ফিচার

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গোটা বিশ্বকে প্রেরণা যোগাচ্ছে বালিকাবধূ নুজুদ আলির আত্মকথা

অলর্ক বড়াল Oct 12, 2022 at 7:54 am ফিচার

নভেম্বর ২০০৮। মার্কিনি উইমেন্স ম্যাগাজিন ‘গ্ল্যামার’-র বার্ষিক সংখ্যা প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে শোরগোল পড়ে গেল। কারণ ‘উইমেন অফ দ্য ইয়ার’ -এর তালিকায় নির্বাচিত হয়েছেন সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেন-র বছর দশেকের একরত্তি এক মেয়ে।

হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। দশ বছর। 

যে বয়সে সাধারণত ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে বাচ্চারা হৈহৈ করে স্কুলে যায়, জীবনের পাঠ নিতে ঐ অল্পবয়সেই ছোট্ট মেয়েটির জীবনে ঘটে গেছে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা। প্রতিকূল জীবনপথে তাঁর অসামান্য লড়াইকে কুর্নিশ জানাতে ‘গ্ল্যামার’ পত্রিকায় বেছে নেওয়া হয়েছিল তাঁর ও তাঁর আইনজীবী শহ্‌দা নাসেরের নাম। 

দশ বছরের এক শিশুর নাম যখন আন্তর্জাতিক মানের কোনো পত্রিকায় স্থান পায়, তখন আমাদের মনে এক গতেবাঁধা প্রতিভাবান ‘ওয়ান্ডার কিড’-মার্কা একটা ছবি ফুটে ওঠে। কিন্তু নুজুদের কাহিনি সেরকম নয়। সে ইয়েমেনের মেয়ে। হ্যাঁ, মধ্য প্রাচ্যের সবথেকে গরীব দেশ ইয়েমেন, যেখানে গৃহযুদ্ধ, তালিবান, জঙ্গিহানাই রোজনামচা। সে দেশে মহিলারা নাগরিকের মর্যাদাটুকুও পান না। জন্ম, পুরুষের ভোগের পণ্য হয়ে সিস্টেমের জাঁতাকলে পিষতে থাকা, অবশেষে মৃত্যু – এই তাদের জীবনচক্র। ইয়েমেনের আইনমতে বাল্যবিবাহ বৈধ। ফলে বয়স আঠারো হওয়ার আগেই অধিকাংশ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায়। গরিব দেশে সংসারে খরচ কমানোর জন্য বিয়ের থেকে অব্যর্থ উপায় আর কি কিছু আছে? জনপ্রিয় ইয়েমেনি প্রবাদ বলে, কুমারী স্ত্রী পেতে চাইলে আট বছরের মেয়েকে বিয়ে করো। স্বভাবতই, সে দেশে শিশুদের বলপূর্বক বিয়ে দেওয়াটা নিতান্তই জলভাত।


২০০৮-এ যখন নুজুদের বয়স মাত্র ন-বছর তখন তার বাবা বছর তিরিশের ফায়েজ আলি থামেরের সঙ্গে নুজূদের বিয়ে পাকা করে বসেন। ষোলো ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারায় নুজূদের বাবা তো বেশ খুশি। নুজূদের মা, বড় দিদি প্রতিবাদের চেষ্টা করলেও তা বিশেষ কোনো ফল দেয়নি। বিয়ের প্রথম রাতেই সদ্যবিবাহিত স্বামী তার নববধূর ওপর স্বামীর অধিকার প্রয়োগে লিপ্ত হতে এলে নুজুদ প্রাণভয়ে পালায়, কিন্তু অচেনা শ্বশুরবাড়ির চার-দেওয়ালে আটকা পড়ে যেতে হয় তাকে। 

যে দেশে মেয়েদের প্রশ্ন করারই কোনো অধিকার নেই, সে দেশে নুজূদ বিয়ের প্রথম রাতেই তার স্বামীর কথার অমান্য করেছে। এর ফল তাকে ভোগ করতে হল পরদিন থেকেই। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি, আর রাত্রিবেলা স্বামীর অত্যাচার এবং ধর্ষণ। বছর দশেকের বউকে বশ মানানোর সব চেষ্টাই করলো ফয়েজ ও তার পরিবার। নুজুদ বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে চাইলে তার বাবা নিদান দেন, শ্বশুরঘর ছেড়ে চলে এলে নুজূদের ঠাঁই হবে না বাপের বাড়িতে। এই দম-বন্ধ করা জীবন থেকে অবশেষে মুক্তি এল ২রা এপ্রিল, ২০০৮ তারিখে। নুজুদের বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী-র পরামর্শে নুজূদ রুটি কিনতে বেরনোর অছিলায় পালিয়ে চলে এল কোর্টে, স্বামীর থেকে বিবাহবিচ্ছেদের দাবি নিয়ে। নুজুদের করুণ কাহিনি সেদিন নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা আদালতকে, বিচারক মোহাম্মদ আল-ঘাদা আইন বিপক্ষে জেনেও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ঐ ছোট্ট মেয়েটির, নিদান দিয়েছিলেন নুজুদের স্বামী ও বাবা দুজনকেই গ্রেপ্তার করার। 

