প্রলাপ (দ্বিতীয় কিস্তি)
[৩]
নাটক করতে পারব না, তাই দরজায় খিল দিয়ে রেখেছি। সেই গেল বার হাজার শরীরের অসুবিধা জেনেও যে দাদা হেমন্তের সন্ধ্যায় জোর করে মেলায় নাগরদোলা চড়িয়েছিল; আর যাই হোক তাকে হাসিমুখে প্লেটে করে দুটো সিঙাড়া, একটা রসগোল্লা আর একটা পান্তুয়া সাজিয়ে দিতে পারব না। তাই দরজা বন্ধ রাখি সবসময়।
ঐ যে বন্ধু যে সব জানত, জানত তার সমান খাটনি খেটেও মাস গেলে আমি কটা টাকা কম পাই আমার জমকালো সালোয়ার কামিজ নেই বলে - তাকে একগাল হেসে গলায় জড়িয়ে নিতে পারব না, তাই দরজায় ছিটকিনি দিয়েছি।
পাড়াতুতো বৌদি, যাকে বিশ্বাস করে গোপন কথা জানিয়েছিলাম, আর তারপর পাড়াময় পোস্টার পড়েছিল - সে আমার গালে ঠোনা মারলে নকল হাসি হাসতে পারব না। তাই টেনে দরজা আটকেছি।
তাকে কেন ঘরে ঢুকিয়ে, সোফায় বসিয়ে হো হো করে শরীর নাচিয়ে হাসতে দেব যে আমার গোড়ালির গহ্বর নিয়ে, গালের মেচেতার দাগ নিয়ে খিলখিল করেছে ভরা সভায়? তাই দরজা এঁটে দিয়েছি। নাটক করতে পারব না বলে।
দরজা খুলব। সেই বুড়ো দাদুটার জন্য খুলব যে বুড়ির চুল বিক্রি করতে আসত আর ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে 'মা' বলে ডাকত। তার জন্য দরজা খুলব, তার সঙ্গে গল্প করব।
দরজা খুলে দেব মুদির দোকানের সেই ছেলেটাকে, যে ফর্দ মিলিয়ে ব্যাগে মালপত্র তুলতে তুলতে সাবধানী হাতে একটা হজমির ঠোঙা পুরে দিতে মালিকের চোখ বাঁচিয়ে। ও এলে একটুও নাটক করতে হবে না, ওকে আসতে দেব।
দরজা খুলব দূরসম্পর্কের সেই ছোটো বোনটার জন্য, বিয়েবাড়ির তেরপলে মোড়া ছাদের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারারাত গল্প করেছিলাম যার সঙ্গে। কার বিয়ে মনে নেই, শুধু সেই রাতের গল্পের মায়াটুকুই মনে আছে। সেইটুকুর জন্যই তো দরজা খুলতে মন চায়। নাটক করতে হয় না।
দরজা খুলতে বেশি কিছু লাগে না। অল্প মায়া, আঁজলাটুকু ভরার মতো স্নেহ। বন্ধ করতেও বেশি কিছু লাগে না। শুধু একটু অপচয়, আর কিচ্ছু না।
….……………..
