‘কী জ্বলছে?’-র পাশেই রাখা থাক প্রশ্ন ‘কে জ্বালিয়েছে?’
বিশ্বখ্যাত গের্নিকা-য় কেন এতজন নারী? এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় পৌঁছতে গেলে দৃষ্টির যে শিল্পিত শীলিত ভঙ্গি প্রয়োজন, তা অনস্বীকার্য, জেনেও, বলা যায়, সময়ের প্ররোচনাও এখানে অনুঘটক। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘পিকাসোর গের্নিকা’, সদ্য-প্রকাশিত বইখানা পড়তে গিয়ে এই প্রশ্নের কাছাকাছি পৌঁছনো গেল। শিল্প-সমালোচকরা এর একাধিক উত্তরে পৌঁছেছেন। পিকাসোর নারীপ্রীতি, তাঁর মায়ের স্মৃতি কিংবা যুদ্ধের সময় পুরুষরা বাইরে চলে যান বলে অত্যাচারের দহন নারীদেরই সইতে হত— এমন অনেকানেক কারণ আছে; একটা টেক্সট-কে কেটে ছিঁড়ে দেখলে নির্মাণ আর সৃষ্টির রসায়ন থেকে যেভাবে বহুবিধ সম্ভাবনা উঠে আসে, তেমনই। কিন্তু যা আমাদের বিমূঢ় করে তা হল, গের্নিকার জন্মবৃত্তান্তের ভয়াবহতা। সে-কথা আমাদের জানা। দেখা যাচ্ছে, এই ভয়াবহতার কেন্দ্রে থেকে যাচ্ছে নারীই। এবং, জার্মান অফিসারের সঙ্গে সেই প্রশ্নোত্তর, যা আমাদের কাছে এখন পরিচিত— এটা আপনি করেছেন? জবাবে পিকাসো বলেছিলেন, না আপনি করেছেন। — তা-ও আজ আমাদের কাছে খুব জরুরি। কেন-না যে সময়ের ভিতর আমাদের বেঁচে-থাকা, তাই-ই ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে এই প্রাসঙ্গিকতায়।
গত দিনকয়েক আমরা কী দেখলাম? দেখলাম, তথ্য ও প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা আর উৎকর্ষতার ভিতর আমরা কেবলই খুঁজে চলেছি খানিকটা অন্ধকার, যেখানে গোপনে ধর্ষিতার লাশ দাহ করে ফেলা যায়। সবার-কাছে-সবকিছু-স্পষ্ট সময়ের অলিন্দে বসে আমরা কেবলই একটা পরিসর খুঁজছি, যেখানে এই পুরো অধ্যায়টিই একটি অস্বীকারের আখ্যান হয়ে ওঠে। এবং, আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণই থাকবে না, যখন দেখব, অস্বীকারটি আমাদের চোখের সামনেই সত্যি হয়ে উঠেছে। এই বাস্তবতাই তো জাদুবাস্তব, যা বাস্তবে কল্পনা করাও যেন অসম্ভব মনে হয় একসময়। অবলীলায় আমরা সেখানে পৌঁছে গিয়েছি। তাই, এখন যে-ছবিটা নিয়ে আমরা কথা বলব, ধরে নিন, ‘গের্নিকা’ নয়, তার নাম ‘হাথরাস’। সেখানে এক নির্যাতিতা নারী পুড়ে যাচ্ছেন। তা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সে-কারণে নিযুক্ত রাষ্ট্রের পাহারাদাররা। তারাই ছবিটার পুরোভাগ দখল করে আছে। ছবিটার একেবারে কোনার দিকে নির্যাতিতার পরিবারের লোকেরা খাঁচায় বন্দি। ঠিক তার বিপরীত কোনায়, আমরা দেখতে পাচ্ছি, সংবাদমাধ্যমের উপর একটা মস্ত পালিশ-করা বুট। ছবিটা এখানেই শেষ নয়। দেখা যাচ্ছে, সেখানে আরও-কিছু জ্বলছে। হয়তো