নিবন্ধ

সাম্প্রতিক কয়েকটি ধর্ষণ ও গুরুর মতাদর্শ 

মোহিত রণদীপ  Oct 16, 2020 at 5:42 am নিবন্ধ

নারীর ওপর নির্যাতনের, ধর্ষণের 'ঐতিহ্য' এ দেশে সেই সনাতন ধর্মের স্বর্ণযুগ থেকেই। পৌরাণিক নানা কাহিনিতে তার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। দেবরাজ ইন্দ্র থেকে শুরু করে অনেকের নামই ধর্ষকের তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই পরম্পরা বহমান। এমন কোনও শাসনকাল পাওয়া যাবে না, যখন এই যৌন অপরাধ ঘটেনি। 

সাতচল্লিশ-পরবর্তী ভারতেও নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের, ধর্ষণের অপরাধ ঘটে চলেছে নিরন্তর। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, ধর্ষণের কোনও ঘটনা ঘটলে রং নির্বিশেষে সব শাসকের তরফেই 'ছোট ঘটনা', 'বিক্ষিপ্ত ঘটনা', 'এমন কিছু ঘটেনি', 'মহিলার চরিত্র খারাপ'... এমন নানা কথায় অপরাধকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। প্রাথমিক তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই শাসকের মুখ থেকে ওপরের কথাগুলো বেরিয়ে আসে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। ভাবতাম, এটা কেন হয়? শাসক এই অপরাধ চাপা দিতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে কেন? তাহলে কি শাসক ধরেই নেয়, যে, ধর্ষক তার বৃত্তেরই কেউ হবে? সমর্থক কেউ হবে? এতটা নিশ্চিত কী করে হয়? ধর্ষণের সঙ্গে আসলে যৌনতার নয়, পৌরুষের সম্পর্ক, ক্ষমতার সম্পর্ক, শাসকের আচরণ এ কথাই বোধহয় বারবার বুঝিয়ে দেয় আমাদের! সম্ভবত সেই কারণেই শাসক ধর্ষণের ঘটনা এবং ধর্ষককে আড়াল করতে তৎপর হয়ে পড়ে! এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় সব যুগে, সব শাসকের মধ্যে সাধারণ প্রবণতা। 

আরও পড়ুন : প্রাতিষ্ঠানিক ডিপ স্ট্রাকচার ও এক ধর্ষণ

সাম্প্রতিক কালে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনায় কিছু বিশেষ প্রবণতা চোখে পড়ছে! সেই প্রবণতাগুলো তুলে ধরতে চাই এই ছোট্ট নিবন্ধের মাধ্যমে। 

প্রথমত, ধর্ষণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে দলিত এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের নিশানা করা। জম্মুর ছোট্ট মেয়ে আসিফা থেকে উত্তরপ্রদেশের উন্নাও-হাথরস, সর্বত্র এই প্রবণতা চোখে পড়ছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ষক উচ্চবর্ণের কেউ। উত্তরপ্রদেশে এই প্রবণতা খুব নতুন নয়। দলিত মেয়েদের ধর্ষণের পর মেরে ফেলার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। সাম্প্রতিক কালে 'আর্টিকল 15' নামের একটা সিনেমায় উত্তরপ্রদেশে উচ্চবর্ণের এই 'ঐতিহ্য' এবং দলিত মেয়ের 'ভবিতব্য' আমরা অনেকেই হয়তো দেখেছি। 

দ্বিতীয়ত, শাসক দল ধর্ষণের ঘটনা আড়াল করতে চায়, এ কথা শুরুতেই আমরা বলেছি। কিন্তু, আগে কখনও কোনও রাজনৈতিক দলকে ধর্ষকের পক্ষে মিছিল-মিটিং করতে দেখিনি। বিজেপি জমানায় আমরা দেখলাম ধর্ষকের পক্ষে মিছিল বেরোল জম্মুতে, উন্নাওয়ে। হাথরসে ধর্ষকদের সমর্থনে মিটিং হল। ভারতের ইতিহাসে ধর্ষকদের সপক্ষে এই মিটিং-মিছিল এর আগে কখনও আমরা দেখিনি। 

