প্রলাপ (পঞ্চম কিস্তি)
[৯]
হন্তদন্ত হয়ে বাসস্টপের ছাউনিতে পৌঁছে হাঁপাতে থাকে দ্বিতীয়। বাসস্টপ বলতে বিশাল হাইওয়ের পাশে কবেকার তৈরি করা চারটে বসার জায়গা আর মাথায় ফ্যাকাশে অ্যাসবেস্টসের ছাদ। আলের পথ বেয়ে উঠে আসতে হয় এখানে। দূরপাল্লার বাসগুলো এক মুহূর্তের বেশি তিষ্ঠোয় না এখানে, তবু তারা ছাড়া ভরসাই বা কী। চারখানা সিমেন্টের সিট ভেঙে ভেঙে এখন একখানায় এসেছে। আর সেই একখানায় কিছুক্ষণ আগে এসে বসে আছে প্রথম। দু'জনেই ওরা বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের গন্তব্য এক না আলাদা তা জানি না, কিন্তু ওরা যে দুজন দুটো আলাদা বাসে উঠবে সেটা জানি। ওরাও জানে।
প্রথম মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস একটু আগে এসেছি, তাই বসতে পেলাম। আসলে সেই ভোর থেকে কাজের চাপে তার একদন্ডও বসা হয় না। দ্বিতীয় ভাবে, কাল রাতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল ঘুমোতে। তাই তো এরকম দেরি হয়ে গেল। সময়মতো পৌঁছতে পারলে হয়। প্রথম দ্বিতীয়কে দেখে ভাবে, খুব হাঁপাচ্ছে বেচারা! একটু কি উঠে দাঁড়াব? বসতে দেব? কিন্তু মিনিট খানেকের স্থির আরামের কথা ভেবে উঠিউঠি করেও ওঠা আর হয় না।
দ্বিতীয় ব্যাগ থেকে বোতল বের করে এক ঢোক জল খায়। তার চোখের আড়চাহনিতে প্রথমের ইতস্তত ভাবটি ধরা পড়ে। একটু বোকা বোকা মুখে হেসে ফেলে দ্বিতীয়। প্রথম সেই হাসি দেখে। অপরিচিত এক মানুষের এই অপ্রস্তুত হাসির ছবি মুগ্ধতা হয়ে ওকে ছুঁয়ে ফেলে।
"আমায় দেখে হাসল বুঝি?" শিরদাঁড়া বেয়ে একটা নদী নেমে গেল যেন! হঠাৎ অপরের মনোযোগের কারণ হিসেবে নিজেকে ভাবতে বড়ো মিষ্টি লাগে। সেই মিঠে মুহূর্তের রেশ বাঁচিয়ে রাখতে আলতো হাসি ফিরিয়ে দেয় সে।
প্রথমের এই হাসি দ্বিতীয়র কাছে পৌঁছায় সৌজন্য হয়ে। মাথা নেড়ে ঘড়ি দেখে সে। হঠাৎ কী মনে হয়, ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করে। নাহ! অমূল্যধন মেলে না। মোবাইলটা কানে ওঠে, “তপতী দি, আজ আমার একটা মিল রেখো তো। টিফিনটা ভুলে এসেছি।” প্রথম শুনে ভাবে, আহা রে! হয়ত খুব যত্ন করে আজ টিফিন গুছিয়ে দিয়েছিলেন ওর মা! দুধ সাদা ভাত, মোচার কোপ্তা, ডিমের ডালনা! বা হলুদ মিষ্টি পোলাও, কষামাংস আর জলপাইয়ের চাটনি। জলপাইয়ের চাটনি রাঁধতেন প্রথমের বড়োজেঠিমা। সে সেন অমৃত। সেই চাটনির স্বাদ দ্বিতীয় কোনদিনই পাবে না, এটা ভেবে বড্ড মন কেমন করে ওঠে। মনকেমনের চোখে ভালো করে একবার তাকানোর ইচ্ছে জাগে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কালচে বাদামি রঙের চুলগুলো আজ হয়ত ভালো করে আঁচড়ানো হয়নি। অজানা অচেনার চশমায় দ্বিতীয়কে বড়ো সুন্দর মনে হয়!