[৪]
বাসে উঠে থেকেই ঝিমুনি আসে একটা। অনেক রাত অবধি কাজ করে তারপর ঘুম। এদিকে উঠতে বেশি বেলাও করা যাবে না। অফিস পৌঁছতে হবে। অল্পস্বল্প মাইনে দিলেও সময়-শৃঙ্খলার কড়াকড়ি আছে। টেনেটুনে উঠে পড়তেই হয়। সে বিছানা যতই পরম মায়ায় আঁকড়ে ধরে থাকুক না কেন। তারপর উঠে পড়লেই তো আর হল না। প্রাতঃকর্ম আছে, প্রাতরাশ আছে। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সকলেরই সংসারের কিছু কাজ আছে। সারাদিনের নামে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার আগে টুকটাক গুছিয়ে রাখা আছে। আসলে দিনশেষে ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষ ফিরে আসে। সেই সময়ের দুটো কাজ যদি একটু এগোনো থাকে, থাক না। সেসব সেরে বেরোতে হয় একটু সময় হাতে নিয়েই। বেশিরভাগ দিনই কাকস্নান হয়ে যায়। টিফিনও তো ভরে নিতে হবে মনে করে। রোজ রোজ আলগা টাকা খরচ করার মত আয় নেই মোটেও। অফিসের মাইনেতে কুলায় না বলেই তো রাত জেগে অতিরিক্ত উপার্জনের চেষ্টা। এতে মাসের শেষে জমে কিছু। হঠাৎ করে প্রয়োজনের সময় যাতে মাঝসমুদ্রে ভরাডুবি না হয়। কখনও কখনও তার পরেও সবটা যথেষ্ট বলে হয় না। আরও অল্পস্বল্প জুটলে স্বস্তি পাওয়া যেত হয়তো। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা সময় থাকতে আসেনি। আর এখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। অনেকেই বলে বয়সটা কোনো বিষয়ই নয়। কে জানে তাদের ভিতরটা কেমন ছাঁচে তৈরি। এদিকে তো একেক দিন নিজেকে বড্ড বুড়োটে লাগে। গা-হাত-পায়ের ব্যাথাও সেই কথায় সম্মতি জানায়। তাই যেমন চলছে চলতে থাকে। ছাপোষা, মধ্যবিত্ত যাপন। সুখ না থাকলেও স্বস্তি আছে। শান্তি হয়তো নেই, তবে অশান্তির দেখাও তেমন মেলে না। রুটিনমাফিক দিন গুজরান। কস্মিনকালে একটু আধটু শিল্পচর্চা। এর বেশি চাহিদাও নেই। চলছে চলবে। হুট করে একটা কিছু চেয়ে বসাই যায়। কিন্তু তাতে যদি লয়টা কেটে যায়? তখন ঠেকনা দেবে কে? তার চেয়ে এই তো ভালো। রোজকার মেপে মেপে চলা। তার থেকে যদি অসাবধানে দু-এক কুচি বাইরে পড়ে - সেটুকুই বাড়তি পাওনা। 'আচ্ছা যা হোক'-দিন গুজরানের নিত্য অভ্যাস এই বাসযাত্রা। অফিসটাইমের কাঁটার সঙ্গে মোটামুটি মিল রেখেই পথটুকু পেরোনো।
প্রতিদিন ডিপো থেকে ওঠা হয় বলে জানলার ধারের সিট মেলে পাক্কা। চলতে আরম্ভ করলেই উসখুসানি বোধ হয়। চট করে টিকিট কেটে নেওয়ার তাড়া। টিকিটটা কাটা হয়ে গেলে নিশ্চিন্তি। অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। জানলার হাওয়া চোখে লাগতেই যেন পাতাগুলোয় শক্তিশালী আঠা লেপে দেয় কেউ। বহু যতনে, বহু চেষ্টায় টিকিটটুকু কেটে ফেলা পর্যন্ত জেগে থাকার দায়। সেটুকু হয়ে গেলেই চোখটা বুজে আসে। শরীরময় প্রশান্তি। নামার আগে পর্যন্ত আর কোনও বিপত্তি নেই। যাতায়াতপথের এই ঘুমটুকু পাওয়া যায় বলেই না শরীর এখনও চলছে! কী আরাম! বড়ো অদ্ভুত আবেশ নিয়ে আসে ঘুমটা। স্টপেজের পর স্টপেজে পেরিয়ে যায়। কন্ডাক্টার হাঁকডাক করে। পাশ দিয়ে বেশ জোরেই হর্ন