তৃতীয়ত, জম্মুতে সংখ্যালঘু পরিবারের নাবালিকা আসিফাকে মন্দিরে আটকে রেখে গণধর্ষণ চলেছিল। আসিফার ধর্ষকদের সপক্ষে যে মিছিল হয়েছিল তাতে মিছিলকারীদের হাতে ছিল ভারতের জাতীয় পতাকা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুকন্যাকে ধর্ষণের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ এবং দেশাত্মবোধের সংশ্লেষ এমনভাবে প্রকাশ্যে উঠে আসা ভাবনার বিষয়। 

চতুর্থত, হাথরসে ধর্ষণের ঘটনায় পেশাগত কারণে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করা হল, তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মোকদ্দমার উদ্যোগ নিল বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ সরকার। সংবাদমাধ্যম গণধর্ষণের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে সরকারের দ্বারা 'দেশদ্রোহ'-র অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে, এও এক নতুন অভিজ্ঞতা!

পঞ্চমত, জেলাশাসক নিজে গিয়ে ধর্ষিতার পরিবারের লোকজনকে শাসিয়ে আসছেন, এই অভিজ্ঞতাও আগে সেভাবে সামনে আসত না! এখন প্রশাসনিক আধিকারিকদের একটা অংশ আর কোনও আড়াল না-রেখে প্রকাশ্যেই শাসকের ইচ্ছানুযায়ী তাঁদের পেশার পক্ষে অবমাননাকর যে-কোনো পদক্ষেপও অনায়াসে নিচ্ছেন। 

ষষ্ঠত, হাথরসে ধর্ষিতার মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে না-দিয়ে রাতের অন্ধকারে দাহ করাও নতুন দেখলাম। 


সপ্তমত, ধর্ষণের ঘটনায় নাগরিক সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও কোথাও একটা বাছবিচার বড়ো উৎকট ভাবে চোখে পড়ে যায়! যখন ধর্ষিতা দলিত বা সংখ্যালঘু কিংবা গরিব ঘরের কেউ হন, তখন আমাদের প্রতিবাদ প্রায় চোখে পড়ে না! হাথরসের সেই মেয়ে গণধর্ষণ এবং নির্মম শারীরিক নির্যাতনের পর বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। খবরের কাগজে তা ভিতরের পৃষ্ঠায় খুব ছোট্ট একটা জায়গা পেয়েছিল। দেশের মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল তখন সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুরহস্য, তাঁর সঙ্গে কোন্ কোন্ অভিনেতা-অভিনেত্রী গাঁজা খান, তা নিয়ে প্রবল উদ্বেগের মধ্যে ছিল। হাথরসের মেয়েটি তখন ভেন্টিলেশনে ছিল। নাগরিক সমাজ, যাঁরা ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে উচ্চকিত হয়ে ওঠেন, তাঁরাও দলিত এবং মুসলমান কন্যার ধর্ষণে শীতঘুমে চলে যান। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ পথে নামেন, কিছু নেটিজেন সরব হন সামাজিক মাধ্যমে। 

এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা লক্ষ করলাম বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায়। এগুলোকে কি আমরা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা হিসাবে দেখব? ব্যতিক্রমী কিছু দিক হিসাবে দেখব? নাকি এখানে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক রয়েছে বলে ভাবব? 

