অন্তরা আসলে অন্তরা নয়
“শাক্য, প্লিজ হেল্প মি। আমার খুব বিপদ।”
“কী হয়েছে?”
“তুই কথা দে কাউকে বলবি না।”
“তুই আগে একটু শান্ত হয়ে বোস।”
“তুই আগে বল কাউকে বলবি না।”
“রিল্যাক্স। কাউকে বলব না। তুই হাঁপাচ্ছিস। একটু বোস। তোর জন্য কফি করে রেখেছি। আয় আগে খেয়ে নিই।”
“জানলাগুলো দিয়ে দে প্লিজ। তোদের পাড়ার বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে। কেউ শুনে ফেললে কেলো।”
“নে। দিয়ে দিলাম। এবার ঠিক আছে? এরকম করিস না। প্লিজ রিল্যাক্স। টেক ইয়োর টাইম। কফিটা ধীরেসুস্থে শেষ কর। তারপর বল।”
“শোন শাক্য, একমাত্র তুইই পারবি আমাকে হেল্প করতে। তুই যদি আমাকে হেল্প না করিস...।”
“পাগলামি কেন করছিস? আমি আছি তো। আই অ্যাম রাইট হিয়ার। আই উইল হেল্প ইউ। কী হয়েছে সেটা তো বলবি।”
“অন্তরা।”
“কী হয়েছে অন্তরার?”
“বললে তুই আমাকে পাগল ভাববি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ফাইভ হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর।”
“কী ব্যাপারে? কী হয়েছে?”
“অন্তরা আসলে অন্তরা না।”
“মানে?”
“অন্তরা আসলে অন্য কেউ। অন্তরা না।”
“তুই কী বলতে চাইছিস আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। অন্তরা অন্য কেউ মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট?”
“আমার সঙ্গে যে থাকছে সে অন্তরা না। অন্য কেউ অন্তরার রোল প্লে করছে। অ্যান ইমপস্টার।”
“কী বলছিস কী এসব? গাঁজা ফাজা টেনেছিস নাকি?”
“আমি জানতাম তুই আমায় বিশ্বাস করবি না। কেউই আমায় বিশ্বাস করবে না। হয়তো তোর জায়গায় ত্থাকলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট।”
“কী করে বুঝলি?”
“আই হ্যাভ সেভেরাল প্রুভস।”
“যেমন?”
“অন্তরার ব্রেন একটা সুপার কম্পিউটার। কোনওদিন কিচ্ছু ভোলে না। কিন্তু আজকাল কিছু কিছু জিনিস ভুলে যাচ্ছে। এবং ভুলে যাওয়াগুলো খুব সন্দেহজনক। ক্রেডিট কার্ডের পিন ভুলে যাচ্ছে। জি পে-র পিন ভুলে যাচ্ছে। কোন অ্যাকাউন্ট থেকে কোন পলিসির টাকা ডিডাক্ট হয় ভুলে যাচ্ছে। দিস ইজ নট পসিবল।”
“এটা একটা কথা হল? মানুষ তো আর সত্যি সত্যি কম্পিউটার নয়। হতেই তো পারে কোনও কারণে স্ট্রেস বেড়েছে সেইজন্যই এগুলো হচ্ছে।”
“দ্যাটস নট অল, শাক্য। শপিং মলে গিয়ে অন্য ব্র্যান্ডের লিপসটিক কিনছে। ফুললি ভেগান হয়ে গেছে। আরও শুনবি? রামকৃষ্ণের কথামৃত পড়ছে! ভাবতে পারছিস?”
“কথামৃত? অন্তরা?”
“ইয়েস। ক্যান ইউ ইম্যাজিন?”
“ভেরি শকিং। কিন্তু দ্যাখ, মানুষ তো শালগ্রাম নয়। কেউই সারাজীবন অবিকল একইরকম থাকতে পারে না। অন্তরা হয়তো কিছু কিছু চেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাতে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজছিস কেন? দশ বছর আগের তুই আর এখনকার তুই অনেক আলাদা। আমিও তাই। সবাই কমবেশি বদলায় পার্থ। এগুলো কোনও যুক্তি হতে পারে না। কয়েকটা ছেঁদো পয়েন্ট ধরে তুই এরকম অ্যাবসার্ড একটা কথা ভাবলি কী করে?”