দিয়ে পেরিয়ে যায় অন্যান্য গাড়ি। কিন্তু সেসব আওয়াজ যেন ধনুক ভাঙা পণে কানের আশপাশ দিয়েও যাতায়াত করতে চায় না। এই ঘুমটুকুর মত আপন আর কেউ নয়। স্বজনের আহ্লাদ মিলেমিশে থাকে এর মধ্যে। ফেরার পথে কোনওদিন বসার সিট মেলে, কোনওদিন মেলে না। এই সময়টুকুই পরম যত্নে আঁচল পেতে দেয়। শুধু যে আরামের বাঁধনে বেঁধে রাখে তা নয়, চোখ জুড়োলেই অবচেতনের ডালি হাট করে খুলে যায়। হাজার হাজার রঙিন স্বপ্ন বন্ধ চোখের পাতায় খেলে বেড়ায়। সবসময়ই যে সুখের বিন্দুতে স্বপ্নের নৌকা বাঁধা হয় তা নয়, দুঃখের পারাবারেও তার আসা-যাওয়া থাকে বৈকি।
স্বপ্নের রকমফের হয়। পুরোনো স্মৃতি থেকে শুরু করে চরম আজগুবি - সবটাই ঘুরে ফিরে জায়গা করে নেয়। তবে কিছু ছায়াছবি বারবার ফিরে ফিরে আসে। সেগুলোকে অবদমিত মনস্কামনা বলে চিনে নেওয়া কঠিন হয় না। তাদের সত্যি করতে যে একেবারে মন চায় না তা-ও নয়। কিন্তু সামর্থ্যে কুলোয় না। স্বপ্নের রেলগাড়িটা একেক দিন শুরু হয় বাড়ির সিমেন্টের চৌকাঠটা থেকেই। রোজকার মত চৌকাঠে মোটেই হোঁচট খেতে হয় না। বেশবাস পাট পাট। কাঁধে রংচটা শান্তিনিকেতনি ঝোলাটা থাকে না। থাকে ছোটোমেসোর উপহার দেওয়া ঝকঝকে চামড়ার ব্যাগটা। রোজকার মত হাঁটার বেগ তেমন তীব্র হয় না। ধীর অপেক্ষার লয়ে পা পড়ে। এমন সময় মাখনের মত মসৃণ কায়দায় ঠিক পাশটিতে এসে দাঁড়ায় বিরাট একটি গাড়ি। দরজা খুলে যায় হাট করে। সামান্য ঝুঁকে দেখে নিতে হয় ভিতরে বসে থাকা মানুষটিকে। একগাল নরম হাসি। ইতস্তত করার কোনো অবকাশ হয় না। উঠে পড়ে দরজা টেনে বন্ধ করে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটায় তৈরি হয় এক অন্য জগৎ। একে অপরকে কবিতা পড়ে শোনানোর নিয়ম আছে এখানে। গাড়ির ভিতরের সময়টুকু দিনবিশেষে বদলে যায়। কোনওদিন কবিতার দুটো তিনটে কলি হৃদয়যাতনা বাড়িয়ে দেয়। তখন গাড়ির ভিতরটা এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে শ্বাস টানে। তারপর হঠাৎ করে ভীষণ গতিবেগে ছুতে চলে মাইলের পর মাইল। কেউ কোনও কথা বলে না। গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অশান্ত হয়ে পড়ে বুকের ধুকপুকুনি। আর সেই দিনগুলোয় স্বপ্নটা খাপছাড়াভাবে ঐখানেই শেষ হয়ে গিয়ে অন্য গল্পে ঢুকে পড়ে। কিন্তু যেদিন আনন্দঘন কোনও কবিতা উচ্চারিত হয় - সেদিন ফুস করে নিভে যায় গাড়ির আলোটা। লালচে মাটির সরু পথের ধারে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে কালো পিচের রাস্তার উপর। তারপর সেই লালরঙা পথ বেয়ে শুরু হয় হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে পথের ধারে ঘুরেফিরে আসতে থাকে জীবনের নানা ঘটনা, নানা মানুষ। কিছুই না, শুধু একটু থমকে চেয়ে থাকা। যে কথা জীবনে বলা হয়নি, অকপটে বলে ফেলা সেসব কথা। এখানে মাঝেমধ্যে খটকা লাগে। মনে হয় আদৌ কি ঘুমিয়ে, না ঘুমানোর ভান চলছে? প্রশ্ন করামাত্র মনটা একটু জাগবে-জাগবে করে, কিন্তু স্বপ্নের জাল আবার তাকে জড়িয়ে নিয়ে পিছনপানে ফেরে। তারপর আবার কত কত হেঁটে ফেলা। এই অবধি মিলেমিশে যায়।