প্রত্যেকটিই কোনো-না-কোনও নির্যাতিতার লাশ। অথবা গণতন্ত্র। কিংবা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা বা আমাদের প্রগতিশীলতার মুখোশ। এই বুঝে উঠতে না-পারাতেই আমাদের ছবিটা রহস্যময় হয়ে উঠেছে অনেকখানি। অবশ্য সে-রহস্যে ইতি পড়ে, যদি ধরে নেওয়া হয়, সবগুলোই জ্বলছে। তখন রহস্যহীন স্পষ্ট গোদা এই ছবিটা কি চোখে আঙুল দিয়ে ভয়াবহতার ইঙ্গিত করে না! ঠিক এইখানে মোক্ষম প্রশ্নটা ফিরিয়ে আনা যাক; ধরা যাক, কল্পিত শিল্পীকেই আমরা প্রশ্নটা করলাম, এ-ছবি আপনি করেছেন? তিনি জবাব দিলেন, না আপনি। এই উত্তর যখন সরাসরি বিদ্ধ করছে আমাকেই, তখন সর্বাগ্রে এই ভয়াবহতার দায়-লজ্জা-অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের তৈরি রাখা দরকার।
আরও পড়ুন : সাম্প্রতিক কয়েকটি ধর্ষণ ও গুরুর মতাদর্শ / মোহিত রণদীপ
এ-কথা নিয়ে আজ আর লুকোচুরি করে লাভ নেই, যে, আমাদের সমাজ আজও বিশুদ্ধভাবে বর্ণবাদী। সেই রামরাজ্য থেকে ফিলহালের ‘অচ্ছে দিন’ পর্যন্ত আমাদের সকল দুঃখের উপশম হিসেবে যে মহৌষধি ফিরি করা হয়েছে, সেখানে সঙ্গোপনে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে বর্ণাশ্রমকে। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে, আমাদের পরাক্রমী যুগনায়ক, বর্ণাশ্রমকে শিরোধার্য করে দিয়ে গিয়েছেন। আমরা ‘গীতা’ বুকে তুলে রেখেছি। মজা এমনই যে, গান্ধির হাতেও ‘গীতা’। গডসের ভরসাও ‘গীতা’। যাই হোক, হিন্দু সমাজ বলে যে ধারণাটি আমরা পোষণ করি, তার মেরুদণ্ড হল এই বর্ণাশ্রম। কোনও নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ পাঠের দরকার নেই, এমনকি নির্দিষ্ট কোনও আচার-অনুষ্ঠান পালন না-করেও কেউ হিন্দু থেকে যেতে পারেন আজীবন। কিন্তু তিনি এই বর্ণাশ্রমের বাইরে যেতে পারেন না। জন্ম হওয়া মাত্র সদ্যোজাত এহেন বিভাজনের কোনও এক স্তরে এসে পড়ে। তা থেকে আজীবন আর তার মুক্তি নেই, এখানে কোনও ‘চয়েস’ নেই। এখন, এই প্রসঙ্গে, এ তো মাত্র ‘গুণ ও কর্মের’ ভিত্তিতে তৈরি সমাজগঠনের প্রক্রিয়া– এই আপ্তবাক্য আওড়াতে গেলে বলতে হয় সমাজ ও ইতিহাসের প্রতি আমরা অন্ধ থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আশ্চর্য এই যে, সেই অন্ধতাকেই যষ্ঠি করে যতবার আমরা আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবনা ভেবেছি, ততবার ইউটোপিয়ার ছদ্মবেশে ক্লাস ইউটোপিয়াকেই মেনে নিয়েছি। শুধু মেনেই নিইনি, বরং নির্বাচিত করে তথাকথিত গণতন্ত্রের শীর্ষে বসিয়ে দিয়েছি। নইলে যে-মহাপুরুষ এ কালে ইউটোপিয়া ফিরি করলেন, তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড ও বাণীসমগ্রের যৎকিঞ্চিৎ নজর করলেই স্পষ্ট হত যে, এ আসলে বর্ণবাদী সমাজের উপরই চুনকাম পড়ছে মাত্র। