গল্প

সই

বিবস্বান দত্ত Jan 3, 2021 at 5:58 am গল্প


আজ যখন সন্ধে নামছে, ঠিক তখনই খুব দূরে চলে ইচ্ছে করল মেঘের। এইরকম মাঝে মাঝে হয়। যখন তুলির সঙ্গে আলাপ হয়নি, তখনও হত। এখনও হয়। আসলে কোনও মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়ার মানে বার বার নিজেকে অন্যের আয়নায় দেখা।

মেঘ বসু। একসময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র। তুখোড়, কারণ সেই সময় সবাই ওকে তুখোড় ভাবত। ক্লাসে প্রোফেসরদের থেকে বেশি কথা শোনা যেত ওর। জীবনানন্দ থেকে জয় গোস্বামী, বোদলেয়র থেকে কাব্বানি, বিদ্যাপতি অথবা বুকাউস্কি... ওর ঠোঁটের ডগায় ঘুরে বেড়াত।  এত কবিতা কোনও মানুষের মনে থাকে? আলো খুব অবাক হয়ে মাঝেমাঝেই বলত। আলো, ওর প্রেমিকা। সরি, প্রাক্তন প্রেমিকা। বিস্ময় শব্দটার আয়ু পৃথিবীতে সব থেকে কম। আর শুধু কবিতায় বিস্মিত হতে পারার মত মানুষও, কমই। মানুষের ঝোঁক স্বভাবতই বাস্তবের দিকে। শব্দ খুব মিথ্যে কথা বলে। কবিতাও। 

মেঘ তা ভাবত না। শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, সত্যি কথা বলা ছাড়া কোনও কাজ নেই কবিতার। উনি মিথ্যে বলেন না। মেঘ তাই ভাবত। এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একইরকম ভাবে না। 

প্রেম ভেঙে যাওয়া, আসলে মেঘ ভেঙে যাওয়ার মতো বড়ো কোনও ঘটনা নয়। মেঘ ভাঙলে অনেক মানুষ ভেজে। প্রেম ভাঙলে সাধারণত দুজন, অথবা একজন, অথবা, কেউই না। আলো যখন চলে গেল, আমাদের মেঘ ভেঙে পড়েনি। অনেকটা এলোমেলো হয়ে গেছিল। আর কে না জানে, এলোমেলো মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় না।

যাদবপুরের পাঁচবছর খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আরও তাড়াতাড়ি লোকজন এটা বুঝে ফেলল, মেঘ আসলে খুব ভালো ছাত্র নয়। ভালো ছাত্র হলে এতদিনে কিছু জোটাতে পারত না? এমনকি নেটটাও ক্লিয়ার করতে পারেনি! ওর না স্বপ্ন ছিল, ও গবেষক হবে! পালিশ করলে তো প্লাইউডকেও সেগুন কাঠের মতো লাগে। তাই না? 

বন্ধুরাও ব্যস্ত, যে যার মতো। বই, আর খবরের কাগজের টুকটাক লেখালেখি। মেঘের জীবন ওর এক চিলতে ঘরটার থেকেও ছোটো। এই মেঘের ঘর তো আর আকাশ নয়, যেখানে বৃষ্টি হলে পুরো শহর ভিজে যাবে।

এমন সময়েই মেঘের সঙ্গে তুলির আলাপ। তুলি, মেঘের থেকে অন্তত পাঁচ বছরের বড়ো। জে. এন. ইয়ুতে গবেষণা করছে। তুলির বিয়ে প্রায় ঠিক। ওর প্রেমিক, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। 

আলাপ হয়েছিল ফেসবুকে। তুলি মেসেজ করেছিল, আপনার দেওয়ালে এত কবিতা দেখি, যে শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বের আবেদনটা পাঠিয়েই ফেললাম। গ্রহণ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। 

গ্রহণ করা কি এত সহজ ম্যাডাম? আর আবেদন, অনুরোধ শব্দদুটো এক নয়। লোকে তো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টই বলে।

আপনি কী বলেন?

