গল্প

গাধা

তানিয়া পাল Nov 15, 2020 at 6:04 am গল্প

আজ ঘুম ভাঙা মাত্র এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে বিপ্রদাসের। এক্কেবারে অচেনা অজানা একরকমের শিহরণ যেন গোটা শরীরে বয়ে যাচ্ছে তার। এরকমটা এই প্রথম। অন্য দিন ঘুম ভাঙা মাত্র তেলাকুচো লতার বেড়ার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় সে, তারপর বড়ো ধীরে নিজেকে তৈরি করে নেয়। ভোরের দিকে এখন একটু শীত শীত লাগে।সরু সরু কালো হাত দুটোকে বুকের কাছে কুঁকড়ে এনে ঘরের দাওয়ায় এসে বসে বিপ্র। পুঁই গাছের হৃষ্টপুষ্ট ডগাটা লতিয়ে উঠেছে চালের উপর, শিশিরে ভেজা পাতাগুলো চকচক করছে ,কুমড়ো শাকের পাতাগুলো মাচার ওপর ফুলে ফেঁপে উঠেছে। মাটির দাওয়া এসে মিশে গেছে উঠোনের বুকে। এইসব দেখা জিনিসে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নেয় বিপ্র। তারপর আকাশের দিকে তাকায়। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তার রং বিপ্রর ট্রাঙ্কে তুলে রাখা জিনসের মতো, যা সে একবছর ধরে গুছিয়ে রেখেছে কিন্তু পরার সুযোগ পায় নি। বঙ্কুদাদা তাকে আজ সে সুযোগ করে দিল। এসব কথা ভাবতে ভাবতে বিপ্রর মনে পড়ল , তারকের বাড়ি থেকে বুট জুতোটা নিয়ে আসার কথা। তারকের বাবার সাইকেলের দোকান স্টেশনের কাছে। সেখানে ইস্কুল ছুটির পর দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে হাজির হয় বিপ্র, না দৌড়লে পাঁচজন মানুষের পেটচালানো মুশকিল হয়ে পড়বে দুগ্গামনির। শুধু ঝাঁটা বেঁধে আর গ্রামে দু-তিন ঘরে ঝিয়ের কাজ করে পেটে দানা জোটানো মুস্কিল। তবে এবার থেকে বিপ্রর আর স্কুলে যাওয়া হবে না। সেও বঙ্কু দাদার মতো এদেশ ওদেশ ঘুরে কাজ করে বেড়াবে। সেই পয়সায় ঘরের ফুটো চাল সারাই হবে। ঠাকুমার ওষুধ আসবে। টিনু- চিনু র নতুন রং পেন্সিলের বাক্স আসবে। দুগ্গামনি একটু বিশ্রাম পাবে আর বিপ্র লক্ষ্মীর ভাঁড়ে টাকা জমিয়ে জমিয়ে একটা গাধা কিনবে।

' কি বলিস রে, তুই শেষ অবধি গাধা কিনবি?'- হা হা করে হেসে উঠেছিল তারক তার এই কথা শোনা মাত্র। ' মানুষ টাকা জমিয়ে ইস্মার্ট ফোন কেনে, টিবি কেনে আর তুই কিনা শেষে গাধা!'- তারক কে বোঝাতে বিফল হয়ে চুপ করে থাকে বিপ্র। গাধা নামক প্রাণীটার ওপর ভারি মায়া জন্মেছে বিপ্রর। সাত বছর বয়সে বসন্তরোগের প্রবল জ্বরে দাওয়ার  এককোণায় শুয়ে গোঙাতে থাকা ভাগচাষির ছেলেকে যখন গাঁয়ের ডাক্তার দেখতে আসে না, গ্রামীণ হাসপাতাল যখন ঘন্টার পর ঘন্টা নির্লিপ্ত হয়ে ফেলে রাখে বিনা চিকিৎসায়, তখন তো এই  গাধার ওপর বসা শেতলা মা-ই তাকে বাঁচায়। গাঁয়ের মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে দুগ্গামনির আনা শেতলা মায়ের জলপড়াই তো রক্ষে করেছে তাকে, তাই সে তাকে বিশ্বাস করবে না তো কাকে করবে? 