কিন্তু স্বপ্নের শেষটুকু বরাবর একই জায়গায় নিয়ে আসে। একটা ছোট মেলার মাঠে। এই মেলার মাঠটা খুব চেনা লাগলেও ঠিক কোথাকার, কবেকার সেটা আর মনে আসে না। মাঠটাকে গোল করে ঘিরে দোকানগুলো বসেছে। ঠিক মধ্যিখানে একটা নাগরদোলা। সবকটা দোকানেই মোটামুটি ঘোরাঘুরি হয়। শুধুমাত্র একটা দোকানের ছবি কিছুতেই স্পষ্ট হয় না। খুব যেন ভিড়ের মতো জমে থাকে সামনেটায়। দোকানি তবুও হাঁকডাক করেই চলে। বারবার উঁকিঝুঁকি মেরেও আবছা ছবিটা কিছুতেই আর স্পষ্ট হয় না। মাথাটা যেন বড্ড ভারী লাগে। ভার কমাতে মন চায় নাগরদোলায় উঠতে। তারপর ঢিক ঢিক করে চাকাটা ঘোরে। শীতল হাওয়া সারা শরীরে স্বস্তি আনে। দুলুনি থামে না। ওঠানামা চলতেই থাকে। একেবারে উঁচুতে যখন পৌঁছয়, কত দূরের দিগন্তরেখাটি দেখা যায়। এতটা পথ হাঁটার ক্লান্তিতে নাগরদোলার উপর বসেও ঘুম পায় যেন নতুন করে। কিন্তু ঘুম আর আসে না। কারণ হঠাৎ বিনা নোটিশে সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন জেগে ওঠে। এতক্ষণ কোনও শব্দ যে কানে এতটুকু আন্দোলন করেনি, নিজের স্টপেজের নামটা সেখানে শব্দভেদী বাণের মত চরম তীব্রতায় প্রবেশ করে। সমস্ত কথা, গল্প, রাস্তা, মেলার মাঠ, সেই রহস্যময় দোকান এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। বাসের হর্ন, কন্ডাক্টারের কর্কশ চিৎকার, আরও আরও যানবাহনের আওয়াজ এতক্ষন পরে আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। আরও একবার নেমে পড়তে হয়। এখানেও হাঁটাপথ কিছুটা। কিন্তু এই পথের শেষে মেলার মাঠ নেই। আছে শুকনো খটখটে দিন। কী করে যে এমনটা হয়, সত্যিই নিজেরও বড়ো আশ্চর্য লাগে। সারাটা রাস্তায় একবারের জন্যও তন্দ্রা কাটে না। খুব জোর ঝাঁকুনিতে হয়তো বা একটু পাতলা হয়। অথচ কী ভাবে যেন গন্তব্যের কাছাকাছি এলেই কোনওরকম প্ররোচনা ছাড়াই চোখের পাতা আলগা হয়ে যায়। রুজির আকর্ষণ কি তাহলে এতটাই অমোঘ? স্বপ্নের অলীক নিরাপত্তা থেকে বড়ো সহজেই সে নিয়ে আসতে পারে জীবনের বাস্তব নিরাপত্তাহীনতায়। প্রতিদিন এই সত্যিটাও আরেকবার করে জানা হয়ে যায়। যদিও এই জানা বা না-জানায় খুব কিছু ফারাক তৈরি হয় না। আপাতত মাঝে গোটা একটা দিন। তারপর মুহূর্তের স্বপ্নযাপন। আবার ঠিক সময়ে বাস্তবের মাটিতে পদার্পণ। এই চলছে। এই চলুক। যতই হাতছানি দিক নাগরদোলা, 'যেমন আছে তেমন'-এর নিশ্চয়তা ছেড়ে বেরিয়ে পড়া অতটাও সহজ নয়। তার চেয়ে বরং আজ কাজের মাঝে অবচেতনে সেই দোকানটায় কী থাকতে পারে এই ভেবে কাটানো যাক। তাহলে কাল হয়তো সামনের ভিড়টা মিলিয়ে যাবে। রুটিন-স্বপ্নে সংযোজন হবে নতুনের। তার থেকে হয়ত জন্ম নেবে অন্যতর এক আখ্যান। এইটুকুই। ব্যাস। আর কিছুই না। আর এতটুকুও না।
পড়ুন আগের পর্ব : প্রলাপ (প্রথম কিস্তি) / প্রজ্ঞা দেবনাথ
.....................
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #প্রলাপ #গদ্য #মুক্তগদ্য #প্রজ্ঞা দেবনাথ #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র