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দেশের সমস্ত ধনরাশি সঞ্চিত হতে চলেছে মুষ্টিমেয়র হাতে। তাঁর বহুল প্রচারিত ‘মডেল’-এর ছত্রে ছত্রেই তা বিধৃত ছিল। তা, যোগীর ছদ্মবেশে অপহরণকারী যে আসতে পারে, দুধ বলে যে পিটুলিগোলা জল খাইয়ে দেওয়া যেতে পারে– আমাদের চিরকালের আখ্যানে এ-বিষয়ে কম সতর্ক করার চেষ্টা করা হয়নি। যুগে যুগেই সেই প্রয়াস অন্তর্লীন থেকেছে। তবু, আমরা এই বর্ণবাদী সুবিধা ছাড়তে পারিনি। আমাদের কল্পিত ছবিটির প্রথম খসড়া শুরু হয় এখান থেকেই।
মাঝে মাঝে অবশ্য আর-একটা কাজ করা হয়েছে। এই কাঠামোর নীচুতলায় যাদের রাখা হয়েছে, তাদের উপরতলার সঙ্গে এক করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। নানা নাম দিয়ে বুকে টেনে নেবার প্রচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কে কাকে টেনে নেবে! যে সমান-সমান, অভেদ, তাকে অনুগ্রহ নিয়ে থাকতে হবেই-বা কেন! কিছুদিন আগে প্রফেসর রোমিলা থাপার ভার্চুয়াল মাধ্যমের এক প্রশ্নোত্তর আসরে বলছিলেন, শুধু বিবিধ বৈচিত্র্য স্বীকার করে নেওয়াতেই কাজ শেষ নয়। দেখতে হবে, সেই বৈচিত্র্যের প্রতিটি ধারাকে আমরা সমগুরুত্ব দিচ্ছি কি-না। বলা বাহুল্য, আমরা তা দিই না। দিতে রাজিও নই। আমাদের ছবিটির দ্বিতীয় খসড়ায় যোগ হয়েছে এই সব কিছুই।
আরও পড়ুন : ধর্ষণ, ক্ষমতায়ন এবং বিচারের বাণী : গোবিন্দ নিহালনির ‘আক্রোশ’ / রোহন রায়
তা সত্ত্বেও, আম্বেদকরের মতো কেউ কেউ থাকেন বলে, ওই নীচুতলার মধ্যেও একটা মধ্যবিত্তের আদল রূপ পায়। অন্যদিকে উঁচুতলা খানিকটা নিজের দোষেই চ্যুত হয়। আর সেই দোষ গিয়ে পড়ে ওই নীচুতলার উপর। সংরক্ষণের উপর। যুগসঞ্চিত ঔদ্ধত্য তাকে যেন অধিকারই দেয়, এই নীচুতলাকে উৎপীড়ন করার। অরুন্ধতী রায়, তাঁর বইতে এক চোদ্দো বছরের কিশোরীকে উদ্ধৃত করেছেন, যিনি বলেছিলেন, যে ধর্মের কারণে একজন অকারণে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, অন্যজন অকারণেই বঞ্চিত হয়, সেই ধর্মকে মুছে দেওয়া ভালো। এমন ধর্ম যেন আমাদের মধ্যে ঢুকতে না-পারে। মুছে দেওয়া দূরে থাক, আমরা এমন ধর্মকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম। এই তৈরি হল আমাদের ছবির তৃতীয় খসড়া।