আহ্বান। আপনি কি বন্ধুদের আপনি বলেই বলেন?

এইভাবেই শুরু। যেমন হয়। কয়েকদিন কথা। তারপর হাজার সবুজ আলোর ভিড়ে কোনও বিশেষ নামের পাশে সবুজ আলোর জন্য অপেক্ষা, নিভে আসে।

মেঘ তুলির ব্যাপারটা সেইরকম হয়নি। কথা বাড়ছিল। যেমন বন্যায় জল বাড়ে। বাড়তে বাড়তে প্রথমে রাস্তা ঢেকে দেয়। তারপর মানুষকে।

অনেক কথা বললে, মানুষ কিছুটা কাছে চলেই আসে। কিছুটা। মানে, দুজন মানুষ মেসেঞ্জারে যতটা কাছে কাছে আসতে পারে। মেঘ জেনে গেল, তুলি অনেকটা ওর মতো। আর তুলিও, জানল, বেশ কিছু বছর পরে জন্মানো ছেলেটা অনেকটাই ওর মতোই। ওদের কথা গড়িয়ে পড়ত, সকাল থেকে বিকেলে। বিকেল শেষ হয়ে কথায় কথায় সন্ধে নামত। কথা শেষ হত না। গভীর রাত ঘুমিয়ে পড়ত কথায় কথায়। 

আরও পড়ুন : প্রমিস / সায়নদীপ গুপ্ত 

এসব চলছিল। আর বদলে যাচ্ছিল দেশ। গরুর দাম বেড়ে যাচ্ছিল মানুষের থেকে। ধর্মের কল নাড়িয়ে দিচ্ছিল রাজনীতি। ভোটে মানুষ মরছিল যেমন মরে। খবরের কাগজে বেড়ে চলছিল ধর্ষণের খবর। এসব যেন কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। এক ধর্ষিত সময় তার ছিন্ন বসন আগলে চেয়ে আছে সমাজের দিকে। এমন এক সমাজ যার স্থিতিজাড্য বড্ড বেশি। এমন এক সমাজ যে ভিড়ের সুযোগে কোনও মেয়ের বুকের দিকে কনুই বাড়িয়ে দেয়। আবার সম্মত প্রেমিক-প্রেমিকাকে ঘনিষ্ঠ দেখলে নীতির জামা পরে মারমুখী হয়ে ওঠে। তমিজ শেখাতে চায়। মেঘও একসময় ভাবত, বিপ্লব হবে। যেমন সবাই একটা সময় ভাবে। তারপর দেখল তার জীবনটা এই সমাজে কতটা বেখাপ। কতটা বেখাপ হলে মেঘ বসু ভালোবেসে ফেলে তুলি ইয়াসমিনকে। যে তার থেকে পাঁচ বছরের বড়ো। যার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। 


আজ আলোর সঙ্গে দেখা হল। অনেক দিন পরে। একটা সময় ছিল যখন রোজ দেখা হত আলোর সঙ্গে। সেই দেখার গায়ে ছিল রোজকার ধুলো। আর এখন আলো অন্য কারও প্রেমিকা। তাই হয়তো, আলোর মতোই চকচকে। 