বোশেখ মাসের কড়া রোদে যেদিন ওর বাবা মাঠে ধান কাটতে গিয়ে মুখ থেকে রক্ত উঠে মরেছিল, সেদিনও  গাধার ওপর কোনো রাগ জন্মায়নি ওর। বরঞ্চ মনে হয়েছিল এই গোটা পৃথিবীতে গাধার থেকে পরিশ্রমী, সৎ প্রাণী আর একটাও নেই। গ্রামে মন্ডলদের বাড়ির দুগ্গা পুজোয় মা দুর্গার সাজগোজ, জাঁকজমক  আর তেড়ে আসা সিংহ দেখে একটু ভয়ই লাগে ওর। এদের চাপে কেমন জিভ বার করে পড়ে রয়েছে মহিষটা। আহা রে! দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে বিপ্র। কাছে যেতে পারে না। বড়ো বড়ো কাঁসার থালায় কতো মন্ডা মেঠাই, ফল, ভোগ। ' আরে! এ কি আর আমাদের মতো গরীব নোকেদের মা? মা দুগ্গা হলেন গিয়ে বড়োনোকেদের মা । বুঝলি গাধা, তাই তো তার পুজোয় এতো চমক ঢমক' এই কথা বলে দুগ্গামনি  ঘরের কাঁচা দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিল বিপ্রর।সে বিপ্র বোঝে। তাই তো মা শেতলার থানে কেউ মিছরি, বাতাসা আবার কেউ বা গাছের ডাব বা আখ মানত করে। মা তাতেই খুশি । বিপ্র নিজেই কতবার  করেছে। সে পরীক্ষায় টেনে টুনে পাশ করা হোক বা মাঠে ফুটবল খেলা, সবেতে মা গাধায় চেপে হাতে ঝাঁটা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় । বিপ্রও  প্রতিবার চৈত্র- বৈশাখ মাসে যখন শেতলা মায়ের পুজো হয় ঢাক বাজিয়ে, তখন পাঁচটাকার মিছরি কিনে দিয়ে আসে। মায়ের সঙ্গে ভাগচাষির ছেলের এই চুক্তি প্রায় পাঁচ-ছ বছর ধরে চলছে। 