এরই মাঝে গোলোকায়নের নামে যে সোনার হরিণ আমাদের ডাক দিয়ে বিভ্রান্ত করল, সে আর-এক কাণ্ড বাধাল। এই ধর্মকে ভূ-খণ্ডের সীমা পার করে দিল। ধর্মে-ধর্মে ঠোকাঠুকি যে ছিল না, তা নয়। সে আগুনে ঘি পড়ল। ধর্মের নামে বিশ্ব ক্রমশ আড়াআড়ি ভাগে বিভাজিত হতে থাকল। আড়কাঠি হয়ে থাকল কিছু মাধ্যম, যারা নামে সামাজিক। এই ধর্মীয় বিভাজন যত প্রকট হল, প্রকট করতে রাষ্ট্রনেতারা যত মেগালোম্যানিয়াক হলেন, মিজাঁথ্রপির বিষকাঁটা তত আমাদের এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। এমনকি তা জাতিসত্তার আদল বদলাতেও এবার কোমর বেঁধে নামল। যে-জাতিসত্তা একদিন ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে বাঁচাতে সহায় হয়েছিল বলে মনে করা হয়, তাকেই এবার উলটোমুখে চালিত করে দেওয়া হল। অর্থাৎ, এবার শুরু ঔপনিবেশিকতার নয়া পরিচ্ছেদ। কিন্তু তার প্রচ্ছদ হয়ে থাকল সেই ক্লাস ইউটোপিয়া। বর্ণবাদী বাস্তুসাপ জেগে উঠল। রূপ পেল আমাদের ছবির চতুর্থ খসড়া।
কিন্তু কথা হল, আমাদের সেই তথাকথিত কল্যাণকামী রাষ্ট্র কেন এইসব মেনে নিল বা নিচ্ছে? আমাদের ছবিটি এবার পরিণতির অনেকখানি কাছাকাছি। এইখানে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাব, নয়া উদারবাদ নামে যে সোনার পাথরবাটিটা নিয়ে এতদিন বেশ সুখেই কাটছিল, আজ বোঝা যাচ্ছে, তা না সোনা, না পাথর। বাটিটা নিয়েও আর কারও কাজ নেই। ফলে, নিজের স্বার্থেই পুঁজিকে বিন্যস্ত হতে হচ্ছে। নতুন পথ খুঁজে নিতে হচ্ছে। এমতবস্থায় এইসব রাষ্ট্রযন্ত্র কী করতে পারে! সম্ভবত সে নিজেই তা জানে না। প্রবল আক্রোশে সে তাই তার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। যে-উপায়ে তা সম্ভব, তার জন্য যদি অন্ধকার ডেকে এনে নির্যাতিতার লাশ পুড়িয়ে ফেলতে হয়, গণতন্ত্র মুছে দিতে হয়, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিতে হয়, তা-ও সই। সে তাই-ই করছে। সে সবকিছুকেই প্রশ্রয় দিতে রাজি, যা তাকে ক্ষমতার অমরত্ব দেবে— সে বর্ণবাদ হোক কি কর্পোরেট — এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ছুঁতমার্গ নেই। বিবেক বাঁচিয়ে রাখার দায় রাষ্ট্রের নেই। ছিলও না কোনও কালে।
ছবিটা এভাবেই তৈরি হয়েছে। তিলে তিলে। আমাদের সম্মতিতে। প্রতি খসড়ায় লেগে আছে আমাদের অনুমোদন। সেই হেতু, এই প্রকল্পে কল্পিত শিল্পী বলে আর কেউ থাকছেন না। যদি প্রশ্ন ওঠে, এ-ছবি আপনি করেছেন, আমাদের আর কাউকে দেখিয়ে বলার উপায় নেই যে, না আপনি করেছেন।
ফলত, ‘কী জ্বলছে?’-র উত্তরে আমাদের পৌঁছতে হবে বইকি। একান্ত জরুরি। হয়তো ওই অগ্নিকুণ্ডের কোনও একটায় নিজেদের বিবেক খুঁজে পাব আমরা। পাব, পচে যাওয়া মধ্যবিত্তের স্বার্থান্ধ ভূমিকা-কে। হয়তো কেন, নিশ্চিতই পাব। আমাদের ছবির অন্তিম খসড়ায় তাই এ-প্রশ্নও রাখা উচিত, তাকে কে জ্বালিয়েছে?
এর উত্তর ভয়াবহ, তবু তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক বলেই তা এড়িয়ে যাওয়া অপরাধ।