ঋতায়ুধদা বলে মেঘ নাকি আলোকে এখনও ভালোবাসে। ভালোবাসা কাকে বলে মেঘ জানে না। মেঘ শুধু জানে মাঝেমধ্যে রাত এসে ভেঙে পড়ে ওর বিছানায়। এসব ভয়ংকর রাত। এইসব রাতে ঘুম আসেনা। ঘুমের মতো কে একটা আবছা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ায়। চারদিকে ভাসতে থাকে কতগুলো ছায়াছায়া মুখ। একসঙ্গে নয়। অনেকটা বইয়ের পাতা খুব তাড়াতাড়ি উলটে যাওয়ার মত। তুলি, আলো, কন্যা আরও কত মেয়ে... যারা মেঘের জীবনে এসেছে। ভূতের মত তাদের মুখগুলো যেন ধোঁয়া হয়ে ওঠে। অদ্ভুত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় মেঘ। কোনও একটা মুখে ও ওর ঠিকানা দেখতে চায়। আঁকড়ে ধরার মত একটা ঘর খুঁজতে চায় এক মুখ থেকে অন্য মুখে। কিন্তু এরা তো কেউ ঘর না। মানুষের তো একটা ঘর লাগেই। অন্তত মনে। এমন কাউকেও যদি পাওয়া যায়, যে কোনওদিন সত্যিকারের ঘর হবে না, যে কখনোই একসঙ্গে থাকবে না, বাজার করবে না, বছরে কোনও বিশেষ দিনে মেঘ যার জন্য কোনোদিনই উপহার আনবে না, তবু সে থাকবে, ধ্রুবতারার মত। অনেক দূরে। দিকভুল পথিকের নিশ্চিত আলো হয়ে। আলো কি তাই? আলো কি তাই ছিল? সবাই বলত ওরা মেড ফর ইচ আদার। পড়াশুনা, ভাবনা সব দিক থেকে। অথচ মেঘ জানে ওদের দুজনের মধ্যে কতকালের সমুদ্র। যার জল শুধু নোনা। আলো কোনদিন বুঝেছে ওর চুপ করে যাওয়া? ওর হাত ছেড়ে দেওয়া, ওর ভুলভাল দুর্বল কবিতাগুলো? অথচ তবু আলোর মুখ... কিছুতেই ভোলা যায় না। আলো অন্যের প্রেমিকা। সুখী প্রেমিকা। সফল গবেষিকা। কী সুন্দর জীবনটাকে গুছিয়ে নিল ও নিজের মতো করে। মেঘ তো নিজের ঘর গোছাতেই হিমসিম খেয়ে যায়। মেঘের মাঝে মাঝে মনে হয়, ও আলোকে হিংসে করে। ওর প্রেমিককে, ওর সুন্দর গোছানো জীবনটাকে... ও আলোকে ভুলতে চায়। ওর মোবাইলের গোপন ফোল্ডারে আলোর কয়েকটা ছবি। ফোল্ডারের নাম দুখজাগানিয়া। ও তবে আলোকে ভালোবাসে? না। আলোকে ও ঘেন্না করে। ঘেন্না করতে চায়। সবাই জানে প্রেম ভেঙে যাওয়ার পরে ওরা বন্ধু। কিন্তু মেঘ জানে, আলো ওর খুব গোপন একটা ব্যথা। যাকে লুকিয়ে রাখার জন্য মেঘ নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা করে চলেছে। অথচ মেঘ তো অভিনেতা নয়! আলো নাটক করত। নাটক নিয়ে পড়ত। মেঘ কোনওদিন নিজেকে লুকোতে পারে না। কিন্তু ও এখন বুঝতে পারে, নিজেকে নিপুণভাবে লুকিয়ে ফেলার নামই হল অভিনয়।


এইসবের মধ্যেই কখন যেন এসে পড়ল তুলি। বয়েসে বড়ো। উদ্দাম শরীর। যার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

এল তুলি। ফেসবুকে নয়। কলকাতায় একটা সেমিনারে পেপার দিতে। কদিন মেঘ আর তুলি তুমুল। প্রচুর মদ খেয়ে তুলি যখন মেঘের ঠোঁট কামড়ে ধরত তখন মেঘ ভাবত এত আকুতি কীসের তুলির? ও তো আলোর মতই সব পাওয়া একটা মেয়ে। যার প্রেমিক ভারতের বিখ্যাত এক গবেষক অধ্যাপক। কী চায় তুলি? তুলি কি ওকে ভালোবাসে? উত্তরটা জানে মেঘ। না। তুলি ভালোবাসে না। শুধু এক বৈশাখী ঝড়ে ভেসে যায় ওরা। মেঘের খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে তুলি ওকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু...