ইয়েমেনে আইন অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের কোনও ন্যূনতম বয়স নেই, আর বিয়ের সময় পারিবারিকভাবে চুক্তি করা হত যে, এই অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে তাদের স্বামীরা যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পারবে না যতদিন না ঐ বালিকারা শারীরিকভাবে যৌনসংসর্গের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নুজূদের সামনে ছিল এক অসম লড়াই। সেই যুদ্ধে সে পাশে পেয়েছিল শহ্‌দা নাসের-কে। শহ্‌দা নিজেও আইনজীবী হিসেবে অনেক প্রতিকূল পথ অতিক্রম করে এসেছিলেন। তিনিই ইয়েমেনের প্রথম মহিলা আইনজ্ঞ। নুজুদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকেই লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হওয়ায় বিবাহের পূর্বে হওয়া চুক্তি লঙ্ঘিত হয়েছে – এই যুক্তিতে মামলা করে শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন নুজূদ-শহ্‌দা। বিচারকের প্রাথমিকভাবে দেওয়া পাঁচ বছরের ‘ইন্টেরিম ফ্রম ম্যারেজ’-র প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গিয়ে ডিভোর্স আদায় করতে পেরেছিলেন তাঁরা। ১৫ই এপ্রিল, ২০০৮-এ কোর্ট বিবাহবিচ্ছেদের রায় ঘোষণা করে এবং নুজূদের স্বামীকে তার প্রাক্তন স্ত্রীকে বিবাহের চুক্তিভঙ্গের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাসিক ২৫০ মার্কিন ডলার দেওয়ার আদেশ দেয়। নুজুদ হয় বিশ্বের কনিষ্ঠতম ডিভোর্সি।

মামলা জেতার পর নুজূদ ও তার পরিবার সানাহ্‌ শহরে চলে আসে এবং সেখানেই নুজূদের পড়াশোনা পুনরায় আরম্ভ হয়। ইতিমধ্যে ২০০৯-এ নুজূদ তার জীবনকাহিনি নিয়ে ফরাসি সাংবাদিক ডেলফিন মিনোউই-র সঙ্গে একটি বই লিখে ফেলেছেন নাম – “I am Nujood, Age 10 and Divorced”. এই বইয়ের আন্তর্জাতিক বিক্রয়ের লভ্যাংশ ও রয়্যালটির অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছিল নুজূদের পড়াশোনার খরচ চালানোয়। 

আরও পড়ুন : ফতোয়া, ফুটবল আর বাংলাদেশের মেয়েরা : এক সত্যি-রূপকথার গল্প / বিয়াস বসু

আজ প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে এসে নুজুদের জীবনকাহিনি স্মৃতিকথা ইয়েমেনে সামাজিক সমস্যা, জঙ্গিবাদ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহের মত কু-প্রথার বিরুদ্ধে কার্যকরী হয়ে উঠছে। বইটির প্রশংসা করে নিউইয়র্ক টাইমস-র নিকোলাস ক্রিস্তফ বলেছেন, “little girls like Nujood may prove more effective than missiles at defeating terrorists.” নুজূদের ঘটনায় প্রেরণা পেয়ে ২০০৯-এ সৌদি আরবের এক ৮ বছরের বালিকা বিবাহবিচ্ছেদে সফল হয়, যাকে তার বাবা এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন ১৩ হাজার ডলার মূল্যের বিনিময়ে। 

আরও পড়ুন : রুপোলি পর্দায় দীর্ঘ চুম্বন ঠাকুরবাড়ির মেয়ের : নিয়ম ভাঙার আরেক নাম দেবিকা রানি / শিরিন বসু

২০১৫-এ নুজূদ (অর্থ – ‘লুকোনো’) তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘নজূম’ (অর্থ – ‘আকাশের তারা’)। নুজুদের কাহিনি থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে-দেশে মানুষ মানবাধিকার, নারীকল্যাণ, শিক্ষা এবং সর্বোপরি শিশুসুরক্ষার বিষয়ে আরও তৎপর হয়ে উঠবেন এটুকুই কাম্য।  

................................. 

তথ্যসূত্র

Ali, Nujood. Delphine Minoui. Moi, Nojoud, 10 ans, Divrocée. Michel Lafon: Paris, 2009.

Ali Nujood. Delphine Minoui. I am Nujood, Age 10 and Divorced. Translated Linda Coverdale. Three Rivers Press: New York, 2010.

https://www.glamour.com/story/nujood-ali-and-shada-nasser

https://www.nytimes.com/2010/03/04/opinion/04kristof.html

চিত্রঋণ :

১. Glamour Magazine, USA 

২. National Geographic 

৩. Dimitrios Kambouris

#Nujood Ali #Yemen #movement against forced marriage and child marriage #I Am Nujood # Age 10 and Divorced #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219126