দ্বিতীয়র মনে তখন অন্য অশান্তি। বাসটা আজ আসতে একটু বেশিই দেরি করছে। আগের বাসটা পেয়ে গেলে চিন্তা ছিল না। ঠিক সময় পৌঁছে আবার ঠিক সময় বেরিয়ে আসা যেত। ঘুমটাই কাল! কত দেরি হয়ে গেল! আচ্ছা, পরের বাসটাও বেরিয়ে যায়নি তো! তাহলে তো সর্বনাশ! প্রথমকে একবার জিজ্ঞেস করা যাক। সে তো একটু আগেই নিশ্চয়ই এসেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নাতুর চোখে প্রথমের দিকে তাকায় বাসের খবর জানতে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে মূর্তি হয়ে যায় প্রথম। বুকে ঢিপঢিপ শব্দ ওঠে। পরমুহূর্তেই অবশ্য তার বুক ঢিপঢিপানির আওয়াজকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বেজে ওঠে বাসের কর্কশ নিরস হর্ন। দ্বিতীয়র বাস।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় না। বাসটা ১০ সেকেন্ড দাঁড়াবে বড়োজোর। তাড়াতাড়ি উঠে স্বস্তি পায় দ্বিতীয়। আজ ঠিক সময়েই ফেরার বাসটা ধরা যাবে। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, কাল থেকে ঘুমের ফাঁদে পা না দিয়ে যেভাবেই হোক আগের বাসটা ধরতে হবে।
প্রথমের বাসও চলে আসে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই। সে-ও বাসে উঠে পড়ে। তারপর ভাবে, কী যেন বলতে চাইছিল!
কালও যদি আজকের মত একটু দেরিতে বাড়ি থেকে বেরোনো যায় তাহলে ঠিক কথাটা শোনা হয়ে যাবে। হাতের ঘড়িতে সময়টা মিলিয়ে নিয়ে প্রথম এবার বাসের রডটা শক্ত হাতে চেপে ধরে।
...............
[১০]
পায়ে পায়ে মাটির তলার রাস্তাটা পেরিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি। তারপরেই স্টেশনের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়। পর পর প্ল্যাটফর্ম। কোনোটার সামনে লাইনে ট্রেন দাঁড়িয়ে। কোনোটা ফাঁকা। আর কোনোটাকে ফাঁকা করে দিচ্ছে ধীর গতিবেগে যাত্রায় বেরিয়ে পড়া রেলগাড়ি। এক-একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেব করলেই বোধহয় হাজারখানেক মানুষ পাওয়া যাবে। তাহলে গোটা স্টেশনে লাখের উপর মানুষ তো নিশ্চয়ই আছে। এত এত মানুষ রোজ রেলগাড়িতে চাপে? এসব জায়গায় এলে নিজের সমস্যা, নিজের জীবনটা তুচ্ছ তুচ্ছ লাগে। এত এত লোক সবাই কোনও না কোনও কাজে বেরিয়েছে। সবার জীবনেই কিছু না কিছু লড়াই আছে। কতশত জলজ্যান্ত গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেশনময়। একে অপরের পাশ দিয়ে, গায়ে গা ঠেকিয়ে, পায়ের তালে তাল মিলিয়ে চলছে সবাই। কেউ যাচ্ছে, কেউ বা আসছে। এই আসা-যাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনটা। দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সেতু হয়ে। ছেলে-বুড়ো-লম্বা-বেঁটে-রোগ-মোটা-ফর্সা-কালো-ছোটো-বড়ো সবরকমের মানুষ এখানে ছুটতে আসে। কত জায়গা আছে যেখানে যেতে হবে। কত সময় বলে রাখা আছে, সেখানে পৌঁছাতে হবে। সকলের গন্তব্য মোটের উপর আলাদাই। ক্ষণিকের জন্য শুধু যাত্রাপথটুকু মিলে যায় ।