 এবারে মা মুখ তুলে চেয়েছে। বিপ্র কখনো ট্রেনে চড়েনি। আজ প্রথমবার বঙ্কুদাদার সাথে সে ট্রেনে করে কলকাতা যাবে। সেখানে না কি অনেক টাকা রোজগার করা যায় । তাই বঙ্কুদাদার বাড়িতে দু মাস ধরে তার ঢাকের তালিম নেওয়া চলেছে। বঙ্কুদাদাই তাকে একটা ঢাক দিয়েছে, দুর্গা পুজোর সময় কলকাতা গিয়ে বাজানোর জন্য। সেই বাবদ তার থেকে হাজার টাকা নিয়ে নেবে সে। কলকাতায় পাঁচদিন ঢাক বাজালে কমপক্ষে চার হাজার টাকা সে পাবেই। প্রতিবার পুজোর শেষে বঙ্কুদাদা যখন গাঁয়ে ফেরে কলকাতা থেকে, তখন পুঁটলি ভর্তি করা থাকে জামা কাপড়ে। সেখান থেকেই বিপ্রকে একটা জিনসের প্যান্ট দিয়েছে বঙ্কুদাদা। এবার তো সে নিজেই যাবে শহরের পুজোতে ঢাক বাজাতে। না জানি তার নিজের পুঁটলিও হয়তো ভরে উঠবে বাসি জামা- কাপড় আর জিনসে। সেই অনেক ওর জন্য। বিপ্র, বঙ্কু দাদার পুঁটলির জামা কাপড় গুলো দেখে আর ভাবে। বঙ্কু দাদা যখন তার হাতে আকাশি রঙের জিনসের প্যান্টটা তুলে দিল, বিপ্রর যে কি আনন্দ হচ্ছিল! খুব আনন্দ পেলে বিপ্র এমন চুপ করে যায়। তার মা যখন মন্ডলদের বাড়ির উঠোনের কোন থেকে একটা ভাঙা লাটাই কুড়িয়ে এনে তাকে দিয়েছিল, তা প্রায় বছর চার আগে, তখনও ঠিক এরকম আনন্দই ওর হয়েছিল। তবে বিপ্র অনেককাল পর আবার আনন্দ পেল। কিন্তু গাঁয়ের  সব ছেলেদের বাদ দিয়ে বঙ্কু দাদা ঐ আকাশি আকাশি রঙের জিনসের প্যান্টটা তাকেই বা দিল কেন? অনেক ভেবে বঙ্কু একটা জুতসই উত্তর বার করতে পেরেছে। সেবার যখন বঙ্কু দাদার মায়ের অসুখ করলো সেই তো বারবার স্টেশন অবধি দৌড়ে গিয়ে ওষুধ এনে দিল। তারপর দুগ্গামনি রাত জেগে তাকে সুস্থ করে তুলল। সেসব তারা ভোলেনি। তাই বঙ্কুদাদাও তাকে এবার কলকাতা নিয়ে যাচ্ছে। যদিও শেতলা মা এর থানে ভরে পড়ে যে জটে বুড়ি, সে এ বছর বলেই দিয়েছিল, ' তোর জেবন  পাল্টাবে রে ছোঁড়া। পাল্টাবে...' তারপর আরো কি জানি বলছিল মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, কিন্তু ঢাকের আওয়াজে আর কোনো কথাই কানে আসেনি বিপ্রর। বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। গাঁয়ের আরো পাঁচজন আছে। তারাও মায়ের কাছে জানতে চায় তাদের ভবিষ্যৎ। কমলা আর বাচ্চা বিয়োবে কিনা? বৌ পাঁচ মাসের পোয়াতি। তার ছেলে হবে না মেয়ে? এ বছর বৃষ্টি হবে কিনা? ফসল উঠবে কিনা? ছেলে কলকাতায় কাজ পাবে কি না?  তাই অর্ধেক কথা শুনে উঠে আসে বিপ্র। তারপর এই কলকাতা যাওয়ার সুযোগ। সবই মায়ের কৃপা এই বলে মাথায় জোড় হাত ঠেকায় সে।

' শোন বাবা!! এই মা কিন্তু যেমন তেমন মা নয়। খুব রাগি । এট্টু ভুল করেছ তো ঐ সিংহ দিয়ে তোমাকে খাইয়ে ছাড়বে। মন দিয়ে বাজাবি বুঝলি?' এই কথা পইপই করে বলে দিয়েছে মা। বিপ্র ঢাক কাঁধে নিয়ে বঙ্কুদাদার সঙ্গে রওনা দিল সিংহের উদ্দেশে । যাওয়ার আগে একবার শেতলা মা এর থানে মাথা ঠুকে নিল। ভালো করে দেখে নিল গাধাটাকে। গ্রামের ধান ক্ষেত পেরোবার সময় সদ্য রোদের ছোঁয়ালাগা জমিটাকে দেখে বিপ্রর বাবার কথা মনে পড়ল। আচ্ছা! বাবা বেঁচে থাকলে কি তাকে বঙ্কুদাদার সাথে কলকাতা পাঠাত? বাবার করুণ মুখ আর রোদে পুড়ে যাওয়া পিঠটার কথা বারবার মনে পড়তে থাকে বিপ্রর। তারপর আবার সেই গাধার কথা। একটা গাধা তাকে কিনতেই হবে। এই গ্রামে থেকে শুধু তারকের বাবার সাইকেলের দোকানে কাজ করে তা সম্ভব নয়। তাই জোরে, আরো জোরে হাঁটতে থাকে সে। যতো তাড়াতাড়ি এই গ্রাম পেরনো যায়। পুকুরে হাঁসেদের প্যাকপ্যাক আওয়াজ, বৌ কথা কও পাখির সকরুণ ডাক, পথচারীদের নিজস্ব বাক্যালাপ এই সব কিছু কানে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়  সে। স্টেশনে পৌঁছে মনে পড়ে, মা কে হাত নাড়ানো হলো না পুকুর ধারে দাঁড়িয়ে ।