“একসঙ্গে এতগুলো চেঞ্জ সম্ভব?”
“আনইউজুয়াল। কিন্তু অসম্ভব বলা যায় না। এর চেয়ে অনেক বড় বড় মিরাকিউলাস চেঞ্জের নমুনা পৃথিবীতে রয়েছে। তোর বরং এই নিয়ে অন্তরার সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। চেঞ্জগুলো যখন আচমকা হচ্ছে, তখন হতেই পারে ও কোনও সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মোস্ট পসিবলি স্ট্রেস। অফিস বা অন্য কোনও কারণে ওর এক্সেসিভ স্ট্রেস হচ্ছে কিনা সেটা তো তোর খোঁজ নেওয়া উচিত। শি নীডস সাপোর্ট, পার্থ। আর তুই কিনা এসব আলতুফালতু কথাবার্তা বলছিস? তুই এতটা ইনসেনসিটিভ কবে থেকে হয়ে গেলি?”
“শাক্য, আমরা তো একসঙ্গে থাকি। একে অপরের ভাইব টের পাই। এবং তুই জানিস আমরা মোটের ওপর হ্যাপি কাপল, আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঠিকঠাক। এরকম একটা কথা যখন বলছি, অকারণে বলছি না নিশ্চয়ই। স্পাউস সম্পর্কে এরকম একটা কথা কি এমনি এমনি বলব? বোঝার চেষ্টা কর। শুরুতেই এত জাজমেন্টাল হয়ে গেলে আমার কথাগুলো তোকে বলব কী করে?”
“সরি। আসলে কথাটাই এমন... যাক গে, তুই বল। এক্স্যাক্টলি কী মনে হচ্ছে তোর?”
“এটা ডেফিনিটলি অন্য কেউ।”
“বেশ। কবে থেকে তোর মনে হচ্ছে যে এটা অন্য কেউ?”
“হপ্তা দুয়েক।”
“হপ্তা দুয়েক টানা এইসব গণ্ডগোল খেয়াল করছিস? তার আগে কিছুই ছিল না? শিওর তো?”
“অ্যাবসোলিউটলি শিওর।”
“তাহলে কী ভাবছিস? কী করবি?”
“কী করি বল তো? পুলিশের কাছে যাব?”
“পুলিশের কাছে? কী কংক্রিট প্রমাণ আছে তোর কাছে? পুলিশ হেসে উড়িয়ে দেবে।”
“আছে। মোক্ষম একটা প্রমাণ আছে।”
“কী প্রমাণ?”
“বলতে একটু কেমন কেমন লাগছে। কথাটাই সেরকম। তুই বলেই বলছি। যেহেতু তুই আমার অনেকদিনের বন্ধু।”
“ভূমিকা করিস না। বল।”
“অন্তরার ডান হাঁটুতে একটা লাল জড়ুল ছিল। সেটা এখন আর নেই।”
“কী বলছিস?”
“সত্যি। এবার জড়ুল তো আর ধুয়ে যাবার জিনিস নয়, বা মার্বেলের মতো ফস করে হারিয়ে যাবার জিনিস নয়।”
“আর ইউ সিরিয়াস?”
“নিজে অফিস কেটে তোর মিটিং ক্যানসেল করিয়ে তোর বাড়ি এসে বসে আছি ফালতু একটা ইয়ার্কি মারার জন্য?”
“না সেটা বলছি না। বাট দিস ইজ রিডিকুলাস।”
“দিস ইজ ফ্যাক্ট।”
“আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।”
“জড়ুল ছিল, এখন নেই। এতে ভুল বোঝাবুঝির কী আছে? হাসছিস কেন?”
