বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (প্রথম পর্ব)
পর্ব ১ : বেতার তরঙ্গের নানা দিক
........................................
রেডিও ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ হল সেই মুখ্য কুশীলব যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বিনা তারে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানোর কাজটা। ‘রেডিও’ বা ‘বেতার’ নামের যে যন্ত্রটির সঙ্গে আমরা শৈশব থেকেই পরিচিত, তার সঙ্গে অদৃশ্য এই তরঙ্গের সম্পর্ক তো আছেই, তবে রেডিও তরঙ্গের অস্তিত্ব শুধু যে ওই যন্ত্রের সঙ্গেই একমাত্র জড়িত, এমনটা নয় কিন্তু; ওর বিস্তৃতি আরও ব্যাপক। আজকের দিনে টিভি বা মোবাইল ফোনের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই বিশেষ তরঙ্গ। এই সব যন্ত্রের মধ্যেকার ধারক-অংশে অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ প্রবেশ করে বিভিন্ন যান্ত্রিক ধাপ পেরিয়ে তা রূপান্তরিত হয় আলো বা শব্দ-শক্তিতে। যা আমরা দেখি পর্দায় (ডিসপ্লে-র মাধ্যমে) বা শুনি কান দিয়ে। বেতার তরঙ্গ আসলে কী, সেটা আমরা এই লেখায় একটু বাদেই আলোচনা করব, তবে এর কম্পাঙ্ক যে তিন কিলো হাৎর্জ থেকে তিনশো গিগাহাৎর্জ অব্দি হতে পারে, এটুকু আপাতত বলে রাখা যাক। তরঙ্গের কম্পাঙ্ক জিনিসটা আসলে কী, সেটাও একটু বাদেই বলব আমরা।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রথা (International Telecommunication Union বা ITU এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী সংস্থা) অনুযায়ী রেডিও তরঙ্গকে ন-টা ভাগে ভেঙে দেখানো হয়। যেগুলোর প্রত্যেকটার প্রয়োগ রয়েছে বাস্তব ক্ষেত্রে; আমরা একটু এই ভাগগুলো দেখে নিই :
[* এখানে KHz-এর পুরো কথা কিলোহাৎর্জ, এক কিলোহাৎর্জ মানে হল এক হাজার হাৎর্জ; MHz বলতে মেগাহাৎর্জ, আর এক মেগাহাৎর্জ মানে ১০০০০০ হাৎর্জ; এবং একইভাবে GHz বলতে গিগাহাৎর্জ, এবং এক গিগাহাৎর্জ অর্থে ১০৯ (১-এর পরে ন-টা শূন্য) হাৎর্জ]
এর মধ্যে কোন ধরনের বিকিরণ কোন-কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগে, সে ব্যাপারে কিছু বলে নেওয়া দরকার।
এই তালিকার একেবারে শুরুতে যেটা রয়েছে, সেই ELF তরঙ্গের প্রয়োগ দেখা যায় সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে থাকা সাবমেরিনের সঙ্গে যোগাযোগের সময়ে। যেহেতু এই বিকিরণের কম্পাঙ্ক বাকিগুলোর চেয়ে কম, তাই সহজ নিয়মে এর শক্তিও কম, আর তাই এই বিকিরণকে আকাশে খুব বেশি দূর পাঠানো যায় না। যে কোনও বিকিরণের শক্তি তার কম্পাঙ্কের ওপর সরাসরি নির্ভর করে; তাই কম্পাঙ্ক কম হলে শক্তিও কম হয়। ELF বা VLF বিকিরণের আরও একটা প্রাকৃতিক দৃষ্টান্ত দেখা যায় বজ্রপাতের সময়। এই ধরণের বিকিরণ আয়নমণ্ডলে গিয়ে প্রতিফলিত হয়ে ফিরেও আসতে পারে। এই কারণে বজ্রপাত হলে অনেক সময় স্বাভাবিক রেডিও সিগন্যাল (টিভি বা মোবাইলের জন্য দরকার লাগে যে সঙ্কেত-এর)-এর গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।
LF বা MF-কে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় আকাশে উড়ন্ত যানবাহনদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। তাছাড়া রেডিওর যে বিভিন্ন সম্প্রচারক স্টেশন, সেখান থেকে নির্গত ‘অ্যামপ্লিচিউড মডিউলেটেড’ (বা AM Modulation। কম শক্তিশালী তরঙ্গকে বেশি শক্তিশালী তরঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দূরে পাঠানোর একটা উপায় হল এই AM পদ্ধতি। Modulation নিয়ে আমরা আবার আলোচনায় আসব এই ধারাবাহিকেই, পরের দিকে) সিগন্যালের বেলাতেও দেখি এই ধরনের তরঙ্গের ব্যবহার। রেডিও স্টেশনের বিকিরণের পাল্লা সাধারণত হয় ৫৩৫ কিলোহাৎর্জ থেকে ১.৭ মেগাহাৎর্জ-এর মধ্যে। দিনের বেলায় আরও নানা রকমের সিগন্যাল আকাশময় ছড়িয়ে থাকে, যার জন্য আয়নমণ্ডল থেকে প্রতিফলনের ক্ষেত্রে এই ধরনের বিকিরণ (এএম) কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতের বেলা এই সমস্যা কমে যায় বলে আগেকার দিনে দেখা যেত রাতের দিকে রেডিওতে প্রোগ্রাম অনেক ভালো অর্থাৎ স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে।