ঠিক এই সময়েই আমরা অনেকেই দেখলাম, পড়লাম উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বক্তব্যে কিছু কথা বলেছেন, যেগুলো আমাদের অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করল। 

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে দলিত নারী সম্পর্কে যোগী আদিত্যনাথের মতামত :

"দলিত নারী ধর্ষণ করা পাপ নয়, কারণ তার শরীর অপবিত্র হলেও যোনি অপবিত্র নয়।" 

(২০০১/১/১৩, গোরক্ষনাথ মঠে বসে দেওয়া সাক্ষাৎকার, 'বর্তমান' পত্রিকায়  'সন্ন্যাসাশ্রম ও আদিত্যের মানব ভাবনা' শিরোনামে প্রকাশিত)। 

সামগ্রিকভাবে নারীদের সম্পর্কে যোগী আদিত্যনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে নির্বাচনী রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নেও। 

মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা তথা নারী সংরক্ষণ নিয়ে বিজেপি পশ্চিমি প্রভাবে নরম মনোভাব দেখাচ্ছে বলে রীতিমতো খোলা চিঠি দিয়ে সাংসদ পদ আর দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। তিনি সেই খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন, 'নারী আর পুরুষকে মোটেই সমান করে তৈরি করা হয়নি। মেয়েদের ঠাঁই হল রান্নাঘরে, পুরুষদের দেখাশুনা করার জন্য।' ২০১০ সালে যখন মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষণ বিলটি পাশ করার কথা ওঠে, তখন তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের শাস্ত্রে নারী স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি, নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। মেয়েদের সত্যি সত্যি স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। এতে ওরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে সমাজ ধ্বংস করবে।' 

আরও পড়ুন : সহজ আলাপে ইস্কুলে জেন্ডার : স্কুলস্তরে সামাজিক লিঙ্গ ও লিঙ্গ-বৈষম্য চর্চার এপিঠ-ওপিঠ

হিন্দু-মুসলমান প্রেম বিবাহের ক্ষেত্রে যোগী আদিত্যনাথের নিদান, 'কোনও হিন্দু মেয়েকে মুসলিম ছেলে বিয়ে করলে হিসেব করে সমস্ত হিন্দু ছেলেকে গুনে গুনে ১০০ মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করা উচিত।' মুসলিম নারী সম্পর্কে ২০১৪ সালে করা এই মন্তব্য আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাব না, 'কবর থেকে তুলে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করা হবে।'

এই ভাবনা শুধু যোগী আদিত্যনাথের মধ্যেই রয়েছে এমন নয়। গুজরাত দাঙ্গায়, মুজফ্ফরনগর দাঙ্গায় সংখ্যালঘু বহু নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরিকল্পিতভাবেই তাঁদের নিশানা করা হয়েছিল প্রতিপক্ষের ওপর মানসিক চাপ তৈরির উদ্দেশ্যে। আর, এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন বিজেপির মতাদর্শগত পুরোধাপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর। মুসলমান নারীদের ধর্ষণ না-করে বিজয়ী ছত্রপতি শিবাজি কেন এমনি এমনি ছেড়ে দিলেন, তা নিয়ে তাঁর লেখায় শিবাজিকে ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি সাভারকর। 

বিজেপি তাদের মতাদর্শের প্রতি যথেষ্ট নিষ্ঠাবান। তারা তাদের গুরু, মুসোলিনি এবং হিটলারের অনুরাগী সাভারকরের মতাদর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে।

দলিত এবং সংখ্যালঘু নারী আজ নিশানায়, কাল অন্যরা কি নিরাপদে থাকবে? নাগরিক সমাজ সরব হওয়ার ক্ষেত্রে বাছবিচার করলেও, ধর্ষক সেই রক্তের স্বাদ পাওয়া প্রাণী, যে একসময় কোনও বাছবিচার করবে না!  


ঋণ : প্রশান্ত রায় 



[পোস্টারের ছবি : অর্চিতা ভৌমিক। পোস্টার ডিজাইন : অর্পণ দাস] 


#নিবন্ধ #ধর্ষণ-কাণ্ড #Say No to Rape #ক্ষমতায়ন #নারী #নারীপক্ষ #লিঙ্গসাম্য #Gender Equality #Protest #Power Structure #যোগী আদিত্যনাথ #সাভারকর #আসিফা #উন্নাও #হাথরস #মনীষা বাল্মীকি #Asifa #Hathras #বিজেপি #লিঙ্গ-রাজনীতি #মোহিত রণদীপ #Silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

32

Unique Visitors

215001