়েক বছর পর সকলে এই ঘটনার কথা ভুলেও গেলেন। ইতিমধ্যে রঙ্গমঞ্চে হাজির হয়েছেন হেইনরিখ হাৎর্জ, জগদীশচন্দ্র, অলিভার লজ বা আরও অনেকে, ওঁরা লেগে পড়লেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানোর কাজে। আর শেষ পর্যন্ত ইতালির গুগলিয়েমো মার্কনির হাতেই উঠল সাফল্যের স্বীকৃতি। তবে আজকের দিনে মাহলন লুমিস-কে অনেকেই তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানাচ্ছেন, তাঁকেই ‘বেতার ব্যবস্থার পথিকৃৎ’ বা ‘Pioneer of Radio’ বলে থাকেন গবেষকেরা।
আসলে কোনওরকম তারের সাহায্য ছাড়াই দূরবর্তী জায়গায় বার্তা পাঠানোর সব রকম ব্যবস্থারই একটাই নাম, সেটা হল ‘ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন’ বা ‘বিনা-তারে সংযোগ’। যার সার্থক প্রয়োগ আজ আমরা দেখি টিভি, মোবাইল, রেডিও ইত্যাদি ব্যবস্থাপনায়। অদৃশ্য তরঙ্গের সাহায্যে এই যে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা, এই কাজেরই আদি-যুগে আমাদের জগদীশচন্দ্র বা অন্যেরা রেখেছিলেন তাঁদের উজ্জ্বল কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তবে এঁদের কথা বিস্তারিতভাবে শুরু করবার আগে যে তরঙ্গ-কে কাজে লাগিয়ে এই বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা প্রচলিত হতে শুরু করেছিল, সেই তরঙ্গ জিনিসটার ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। সেটা আগামী পর্বে।
........................
আগের পর্ব পড়ুন :
#Jagadish Chandra Bose #Radio #Radiowave #silly পয়েন্ট #অর্পণ পাল