ট্যাক্সি
- এইট বি যাবেন?
- না।
- আরে, সমীর না?
- আরে ভবতোষদা আপনি? মুখে মাস্ক বলে বুঝতে পারিনি। আপনি এদিকে?
- সেটা তো আমার তোমাকে জিগ্যেস করার কথা। তুমি এদিকে, তা-ও আবার ট্যাক্সি নিয়ে? কী ব্যাপার বলো তো?
- উঠে পড়ুন উঠে পড়ুন। মামা ধরবে। এখানটা দাঁড়াতে দেয় না।
- কী নরম সিট! পেছনটা ডুবে যাচ্ছে একেবারে। গাড়িটাও একেবারে ঝকঝক করছে দেখছি। নতুন বুঝি?
- হ্যাঁ, এই তো দু মাস হল কিনেছি।
- ব্যবসা ছেড়ে তাহলে ট্যাক্সি চালানো ধরলে? কিন্তু তোমাদের অত বর্ধিষ্ণু ব্যবসা...।
- না না, ব্যবসা ছাড়িনি। মাসে এখন লাখ তিনেকের টার্নওভার। কেউ ছাড়ে?
- তাহলে? এটা কি সাইড বিজনেস ধরলে?
- বিজনেস না। ট্রিটমেন্ট। চিকিৎসা চলছে।
- চিকিৎসা চলছে? মানে?
- প্রতি রোববার ঘণ্টাখানেকের জন্য ট্যাক্সি নিয়ে বেরোই। প্যাসেঞ্জার তুলি না।
- প্যাসেঞ্জার তোলো না?
- না। রিজেক্ট করি। মুখের ওপর না বলি।
- কী বলছ মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না ছাই!
- বলছি। হাতে একটু সময় আছে? এইট বি তো চলে আসবে এখনই। সরোবরের দিক থেকে একটু ঘুরে যাব নাকি?
- তা চলো। পাবলিশারকে এই পাণ্ডুলিপিটা দিতে হবে। ঘণ্টাখানেক দেরি হলেও অসুবিধা নেই।
- আপনি তো জানেন ভবতোষদা, আমার পড়াশোনার লাইনেই যাবার ইচ্ছে ছিল। অনার্স, এমএসসি দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাসও ছিল। ইচ্ছে ছিল বটানি নিয়ে হায়ার স্টাডি করব।
- হ্যাঁ, তুমি তো বরাবরই ভালো ছাত্র ছিলে।
- হয়ে গেলাম ইসবগুলের ডিলার। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি একটা রোজগারের ব্যবস্থা তো তখন করতেই হত বলুন। সেকেন্ড অ্যাটাকের পর বাবার একদিকটা পড়ে গেছিল। ভাই-বোন ছোটো। আমাকে তো কিছু একটা করতেই হত।
- এখন তো লাখে খেলছ ভায়া।
- হ্যাঁ। আপনাদের আশীর্বাদে খুব কম সময়েই ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে ফেলেছি।
- না না, সব তোমারই পরিশ্রম। আমরা তো দেখেছি কী অমানুষিক খাটাখাটনি তুমি করেছ। তারই সুফল পাচ্ছ এখন।
- কিন্তু ইচ্ছাটা তো পূরণ হয়নি। আমায় ভুল বুঝবেন না। ইসবগুলের ডিলার হয়ে কিন্তু আমি ইনফিরিওরিটিতে ভুগি না। সৎভাবে করলে সব কাজই সম্মানের। তাই না?
- সে তো ঠিকই। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা নিদেনপক্ষে টিচার হতে না পারলে যেন সম্মান নেই। কয়েকটা পেশার সঙ্গে আমরা সম্মানের ব্যাপারটাকে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছি, বাকিরা যেন মানুষই না। পেটি মধ্যবিত্ত ভাবনা যত্তসব।
- এই নিয়ে কোনও ইয়ে আমার কোনওকালেই ছিল না। কিন্তু ইচ্ছেটা তো ইচ্ছেই, বলুন?
- তা তো বটেই। কিন্তু এর সঙ্গে ট্যাক্সি বা চিকিৎসার কী সম্পর্ক বলো তো।
- চাকরিবাকরির অনেক চেষ্টা করেছিলাম। আমার শুরু থেকে টিচিং লাইনেই যাবার ইচ্ছে ছিল। কিংবা নিদেনপক্ষে পড়াশোনার সঙ্গে যোগ আছে এমন কোনও প্রফেশন। কতরকম যে ইন্টারভিউ দিলাম। সবেতেই রিজেক্ট হলাম। আমার চেয়ে কম যোগ্যতার লোকজনও দাদা-কাকা-মামার জোরে পেয়ে গেল। আমি পেলাম না। পঞ্চাশের বেশি ইন্টারভিউ দিয়ে সবেতেই ‘না’ শুনলাম। বেকার বলে পাঁচ বছরের প্রেমিকা না বলে দিল। রোজগার শুরু হতে বাপ-মা বিয়ের সম্বন্ধ আনল। ইসবগুলের ডিলার শুনে সেই মেয়েও না করে দিল। আমার জীবনের থিম সং-এ ওই একটাই ওয়ার্ড। ‘না’। আমার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছে এই রিজেকশন আর রিফিউজাল। ব্যবসা যখন মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছি, তখনও এই রিফিউজালের জ্বালা ভুলতে পারতাম না জানেন। রাতে বিড়ি খেতে খেতে কাঁদতাম। ঘরের পাখাটাও মনে হত যেন ‘না না’ শব্দে ঘুরছে। ঘুম আসত না ভালো করে। নানারকম আজেবাজে স্বপ্ন দেখতাম। অকারণে অম্বল হয়ে যেত।
- বুঝতে পারছি। খুব গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে মনে।
- দেখতে দেখতে ইসবগুলের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। আরও দুরকম ব্যবসা ফাঁদলাম। আয়েশ-আহ্লাদ করতে শুরু করলাম। বাড়ি-গাড়ি করলাম। তাও দেখলাম মনখারাপটা এঁটুলির মতো লেগেই আছে। টাকা রোজগার করে কী করব বলুন, যদি মনে শান্তিই না থাকে?