“না না। তুই এমনভাবে কথাটা বললি, হাসি পেয়ে গেল। সরি। ভাবিস না বিষয়টাকে ডাইলিউট করছি। কিন্তু তোর কথা শুনে টেনিদার একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। জড়ুল হারিয়ে যাওয়ার কেস।”
“টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সিন্ধুঘোটক।”
“এখানেও তাই হয়েছে। ওখানে টেনিদা কম্বলরাম সেজেছিল। এখানে অন্য কেউ অন্তরা সেজে আছে।”
“কে সে?”
“সেটাই তো প্রশ্ন। কে? হু ইজ দ্য ইমপস্টার? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে কেউ কেন এটা করবে?”
“এক্স্যাক্টলি। কেউ কেন এটা করবে? তোর কী মনে হচ্ছে?”
“আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি তো ম্যাঙ্গো পিপলের মধ্যেই পড়ি। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আহামরি কিছু নয়। হ্যাঁ, কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে, কিন্তু সেটাও এমন কিছু নয় যার জন্য কেউ এরকম লেভেলের ফ্রড করার কথা ভাববে। প্লাস্টিক সার্জারির খরচ তো কম না। তাছাড়া সত্যিই যদি অন্য কেউ হয় তাহলে সেটা প্রমাণ করা খুব একটা শক্ত কাজ না। আধার কার্ডে চোখের মণি, আঙুলের ছাপ সবই থাকে। তাহলে এত বড় রিস্ক কেউ নেবে কেন? আমার কাছ থেকে কারোর কী পাবার থাকতে পারে?”
“তুই কি বলতে চাইছিস অন্তরাকে অ্যাবডাক্ট করে রেখে এই মহিলা অন্তরা সেজে তোর সঙ্গে থাকছে?”
“মে বি।”
“কিন্তু কেন পার্থ? গিভ মি আ ভ্যালিড রিজন। কেন?”
“জানি না। হতে পারে কোনও প্যারানর্মাল ব্যাপার। অন্তরা হয়তো পজেস্ড।”
“কী বলছিস ভেবে বলছিস তুই? পজেস্ড হলে জড়ুল হাপিস হয়ে যাবে কেন? দেহটা তো একই থাকবে।”
“তাও বটে। ঠিকই বলেছিস। তাহলে পজেশন না। অন্য কেউই অন্তরার রূপ ধারণ করেছে।”
“পার্থ, দিস ইজ টু মাচ।”
“পৃথিবীতে কত কিছুই তো আছে হোরেশিও...।”
“না। প্লিজ। এটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বি লজিকাল।”
“প্যারানর্মাল কিছু না হলে আর একটাই সম্ভাবনা পড়ে থাকে। পার্সোনাল রিজন।”
“পার্সোনাল রিজন মানে কী বলতে চাইছিস? প্রতিশোধ?”
“মে বি।”
“এরকম কেউ থাকতে পারে? ভালো করে ভাব।”
“ভেবেছি। এরকম একজনই থাকতে পারে।”
“কে?”
“সৌম্য। আমার এক্স কলিগ।”
“কেন তুই কী করেছিলি?”
“বলতে খারাপই লাগছে... আমি ওর বউয়ের সাথে শুয়েছিলাম।”
“আই কান্ট বিলিভ দিস!”
“কেন? আমি কারোর বউয়ের সঙ্গে শুতে পারি না?”
“না, মানে তুই সেরকম নোস বলেই জানতাম।”
“মানুষ তো শালগ্রাম নয় শাক্য!”
“এটা কবেকার কথা?”
“বছর পাঁচেক। বেশ কিছুদিন চালিয়েছিলাম। সৌম্য লালুভুলু টাইপের ছেলে। কিছুই টের পেত না। ফলে আমাদের সাহস বেড়ে যাচ্ছিল। রঞ্জিনী এমনিতেই ডেসপারেট। ওর হাওয়া লেগে আমিও ডেসপারেট হয়ে উঠলাম। ফিল্ডের নাম করে অফিস কেটে যখন তখন ওদের ফ্ল্যাটে হানা দিতে শুরু করলাম।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী? সৌম্য একদিন আমাদের ধরে ফেলল। কী হল? ঘামছিস কেন? এনিথিং রং?”