একদিন ওরা ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলছিল। মেঘ তুলিকে জিগ্যেস করল, তুমি কোনোদিন অন্তত মনে মনেও ভেবেছ যে আমায় বিয়ে করবে? এক সেকেন্ডের মধ্যে তুলি উত্তর দিয়েছিল- না। মেঘ কি সেটা জানত না? কিন্তু সব জেনেও মানুষ মাঝে মাঝে বোকামি করে। ডুবতে ডুবতেও হাত দিয়ে খোঁজে একটা কুটো। যেটা ধরে ভেসে থাকা যায়। আলো সেই কুটো? তুলি? রাতগুলো ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। মেঘ বসুর মনে হয় ও আত্মহত্যা করবে। 



There is but one truly serious philosophical problem, and that is suicide. 

এছাড়াও পৃথিবীতে নিশ্চয়ই অনেক দার্শনিক প্রশ্ন থাকে। আপাতত আমাদের দার্শনিক প্রশ্ন একটাই। কোথায় যাচ্ছে এই আখ্যান? নিজেকে ভেঙেচুরে সাংবাদিক ভঙ্গিমায় নিজেকেই আখ্যান ভেবে ফেলার মত মহামূর্খ এই পৃথিবীতে অনেক থাকে। অনেকে ভুলে যায় আমাদের জীবন অনেকগুলো মেটা ন্যারেটিভ জুড়ে জুড়ে বুনে ওঠা এক গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ। এক চরিত্রের জীবনের এলোমেলো গল্পগুলোকে ধাওয়া করছি আমরা। আমরা কি জানি আমরা কোথায় পৌঁছব! কেন পৌঁছব! জীবন কি কোথাও পৌঁছয়? আর সাহিত্য যদি জীবনের শিল্প হয়, সাহিত্যও কি শেষ পর্যন্ত কোথাও পৌঁছবে? 

আরও পড়ুন : গাধা / তানিয়া পাল

লম্বা লেকচার শেষে ঘাম মুছছেন প্রবীণ অধ্যাপক। অধ্যাপিকা শব্দটা তিনি এড়িয়ে চলেন। বৃত্তিমূলক শব্দে স্ত্রীলিঙ্গ পছন্দ করেন না। আলো সেন। গেরামভারী মানুষ। ক্লাসে প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা কথা বলেন না তিনি। যাঁর জীবিকাই কথা বলা, তাঁকে তো শব্দে মিতব্যয়ী হতেই হয়। সহকর্মীরা ভাবেন আলো নাকউঁচু। বন্ধুরাও তাই। উঁচু নাক আর উঁচু মাথা নিয়ে চাকরি জীবনের শেষে এসে পৌঁছেছেন আলো। তবে সত্যি বলতে বন্ধু তাঁর বিশেষ নেই। ওম্যান স্টাডিজের তুলি সরকার ছাড়া। আর এডুকেশনের কন্যা দত্ত। এরকম কয়েকজন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলিগ। আরও আছেন একজন। এক মফস্বলে গানের ইস্কুলের দিদিমণি। এইরকম কয়েকজন মিলে - ‘সই’। ওদের সংগঠনের নাম। নামটা পছন্দ করেছিলেন আলো। ছাত্রবয়সে নবনীতা দেবসেনকে খুব পছন্দ করতেন তিনি। বহুযুগ পরে, যখন মেয়েদের নিয়ে একটা সংগঠন করার কথা তাঁর মাথায় এল, যারা মেয়েদের নিয়ে ভাববে, কাজ করবে, তখন ঐ নামটাই তিনি বেছে নেন। আর একে একে সই-এ যুক্ত হয়ে যান তুলি, কন্যা এরকম আরও অনেকে। রমরম করে চলছে সই। শুধু আকাশে মেঘ করে এলে সইয়ের সবাই যে কেন আনমনা হয়ে যান, এটা সইয়ের কোনো সদস্যাই এখনও ঠিক ধরতে পারেননি। 


[চিত্র-ঋণ : Rene Magritee]  


#গল্প #রবিবারের গল্প #জীবনানন্দ #জয় গোস্বামী #বোদলেয়র #বিদ্যাপতি #যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় #নবনীতা দেব সেন #বিবস্বান দত্ত #সিলি পয়েন্ট #Story #Sunday Story

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

108

Unique Visitors

182896