নাটক বন্ধ কর তো!

খুব কমন ডায়লগ। পলিটিক্যালি কারেক্ট না থেকে নাট্যকর্মীরাও বলে থাকেন। এই কথা মানুষ তখনই বলে, যখন সে বিরক্ত। অপরের কথা শুনতে নারাজ। একজনের বিরক্তি যদি তার নিয়ন্ত্রণে না থাকে, চারিপাশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আপনার কথা শুনতে নারাজ একটা সমাজ, তৈরি হবেই। বক্তার বাগ্মিতার থেকে শ্রোতার শ্রবণ যেদিন বেশি মান্যতা পাবে, সেই দিনই ধরে নেবেন– সুদিন আসন্ন।
ভোটের গরম বাজারে সবাই সবাইকে চুপ করানোর তালে আছেন। জনগণমনের ‘ইঁদুর কল’ নাট্যটি চুপ করানোর মতোই। তাই একদল ষণ্ড এসে পালা ভঙ্গ করে পালাল। ঘটনাটি ঘটে ক্যানিং-এ। ফেসবুকে ঘুরছে ভিডিও। বন্ধ করার আগের অবস্থাটা একটু ভেবে দেখুন, গ্রামবাসী, পথচলতি মানুষের ভিড় সেখানে রমরম করছে। ইঁদুর কল যেখানেই যাচ্ছিল ভিড় হচ্ছিল। নিজে দুবার সেই ভিড়ের সাক্ষী। আসলে সেইদিনকার ভণ্ডুলবাজেরা এই ভিড়কে চিৎকৃত মিথ্যার আবৃত্তি ছাড়া আর কিচ্ছু শুনতে দিতে চান না। কিন্তু কেউ তো শুনে ফেলছিল। নাটকটা বন্ধ করার পর ওই ভিড়ের একজন হয়তো ভাবছিল, ‘আমি যেটা ভাবছিলাম এরা কি সেটাই বলছিল? ওরা কী বলতে চাইছিল? সবাই মিলে আমাদের বোকা বানাচ্ছে ? এটাই? না হলে ওদের থামাবে কেন?’ ভাবনা ঘুণপোকার মতো। তা ক্ষমতাকে ছারখার করে দিতে পারে । এই ভাবনার ঘুণপোকা তাড়ানোর নানা ওষুধ। কোনোটা দীর্ঘস্থায়ী ফলপ্রদ। কোনোটা শীঘ্র আরামদায়ী। প্রয়োজন যেমন তেমন চিকিৎসা।
যেমন ধরুন বীরকেষ্ট দাঁ এর সেই সংলাপ– ‘এটা অশ্লীল! পাশে রাঁঢ় নিয়ে বসে দেখা যায় না।’ অশ্লীলতা শব্দটি এমন একটা ডিফেন্স মেকানিজম যা ভেদ করা ভীষণ শক্ত। সমাজস্বীকৃত ভাবে এই শব্দের ক্ষমতায় যুক্তিকে খাটো করে এঁড়ে তক্কো জোড়া যায়। একটা ‘অশ্লীল’ গল্প বলি। আমি তখন এক আবাসিক কলেজে পড়ি, থার্ড ইয়ার। সেখানে বাৎসরিক নাট্য প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতার আগে নাটকের কপি জমা দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। দিলাম। আমাদের ডাক পড়ল। বলা হল নাটকটা ‘অশ্লীল’। কেন? কারণ নাটকটা ২০১২ দিল্লি ধর্ষণ কাণ্ডের প্রতিবাদে তৈরি। তাই নাটকটার অভিনয় না হওয়াই ভালো। আমাদের চারজনের দলের কাপ্তেনবাবু মাথা নোয়ালেন না। আমরা সবাই কর্তৃপক্ষের মুখের উপর নাটকটি ছুড়ে মারলাম। অভিনয় হল, প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়ও স্থানও পেলাম। তার থেকেও বড় কথা, চিনতে শিখলাম এইরকম (এক্ষেত্রে অশ্লীলতা) আড়ালগুলোকে। জীবনটা কলেজের থার্ড ইয়ার নয়। কলেজে নাম্বারের ভয় থাকে, বাইরে প্রাণের ভয়। কাজেই এখানে মুখের উপর নাটক ছুড়ে মারা অত সহজ না। ২০১৮ ডিসেম্বরে গরিফা নয়াবাজার মোড়ে ‘আদাব’ নাটকের অভিনয় বন্ধ করা হল। সিদ্ধার্থ ও