 ট্রেনে ওঠার পর থেকেই  ভয় করতে শুরু করল বিপ্রর। বিপ্রদাস বারুই। বাবা স্বর্গত দেবদাস বারুই। গ্রাম - পঞ্চকোট। থানা- গড়পুর। জেলা বর্ধমান। বয়স - চোদ্দ। ট্রেন যতো এগোতে থাকে বিপ্রর তত কান্না পেতে থাকে। জানলার বাইরে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে ক্ষেত, পুকুর, মাটির ঘর,আর তার পরিচিত সবকিছু। জানলার শিকের সরু ফাঁক দিয়ে ও ও হয়তো ছিটকে পড়ে যাবে। এতো জোরে চলছে কেন ট্রেনটা? হঠাৎ বিপ্রর খুব  কান্না পেল। গলার কাছে দলা পাকানো একটা ভয়। ' আরে, প্রথম প্রথম এরকম হয়। আমারও হয়েছিল।' বঙ্কু আশ্বস্ত করে বিপ্রকে। হাওড়া স্টেশনে নেমে তাজ্জব হয়ে যায় গেঁয়ো কিশোর। এই শহরে সে নিশ্চিত হারিয়ে যাবেই। তার আর গাঁয়ে ফেরা হবে না। গাধা কেনা হবে না। আর তাতে ঝাঁটা হাতে মা দুগ্গামনিকে বসানোও হবে না। বঙ্কুর হাত আরো শক্ত করে ধরে নেয় বিপ্র। স্টেশনের ভিড় থেকে বেরিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে বিপ্রর আবার বাড়ির কথা  মনে পড়লো। মা বোধহয় এখন মন্ডলদের বাড়ি পুজোর বাসন মাজছে, ঠাকুমার হাগা কাঁথা বোধহয় পাল্টানো হয়নি। চিনু,টিনু মনে হয় দাওয়ায় বসে মুড়ি চিবোচ্ছে।

' আচ্ছা! দেখ হে ছোকরা, আমাদের ঠাকুর বিসর্জন যাবে দ্বাদশীর দিন। মানে আজ থেকে আটদিন বাজাতে হবে। চার হাজার দেব। তার সাথে থাকা,খাওয়া আর যাওয়ার সময় জামাকাপড়, মুড়ি,নাড়ু এসব তো পাবেই। রাজি থাকলে চলো।' 'আমরা তরুণ দল' ক্লাবের সেক্রেটারির কথা শেষ হতে না হতেই বঙ্কু বলে দিল , ' হ্যাঁ! হ্যাঁ!  বাবু কোনো অসুবিধা নেই। ও এখানেই বাজাবে'। এই বলে বিপ্রর দিকে তাকিয়ে বললো, ' শোন , এনারা খুব ভালো মানুষ বুঝলি। তোকে ভালো ভাবেই রাখবে। দ্বাদশীর দিন সন্ধ্যাবলা এসে আমি তোকে নিয়ে যাব। আমি এই পাশের পাড়াতেই বায়না পেয়েছি বুঝলি। যা চলে যা বাবুদের সাথে।' এই কথা বলে বিপ্রকে কোনো উত্তরের সুযোগ না দিয়েই সরে পড়লো বঙ্কু। ' আমরা তরুনদল ' ক্লাবে প্রতিবার যে ঢাকি ঢাক বাজাতে আসে সে এবছর বাতিল। সেক্রেটারি বাবুর বাড়ির কাজের লোকের সাথে তার ফস্টিনষ্টি পাড়ার লোকেরা ধরে ফেলেছিল গতবার নবমীর রাতে। তাই তারাও এবার বাধ্য হয়ে ঢাকির খোঁজে বেরিয়েছে।  সম্ভ্রান্ত পাড়া, তার ঠাট- বাট এক্কেবারে আলাদা। এই প্রথম বঙ্কুদাদার ওপর খুব রাগ হলো বিপ্রর । এভাবে একা ফেলে চলে গেল ওকে। সরু কাঁধে ঐ ভারি ঢাকের বোঝা নিয়ে মন্ডপের মধ্যিখানে এসে দাঁড়াল সে। মা দুগ্গার সামনে দাঁড়িয়ে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বিপ্রদাস। এত্তোবড়ো দুগ্গা ঠাকুর সে কখনো দেখেনি। মন্ডল বাড়ির দুর্গা ঠাকুর তার থেকে দু হাত লম্বা মাত্র।  সিংহের কি তেজ রে বাবা! আর অসুরটাকে দেখ , এক্ষুনি যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে বিপ্রর ওপর। তারপর ছিঁড়ে খেয়ে নেবে ওকে। বিজ্ঞান বইতে দেখা সিংহ এরকমটা নয়। তবে ক্লাসের রাজু একবার বলেছিল কলকাতার চিড়িয়াখানায় নাকি একটা ভয়ঙ্কর রাগি সিংহ আছে। তবে কি বাড়ি ফেরার সময় বঙ্কুদাদাকে একবার বলবে সেই সিংহটা দেখাবার জন্য?  এইসব কিছু ভাবতে ভাবতে বিপ্রর চোখ গেল নীচে জিভ বের করা মহিষের দিকে। আবার ভয় পেতে শুরু করল বিপ্র। চারিদিকে ক্যাপের আওয়াজ, মানুষজন - সব এতো অন্যরকম হয় কি করে? এটা কি সেই পৃথিবীই যেখানে বঙ্কু থাকে ? 