উচ্চশক্তিসম্পন্ন রেডিও বিকিরণ, যেমন HF, VHF বা UHF— এগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় মোবাইল ফোনে, জিপিএস ব্যবস্থায় (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) বা এফএম রেডিওর অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে। সাধারণত ‘ফ্রিকোয়েন্সি মডিউলেশন’ বা কম্পাঙ্ক বিরুপন পদ্ধতির মাধ্যমে এই তরঙ্গকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় (এই ব্যাপারটা নিয়েও আমরা বিশদে আলোচনা করব পরে)। এই ধরনের তরঙ্গের মান ভালো হয়, তাই আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে সাধারণ বেতার স্টেশনের চেয়ে এফএম স্টেশনগুলি থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান অনেক বেশি স্পষ্ট শোনা যেত।
এটা আমরা সকলেই জানি যে আমাদের দেশের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর গবেষক-জীবনের প্রথম দিকে এই তরঙ্গেরই নানা ধর্ম নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন এবং এই ধরনের তরঙ্গকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানোর কাজে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে ধরনের বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছিলেন, সেটা ওপরের ওই ছকে একেবারে নিচের তরঙ্গ-পাল্লার অন্তর্গত: EHF বা অতি উচ্চ কম্পাঙ্ক-বিশিষ্ট বিকিরণ; এবং এর কম্পাঙ্ক তিরিশ থেকে তিনশো গিগাহাৎর্জ অবধি। আজকের দিনে মোবাইলে যে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক এসে গিয়েছে বলে আমরা উল্লসিত; সেই তরঙ্গ কাজ করে এই পাল্লার মধ্যেই, তার কম্পাঙ্ক থাকে চব্বিশ থেকে ছিয়াশি গিগাহার্জ-এর মধ্যে। তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরও বহুবিধ প্রয়োগ ঘটছে এই পাল্লার তরঙ্গের, যা নিয়ে আপাতত আমাদের আলোচনা আর না করলেও চলবে। তবে এটা এখানেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে এই ধরনের তরঙ্গকে স্থানান্তরের কাজেই বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র।
রেডিও তরঙ্গের কথা পদার্থবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে আরও অনেক জায়গাতেই উল্লেখ হতে দেখি আমরা। মহাবিশ্বের গঠন বা বিবর্তনের ইতিবৃত্ত জানবার কাজে এই তরঙ্গ বা এর খুব কাছাকাছি থাকা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন’ নামে এক বিশেষ বিকিরণের উৎস খুঁজতে গিয়েই ধরা পড়েছিল বিগ ব্যাং নামে সেই আদি বিস্ফোরণের সুলুকসন্ধান। যা থেকে পরে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারণশীল, এবং এর উৎপত্তি এক বিন্দুর মতো সামান্য একটুখানি জায়গায় জমাট হয়ে থাকা অসীম ঘনত্বের পদার্থের প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের ফলে।
বেতার তরঙ্গ আসবার আগে কী ধরনের উপায়ে বার্তা পাঠানোর চল ছিল বিভিন্ন দেশে, সে ব্যাপারে আমরা অল্প কিছু আলোচনা করব, আগামী পর্বে।
(আগামী পর্ব আগামী শনিবার)
....................................
[ফিচারহেড : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]