- ঠিকই তো। হক কথা।
- সবচেয়ে বড় কথা, কেমন একটা খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছিলাম। অকারণে খারাপ ব্যবহার করে ফেলতাম। অসুখী মানুষ তো খিটখিটে হবেই। সবসময় সবকিছুর খারাপ দিকটাই চোখে পড়ত। কিছুতেই যেন আনন্দ পেতাম না। বুঝলাম এই নেগেটিভিটির ভূতটাকে ঘাড় থেকে নামাতে হবে। সাইকোলজিস্টের কাছে গেলাম। গোটা একটা বছর কাউন্সেলিং করিয়েও তেমন লাভ হল না। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম নিজের ঘাড়ে চাপা ভূত নিজেই তাড়াব। এটা বুঝে গেছিলাম যে মন থেকে এই বিষটাকে বের করতে না পারলে ভালো থাকতে পারব না। জীবনে এত ‘না’ শুনেছি, পাল্টা দিতে না পারলে শান্তি পাব না। এবার নিজের ব্যবসায় তো আর সেটা করতে পারব না। খেয়েপরে বাঁচতে তো হবে। তাই ট্যাক্সির কেনার কথা ভাবলাম। ট্যাক্সি ছাড়া আর কীসে আপনি এত মানুষকে রিফিউজ করার সুযোগ পাবেন বলুন?
- ব্রিলিয়ান্ট! ব্রিলিয়ান্ট ভেবেছ ভায়া। ফল পাচ্ছ?
- হাতেনাতে। প্রথম যেদিন বেরোলাম, মোট বারোজনকে রিফিউজ করলাম। সেদিন বাড়ি ফিরে যে ঘুমটা ঘুমোলাম, অমন নিশ্চিন্তির ঘুম ছোটবেলার পর আর ঘুমিয়েছি বলে মনে পড়ে না।
- অসাধারণ। আমার তো তোমাকে নিয়ে গপ্প লিখতে ইচ্ছে করছে সমীর।
- লিখুন না। তবে, নামটা বদলে দিলে… মানে, ব্যাপারটা গোপনীয় কিনা।
- সে দেব নাহয়। এখন বলো দেখি, আরেকটু ডিটেলে বলো তোমার ফিলিংটা।
- সে একটা জান্তব আনন্দ ভবতোষদা। মানুষের মুখের আলো নিভে আসা দেখতে যে আরাম, কী বলব! তবে হ্যাঁ, বৃদ্ধ বা অসুস্থ মানুষ দেখলে ফেরাই না। কেউ হাসপাতালে যেতে চাইলেও ফেরাই না। আমি তো কসাই নই। তবে সেরকম কেস হাতে গোনা তিন-চারটেই পেয়েছি। রোববার ছাড়া তো বেরোই না। মাস দেড়েক হল। মানে, ছ দিন মতো। এর মধ্যে মোট সত্তরজনকে রিফিউজ করেছি।
- বাবা, গুনেও রেখেছ?
- অবশ্যই। চিকিৎসা চলছে না? পাই টু পাই হিসেব রাখা দরকার।
- ঠিক ঠিক। তা চিকিৎসা তাহলে সফল?
- একদম ব্লকবাস্টার হিট। এই দেড় মাসের মধ্যেই তফাৎ টের পাচ্ছি। খিদে ঘুম দুটোই বেড়েছে। মেজাজ সারাক্ষণই ফুরফুরে থাকছে। কর্মচারীদের অকারণেই বেশি বেশি বকশিস দিয়ে ফেলছি। রাস্তার কুকুরগুলোকে ভোজ দিলাম সেদিন।
- ব্রিলিয়ান্ট! ব্রিলিয়ান্ট!
- দ্রুতই ভালো হয়ে উঠছি ভবতোষদা। ফলে বেশিদিন আর এই খেলাটার প্রয়োজন পড়বে না। ‘না’ শুনলে মানুষের কেমন খারাপ লাগে, সে আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে। ট্যাক্সির কাজ ফুরিয়ে এল বলে। পরের মাসেই বেচে দেব। চিকিৎসার জন্য যেটুকু দরকার, সেটুকুই। সেটুকুর বাইরে মানুষের দীর্ঘশ্বাস কেন কুড়োবো বলুন?
- মনটা ভিজিয়ে দিলে ভাই। এক কাজ করো তো। গাড়ি ঘুরিয়ে নাও। শোভাবাজারের দিকে চলো দেখি।
- শোভাবাজার? এখন?
- হ্যাঁ এখনই।
- কিন্তু সে তো অনেকক্ষণের ধাক্কা। আপনার পাণ্ডুলিপি?
- আহা, পাণ্ডুলিপি তো আর পালাচ্ছে না। আপাতত মিত্র কাফের ব্রেন চপ না খেলে তোমার এত চমৎকার ভাবনাটাকে ঠিক অনার করা হবে না। চলো চলো। আমার ট্রিট। না বোলো না আবার। হে হে!
- পাগল! এতে না বলে কেউ! চলুন চলুন!
পড়ুন অন্যরকম থ্রিলার : অন্তরা আসলে অন্তরা নয় / রোহন রায়
****************
[অলংকরণ : অভীক আচার্য]
#গল্প #ট্যাক্সি #রোহন রায় #সিলি পয়েন্ট #বাংলা পোর্টাল #silly point #অভীক