অন্বয় দুজনকে থানায় নিয়ে গেছে। দুজনেই বন্ধু। ওদের কাছ থেকে শুনেছিলাম ওসি বলেছেন যে তিনি আবৃত্তি-টাবৃত্তি করেন– গান-টান গান, তিনি সাংস্কৃতিক মানুষ। কিন্তু ওখানে ‘আদাব’ নাটক করাটা ঠিক না । টেনশনের এলাকা, ওখানে নাটক না করে স্টেজে করা ভালো। সাংস্কৃতিক মানুষের পরামর্শ, বোঝো ঠেলা। ওসির আড়ালটা এখানে ‘সাংস্কৃতিক’। এটি এমন একটা শব্দ যার প্রয়োগে নিজেকে সেন্সর বোর্ড বানিয়ে ফেলা যায়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি গানে বলা হয়েছে, ‘তুমি সব ধরনের অঙ্ক পাকিস্তান দিয়ে গুণ করেছ’। বোঝাই যাচ্ছে পাকিস্তানের টনিকও এইরকম একটি দীর্ঘস্থায়ী ফল দেয়। ভোটের আগে সার্জিকাল স্ট্রাইক হলে তো আর কথাই নেই। যুক্তির অভাব পড়লেই যে-কোনো স্থানে এর ব্যবহার করা যায়। ছোটবেলা থেকে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের দৌলতে বড়বেলার মানুষদের উপরেও এই টনিক কাজ করে।

মার্ক্সবাদী দার্শনিক আলথুজার এই ব্যাপারটার নাম দিচ্ছেন ইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাস। সত্যজিৎ রায় এর নাম দিচ্ছেন মগজ ধোলাই যন্ত্র। নির্দিষ্ট একটা চশমা দিয়ে দুনিয়াটাকে দেখতে শেখানো। এঁড়েরা এই আড়াল খুঁজে নিয়ে গত্তে মুখ ডেকে নিজের জীবন, জিডিপি ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় কথা এড়িয়ে চলে।
যখন চশমায় কাজ দেয় না, তখন আসে আইনকানুন। আলথুজারের ভাষায় রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস। আজকের ভারতের রাজামশাইয়ের ভাষায় এটিই হল, শাইনিং ইন্ডিয়া। ১৮৭৬ সালের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন এখনও আছে, জানেন! ক্লাস টেনের সিলেবাসে না। প্রতিটি রাজ্য সরকারের হাতে নাটক থামানোর ক্ষমতা আছে এই আইনের সুবাদেই। এই কালা আইনের ক্ষমতায় ব্রিটিশ শাসক জেলে ভরেছিল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অমৃতলাল বসু, উপেন্দ্রনাথ দাস, মতিলাল সুরদের। তাঁরা ব্রিটিশ ও ভারতীয় বাবুদের যৌথ নিন্দা করেছিলেন ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ নাটকে। ভারত স্বাধীন হয়, ব্রিটিশরা বাড়ি যায়। নাটক বন্ধ করানোর আইন বলবৎ থাকে। সাধারণ মানুষ পুলিশে ভয় পায়। আইন শুনলে আঁতকে ওঠে। তাই মগজ ধোলাই করার পরও যেটুকু বিবেচনাশক্তি বাকি থাকে, আইনের ভয়ে তা আটকে যায়। ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নেন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্সেস বিল’ আনবেন। পুরোনো নাট্য আইনের নাম বদলে তাকে আরেকটু কড়া করে, নতুন ধাঁচে গড়ে তোলার চেষ্টা। ১৯৬৩তে আন্দোলনের জেরে বিলটি ঠান্ডা ঘরে ভরে দেওয়া হয় পুনর্বিবেচনার জন্য, ও সেখানেই বিলের মৃত্যু হয়। কিন্তু নাটক থামানো বন্ধ হয়নি। ১৯৬৯ সালে ভারতে এই আইনের দৌলতে বন্ধ হওয়া নাটকের সংখ্যা ১১৩৬। ১৯৭৪-এ ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রশাসন ও গুন্ডাবাহিনীর মদতে। আইনের জাঁতাকল দৃঢ় করতে দেশে নেমে আসে অন্তবর্তীকালীন জরুরি অবস্থা। মঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে কার্জন পার্কে, কলকাতার পথেঘাটে ছোটখাটো নাট্যদলগুলির নিয়মিত অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। কথায় বলে আইনের আঁট বাড়লে ফাঁক বাড়ে। প্রজ্ঞানন্দ ভবনে এমার্জেন্সির সময়ে বাদল সরকারের ‘ভোমা’ অভিনয় হয়। লুকিয়ে। আন্ডারগ্রাউন্ড বলতে যা বোঝায়, সেভাবেই। ছয়টি শো, ছয়টিই হাউজফুল। লুকিয়েচুরিয়ে এভাবেই নাটক চলেছে। সময়ের প্রয়োজনে স্থান বদলেছে। রূপ বদলেছে থিয়েটার। নাট্যকর্মীরা পথে থেকেছে দীর্ঘদিন। নাট্যকর্মীদের পথ থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে এমন এমন ধারা দিয়েছে যার কোনও অর্থ নেই। এ দেশে আইন জনতার পক্ষে নেই, ক্ষমতার পক্ষে। তাই আইনের দোহাই দিয়ে যে-কোনো কিছু বন্ধ করানো খুব সহজ।
আর সব শেষে আসে আড়ং ধোলাই। পথের থিয়েটারেই যা নেমে আসার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু মঞ্চের ক্ষেত্রেও আজকাল দেখা যাচ্ছে ধোলাইয়ের তরলীকৃত অসভ্যতা, ‘বাওয়াল’। ‘রগড়ে’ দাও। কতকটা যেন তাই। কল্যাণীতে ‘দেশের নামে’র শো বাতিল হয়। ‘কোজাগরী’র শেষে চলে গণ্ডগোল। সেই কোন কালে ভাটপাড়ার ভট্টাচার্যরা পিটিয়ে নাটক বন্ধ করতে গেছিলেন চুঁচুড়ায়। আজও ১৯৮৯ সাল বললে সফদার হাশমির জন্য আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু ওই দিন শুধু একজন অভিনেতা মারা যাননি। একজন দর্শকও মারা গেছিলেন। ভগবান সিং। ধোলাই দিলে শুধু কথা বন্ধ হয় না, সাথে সব কিছু সিধে হয়ে যায় ত্রাসে। এক জায়গায় ঠিকঠাক পেটাতে পারলে আরও দশ জায়গায় নাটক বন্ধ করে দেওয়া যায় শুরুর আগেই। দর্শকই ভয়ে আসবে না। দেখবেটা কে? অভিনেতারা মরে। কিন্তু দর্শকের জন্যই এত কিছু, সে-ই যদি মরে যায়, তা হলে? নাটক বন্ধ হয়ে যাবে। এই পাকা বন্দোবস্ত কিন্তু অনেক দিনই হচ্ছে। থিয়েটারকে ভয় পায় যারা তাদের জন্য থিয়েটার তুলে দেওয়া, অ্যাপেন্ডিক্স কেটে বাদ দেওয়ার মতো অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার। কিন্তু কাটার চেষ্টা সে করছে, কারণ অ্যাপেন্ডিক্সের যন্ত্রণা তাকে কাতর করছে। থিয়েটার সরকারের মদতপুষ্ট হয়ে স্বাস্থ্য অর্জন করে এমনটা ইতিহাস বলে না। বরং বিপরীত কথাই প্রমাণ করে। ফলত ওষুধের ডোজ বাড়বে। মগজ ধোলাই ও আড়ং ধোলাই তাল মিলিয়ে বিকশিত হবে। তার মধ্যেও চিন্তার ঘুণপোকা যদি পাক খায় আপনাকে কেউ না কেউ বলে বসবেই, ‘থাম তো, অনেক নাটক করেছিস!’