“না না। বল। তারপর কী হল?”
“আমার মনে হয় সৌম্যই প্রতিশোধ নিচ্ছে। নেওয়াই উচিত। আমি আর রঞ্জিনী দুজনেই শাস্তি ডিজার্ভ করি। তাই না? তোর কী মনে হয়?”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই।”
“কেউ কারোর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তেই পারে। সেটা সে সাপ্রেস করবে কিনা তার চয়েস। বিষয়টা মিউচুয়াল হলে তো কোনও কথাই নেই। তারা নিজেদের পথ দেখে নিতেই পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, লুকিয়ে কেন? হোয়াই? যা করেছ তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস নেই কেন? সৌম্যকে আমরা দিনের পর দিন ঠকিয়েছি, শাক্য। কাউকে ভালোবাসা অপরাধ নয়। কাউকে ঠকানো অপরাধ। এবং সে অপরাধ আমার মতে ক্ষমার অযোগ্য। তুই কী বলিস?”
“আমি কী বলব। এটা এতটাই পার্সোনাল একটা বিষয়...।”
“সৌম্য কী দেখে আমাদের ধরল জানিস? একটা লাইটার। রিভলভারের মতো দেখতে একটা লাইটার। মেড ইন জাপান। লাইটারটা আমার। সৌম্যর বাথরুমে আমি ফেলে এসেছিলাম। সৌম্য ভালোই চিনত সেটা। তোর কি শরীর খারাপ লাগছে শাক্য? জল খাবি?”
“না না।”
“কিছু বলবি মনে হচ্ছে? বলে ফ্যাল। কথা চেপে রাখিস না। গ্যাস হয়। বলে ফ্যাল।”
“পার্থ, আমাকে ক্ষমা কর। আমি তোকে অনেকবার বলতে চেয়েছি। অন্তরা আটকে দিয়েছে। আমাকে ক্ষমা কর পার্থ। আই অ্যাম সরি।”
“এটা অন্তরা নয় শাক্য। এটা অন্য কেউ। অন্তরা হলে দিনের পর দিন আমাকে ঠকাতে পারত না। অন্তরা ইজ ডেড। ইনি তোর শয্যাসঙ্গিনী। ইনি আমার কেউ নন। এঁকে আমি চিনি না।”
“আই অ্যাম রিয়েলি রিয়েলি সরি, পার্থ।”
“যখন তুই জড়ুলের কথাটা শুনে ওরকম কনফিউজড হয়ে গেলি, তোর মুখটা যা দেখতে লাগছিল না? আরেকটু হলে হেসে ফেলতাম। অন্তরার হাঁটুতে কোনওদিনই কোনও জড়ুল ছিল না, সেটা আমিও জানি তুইও জানিস। আর বলাই বাহুল্য সৌম্য নামে আমার কস্মিনকালেও কোনও বন্ধু ছিল না, অন্তরা কিছু ভুলেও যাচ্ছে না, এবং আমাদের বাড়িতে কথামৃতর কোনও কপি নেই।”
“প্লিজ পার্থ, প্লিজ আমায় ক্ষমা কর।”
“তুই কাঁদছিস, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে তোর মনুষ্যত্ব এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। যাক, তাও ভালো। চলি রে। আর বসব না। এরপর অন্তরার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
“ব্যবস্থা মানে?”
“মানে তোকে যেটা করলাম।"
"কী করলি?"
"কফিতে বিষ। তুই যখন জানলা দিচ্ছিলি।”
“পার্থ!”
“সরি শাক্য। আই অ্যাম রিয়েলি সরি।”
****************************
অলংকরণ: অভীক
#গল্প #অন্তরা #থ্রিলার #রহস্য #বাংলা গল্প #ছোটগল্প #রোহন রায় #সিলি পয়েন্ট # বাংলা পোর্টাল # ওয়েবজিন #web portal