সময়ের কাঁটা ঘুরতে থাকে। স্টেশনের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে একের পর এক রেলগাড়ি। মানুষমাত্রেই ছোটো থেকে এই বাহনটির প্রতি অপার আকর্ষণ। বড়ো বয়সে এসেও সেই ভালোলাগা থেকে যায়। রেলগাড়ির নাম শুনলেই বুকের ভিতরটা কেমন নেচে ওঠে। চোখ বুজলেই কানে ভোঁ বাজে। মনের ভিতরে কেমন মায়ার আঠায় মাখা একটা আদ্যিকালের জিনিস হয়ে দাঁড়ায় রেলগাড়ি। আচ্ছা, যারা রোজ রোজ জীবন জীবিকার তাগিদে রেলগাড়িতে চড়ে তাদের কি এই ভালোলাগাটা জিইয়ে থাকে? নাকি দৈনন্দিনের আর পাঁচটার মতোই হয়ে দাঁড়ায় এটাও? যেখানে আলাদা কোনও আকর্ষণ থাকে না, আলাদা কোনও চাওয়া পাওয়া থাকে না। যদিও কঠিন নীরস প্রয়োজনের ফাঁকফোকরেও একদম যে চাওয়া-পাওয়ার মিঠে হাওয়া বয় না, তাই বা বলি কেমন করে! একটু সময়মতো যেন গন্তব্যে পৌঁছানো যায় - সেই চাওয়াটুকু আছে। একটু বসার সিট যাতে পাওয়া যায়, কিংবা বসার সিটটা যাতে জানলার ধারে মেলে - সেই চাওয়াটুকু আছে। আর বাদবাকি সবটাই তো পাওয়া। এসব থেকে যদিও স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করা যায় না আকর্ষণ থাকা-না থাকার বিষয়টা নিয়ে। মনে হয় খুব বেশি থাকে না। যারা মাঝেমধ্যে ট্রেনে চাপে, তারা বোধকরি একটু বেশিই স্পর্শকাতর। আসলে তাদের আকর্ষণ, ভালোলাগার মধ্যে তো হুট্ করে পেয়ে বসা বিলাসিতা আছে। আর নিত্যদিনের মানুষগুলোর আছে অনাড়ম্বরতা। ফলে ফারাক তো থাকবেই।
আবার অনেকসময় সেই ফারাকটুকুও থাকে না কিন্তু। এই একটা লোক কাচ্চাবাচ্চা, পরিবার আর পাঁচ-ছটা বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে মাঝেমধ্যে যখন ট্রেনে চাপে - আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার মোটেই রেলগাড়ির প্রতি কোনও কবিসুলভ রোমান্টিকতা জেগে ওঠে না। রেলগাড়িতে ওঠার আগে মনে হতে থাকে, “উঠলে বাঁচি।” আর ওঠার পর মালপত্র ও মানুষ ঠেলেঠুলে ঠেসেঠুসে জায়গা করার পর মনে হতে থাকে, “নামলে বাঁচি।”
বললাম বটে, তবে এতটাই কি সরলরৈখিক সবকিছু? যাত্রাপথে একবারও কি তার তীব্র গতিতে ছুটে চলা ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ যায় না? বাইরেটা দেখে মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট “আহা”-ও কি বেরোয় না? বেরোয় নিশ্চয়ই। এক দু'বার হয়তো গুনগুনও করে ওঠে বেসুরো গলাটা। পরিবারের প্রিয় সদস্যকে ডেকে একটিবার নিশ্চয়ই আঙুল তুলে দেখান হুই দূরের তালগাছের সারি। ব্রিজের উপর দিয়ে যখন গাড়িটা যায়, ছোটোগুলোকে নিশ্চয়ই ডেকে আনেন জানলার ধারটিতে। তাদের আনন্দে একবারের জন্য হলেও রেলগাড়ির প্রতি মমত্বে মনটা ছেয়ে যায়।