' এই ঢাকি ঢাক বাজা' এই ডাকে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত  হয়ে উঠছে বিপ্র। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চোখ বুজে ঢাক বাজিয়ে চলে ছেলেটা। হাত দুটো অবশ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। আর সব থেকে অদ্ভুত যেটা হলো, যতবারই সে চোখ বুজে ঢাক বাজায় তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তীব্র আলোর ঝলকানির মধ্যে দিয়ে গাধার পিঠে চেপে কে যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিন্তু মুখটা অস্পষ্ট। আলোর ছটায় মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় না। বিপ্রও সেই মুখ দেখবে বলে বন্ধ চোখের পাতা খোলে না। আরো জোরে তীব্র শক্তি দিয়ে বাজাতে থাকে ঢাক। ঢাকের শব্দে সে নিজেও যেন সম্মোহিত হয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারেনা গাধার পিঠে চেপে কে আসে?

এই দুদিনে পাড়ার লোক বেশ খুশি তার এই বাজানোতে। সপ্তমীর দিন রাতে ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জিতেছে ' আমরা তরুনদল'। তাই অলিখিত চুক্তি হয়ে গেছে বিপ্রর সাথে যে এবার থেকে বিপ্র ই তাদের পাড়ার পার্মানেন্ট ঢাকি। প্রতিবার পুজোর সময় হাওড়া থেকে সোজা তাদের পাড়াতেই ঢুকবে সে। পাঁচশো টাকা বকশিশ ও পেয়েছে বিপ্র । শুধু তাই নয় সেক্রেটারি বাবুর ঘরে বসে লুচি মাংসও খেয়ে এসেছে সে। সবই মা শেতলার দয়া। এতো স্বাদের খাওয়া এই প্রথম খেল সে। পান্তা আর চিঁড়ে- মুড়ি চিবোনো ছেলেটার খাওয়ার  সময় তার মা, চিনু, টিনুর কথা মনে পড়াই উচিত ছিল কিন্তু কি অদ্ভুত, যখন থেকে সে সেই স্কার্ট পরা মেয়েটাকে দেখেছে ওর সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। এ কি মেয়ে না পরী? 

রাতে ক্লাবঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে বিপ্র ঠাকুমার কথা। ঠাকুমা ছোটবেলা থেকে বলতো, ' আমরা হলাম গিয়ে ছোটোনোক । আমরা গাধার পিঠে চেপে এসেছি। তবে না আমরা এতো খাটতে পারি। ওরা সিংহের পিটে চেপে এসেচে তাই ঘোরে ফেরে আর খপাত করে ধরে ঘাড় মটকে খায়।' এই ওরা বলতে যে মন্ডলদের বোঝাতো ঠাকুমা তা বিপ্র ভালো রকমই বুঝতে পারত।ওরাই তো বাবা কে প্রতিবার ধান কাটার সময় খাওয়ার সময়টুকুও দিত না। এ বাহানা ও বাহানা করে কতো টাকা কম করে দিত। তারপর দুগ্গা পুজোয়  জমক চমকে ভরিয়ে দিত চারপাশ। মা দুগ্গার দিকে এখনো দু চোখ মেলে তাকাতে ভয় পায় বিপ্র। কে জানে কেন? তবে আজ শুয়ে শুয়ে তার মনে হয় , সে বুঝি এতোদিন বৃথাই ভয় পেয়ে এসেছে মা দুগ্গা কে। মা মনে হয় অতোটাও খারাপ নয়। তবে কি আজ সে পাঁচশো টাকা বকশিশ পায়। মা বোধহয় খুশিই হয়েছে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে বিপ্র। কাল আবার অষ্টমী পুজো, সন্ধিপুজো অনেকক্ষণ ধরে বাজাতে হবে তাকে। আর চোখ বন্ধ করে নয়, কাল থেকে চোখ খুলেই বাজাবে সে।

 ভোররাতের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় বিপ্রর। মনে হয়  কে যেন তার গায়ে হাত দিয়ে সরে পড়লো। ধড়মড় করে উঠে বসে সে। একটু শীতের ছাঁট পড়েছে। পায়ের কাছে গুটিয়ে রাখা চাদরটা দুহাত দিয়ে মেলে নেয় নিজের গায়ে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না অন্ধকারে। জানলা দিয়ে যেটুকু আলো আসছে তাতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কেউ যে এসেছিল তা নিশ্চিত বিপ্র। ঘরে একটা সুন্দর অবশ করা গন্ধ ছড়িয়ে গেছে। এইরকম গন্ধ  কলকাতায় এই দুগ্গা পুজোয় এসে প্রথম পেল সে । গ্রামের শেতলার থানে যারা পুজো দিতে আসে তাদের গায়ের গন্ধ অন্যরকম। তা হবে নাই বা কেন? মা দুগ্গা যে বড়োনোকেদের মা এ কথা মনে পড়তেই আবার শুয়ে পড়ে বিপ্র। শোওয়ার আগে মাথার কাছে রাখা বোতল থেকে জল খেয়ে নেয় সে। তবে কি মা দুগ্গা এলেন তার কাছে? আজকের বাজানোতে কি মা খুশি হয়েছেন? তার যখন বসন্ত হয়েছিল প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা জ্বরের ঘোরে তার মনে হতো, কে যেন  ঠান্ডা হাতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুমা শুনে বলেছিল, ' মা এর দয়া তো। তাই মা এসেচিল ।' আচ্ছা শেতলা মা যদি আসতে পারে, তবে দুগ্গা মা কেন নয়? সে গরীব বলে? দুগ্গা মা কি শুধুই বড়োনোকেদের মা? এ বার থেকে তারাও একটু একটু করে বড়োলোক হবে। বড়োলোক হতে হলে কি করতে হয়? অনেক অনেক টাকা থাকতে হয় । বড়ো বাড়ি, গাড়ি এই সব...না! বিপ্র গাড়ি কিনবে না। অতো জোর ওর খুব ভয় লাগে। ও তার থেকে একটা ভালো জাতের গাধাই কিনবে।এইসব ভাবতে ভাবতে আবার চোখ বুজে ফেলে বিপ্র।