নিত্যদিনের যাত্রীদের সকলেরই যে একঘেয়েমি চলে আসে এ কথা একেবারে ঠিক নয়। রোজ রোজ লেডিস কামরায় করে কলেজ যায় একটা মেয়ে। ট্রেনে উঠেই দরজার ঠিক পাশটিতে জায়গা করে নেয়। ট্রেনের উনপঞ্চাশ হাওয়া চুল এলোমেলো করে দেয় নিয়মিত। ট্রেনের পাশ দিয়ে একই গাছপালা, একই সরু গলি, একই স্টেশনেরা চলে যায়। প্রতিদিন দেখে দেখেও মায়া কাটে না তার। একদিন হঠাৎ খেয়াল করে, আজ সেই স্টেশনের পাশে লাল-হলুদ বাড়িটার ছাদে জামাকাপড় ঝুলছিল না তো! আবার কোনোদিন কোনও একটা আগাছার অপূর্ব বুনোফুল দেখে হয়ত আহ্লাদিত হয়ে ওঠে মন। ট্রেন যদি অকারণে দাঁড়ায় কোথাও, ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশে। মেয়েটার ঠিক পাশেই তিনখানা ঝুড়ি আর একখানা মোট কাঁধে এক বাজারের মাসি বসে থাকে। কোনো জায়গায় দু'মিনিটের জায়গায় তিন মিনিট দেরি হলে মাসির সহ্য হয় না। কারণ ওই দু'চার মিনিটের তফাতে বাজারের ভালো জায়গাটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
আবার যখন বাৎসরিক বেরোনোর কোটায় রেলগাড়িতে চাপে কোনও পরিবার বা বন্ধুদল, তাদের সর্বগ্রাসী মুগ্ধতা শেষ হতেই চায় না। একমাত্র বাথরুমের পাশে সিট পড়া ছাড়া আর কোনও কিছুতেই তাদের বিরক্তি আসে না। আসলে অভিজ্ঞতাটা যেহেতু বছর ঘুরলে তবেই ফিরে আসে, তাই আহ্লাদের আস্বাদ ফিকে হয়ে যায় না। আসলে গন্তব্যে কার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে সেটাই আসল। তাই তো বেড়াতে যাওয়া দলের আকর্ষণ ফিরতি পথে সামান্য কমে। উপর-নিচের বার্থ নিয়েও তখন কথা কাটাকাটি হয়ে যেতে পারে। ওদিকে বাজারফেরতা নিত্যযাত্রী মাসির বরং উল্টোপথেই উৎসাহ খানিক বেড়ে যায়। হাতে পয়সা নিয়ে বাসায় ফেরার সময় অদ্ভুত স্বপ্নালু মায়া তাকে ঘিরে থাকে।
এইসব কারণেই তো স্টেশনে এলে, ট্রেনে চাপলে নিজেকে কখনও রাজার মতো মনে হয়। গতিময় জানলার বাইরের সবটাই অপার্থিব রূপে ধরা দেয়। আবার অন্যদিকে বড়ো তুচ্ছ মনে হয় নিজেকে। মনে হয়, গোটা পৃথিবীর এককুচি ধূলিকণারও কি যোগ্য আমি? এত মানুষ। এত মানুষের এত চলাচল। এত এত অনুভূতি। আমার দুঃখটাকে মনে হয় যেন বিলাসিতা। আনন্দটাকে মনে হয় নিতান্তই ফালতু। ফাঁকা লাইনগুলোকে দেখলেও অনন্তের অনুভূতি জন্মায়। চলেছে তো চলছেই। যদিও আদতে একটা বৃত্তেই তো আবদ্ধ। এই মনে হয় গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। পরমুহূর্তেই নতুন গন্তব্য লেখা হয়ে যায়। কিন্তু সেই সত্যিটা তো তেমন তীব্র নয়। তার থেকে অনেক বেশি সত্যি বাজারের মাসির ঘরে ফেরার আরাম। ট্রেনটা যখন ব্রিজের উপর দিয়ে যায়, সেই আওয়াজ। প্রথম বিস্ময়ের আনন্দে ছোট্ট ছানার বাবা-মায়ের শক্ত করে ধরে রাখা হাত। বিকলাঙ্গ মানুষটার দু-মুঠো ভাতের জন্য গান। এই সত্যিগুলোর তীব্রতা এতটাই যে, বৃত্তের বাঁধন ধোপে টেকে না। তাই মুগ্ধতাও কাটে না। ঝমঝম করে চলতেই থাকে। ইতস্তত গতিবেগে চলে। থমকে থমকে চলে। দুরন্ত গতিবেগে চলে। আবার ধিকি ধিকি হয়ে যায় গতি। কিন্তু চলে। চলতেই থাকে।
[চলবে]
.................................
...........................
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র