' সত্যি কথা বল, সোনার হারটা কেন চুরি করেছিলিস? গাঁজা খেতে?' ক্লাবের সেক্রেটারি বাবুর হুঙ্কারে কেঁদেই ফেলে ঢাকি। আজ অষ্টমী ।' আমরা তরুনদল 'ক্লাব অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে আর একটা নতুন ঢাকি নিয়ে এসেছে অন্যপাড়া থেকে ভাড়া করে। কারন বিপ্র চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। কাল রাত থেকে সেক্রেটারি বাবুর বৌ এর গলার হার পাওয়া যাচ্ছে না। সেটি পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে তার স্বামীর দেওয়া উপহার। কান্নাকাটি করে মা দুগ্গার কাছে নাকের নথ মানত করার পরেই বিপ্রর পুঁটলি থেকে সে হার উদ্ধার করা গেছে। জোড় হাতে ছেলেটা সমানে বলে চলেছে, ' মা শেতলা র দিব্যি বাবু বিশ্বাস করেন আমি এই হার চুরি করিনি। কাল রাতে আমার ঘরে কে একটা...' ঘুষি, লাথির আক্রোশে, ঢাকের আওয়াজে, ঠাকুরমশাই এর ' দেহি দেহি' উল্লাসে চাপা পড়ে যায় গেঁয়ো কিশোরের আর্তি। এটা কলকাতা শহর এখানে মা শেতলার দিব্যির কোনো দাম নেই, সে কথা বোঝেনা গ্রামের গাধা টা।' নিইনি বাবু বিশ্বাস করেন আমি চুরি করিনি' ।একদা তার পূর্বপুরুষের কান্না, শ্রম যেমন গ্রামের জমিদারদের চাবুকের কষাঘাতে মাটিতে মিশে যেত ঠিক সেরকম। তবে তার মা আসছে না কেন এবার? গাধায় চেপে হাতে ঝাঁটা নিয়ে কেন বিপ্রকে উদ্ধার করতে আসছে না? মাটিতে কোঁকাতে কোঁকাতে পিষে যাওয়া  জিভ বার করা মহিষের মুখটা বারবার মনে পড়তে থাকে বিপ্রর। ঠাকুরমশাই মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে, 'ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে'।

  শহরের অচেনা রাস্তায় অনেক খুঁজেও বিপ্র বঙ্কুদাদার হদিশ পায় নি। গাঁয়ে ফেরেনি অপমানে, লজ্জায়। খালি হাতে দাঁড়িয়ে কি বলবে সে? মা দুগ্গা নাকি কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।  বঙ্কুদাদা ঝুলি ভর্তি করে জামাকাপড় মিষ্টি নিয়ে ফেরে। ঐ দশমীর পরে ওদের আবার নতুন করে দুগ্গা পুজো হয় যেন। শহরের বাবুরা ঠাকুরগুলো জলে ভাসান দেওয়ার পর, গভীর রাতে জরি, চুমকির পোশাক ছেড়ে মা গিয়ে ওঠেন ওদের ঠাকুরদালানে। কেউ দেখতে পায়না। শুধু যারা পুঁটলি ভর্তি করে রঙচটা শাড়ি, ছোটো হওয়া জামা নিয়ে মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে ঘরে ফেরে তারা দেখতে পায় সে সব। আসার সময়  টিনু গলা জড়িয়ে আবদার করেছিল, ' দাদা আমার জন্য একটা গোলাপি রঙের জামা আনবে তো?' কি বলবে বিপ্র ঐ পাঁচ বছরের মেয়েটাকে? প্রতিদিন সকালে উঠে যে পুকুর ধারে এসে দাঁড়ায় আর ভাবে এই বুঝি দাদা এলো পুঁটলি কাঁধে নিয়ে।  মায়ের ছেঁড়া শাড়িটা বদলাতে পারবে না। ঠাকুমার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিতে পারবে না। তবে ফিরে গিয়ে  সে কি করবে? এইসব ভাবতে ভাবতে শহরের বুকে অচেনা রাস্তায় ঘুরতে থাকে কিশোর। তার জীবন কি তবে শেষ হয়ে গেল? তবে কি বিপ্র এই শহরের বুকেই হারিয়ে যাবে। ট্রাঙ্কে তুলে রাখা লাটাইটার জন্য হঠাৎ খুব কান্না পেতে থাকে বিপ্রর।

বছর দুই হলো সে একটা গ্যারেজে গাড়ি ধোওয়ার কাজ নিয়েছে। এখন বিপ্র আর তেড়ে আসা সিংহ দেখলে ভয় পায় না। সিংহ থাবা মারার জন্য গোটা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ কথা জেনে নেওয়ার পর আরো প্রাণপণে খাটতে থাকে সে। একটা গাধা সে কিনবেই। তারপর ফিরে যাবে গাঁয়ে।




[ অলংকরণ : অভীক ]

#বাংলা #গল্প #Bengali #Story #গাধা #তানিয়া পাল #অভীক

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219128