আখ্যানের খোঁজ (দশম পর্ব)

নবম পর্বের পর
........................
২১
কিন্তু কলকাতা থেকে একদিন বৃষ্টি হারিয়ে গেল। হারিয়ে যাওয়া খাস খবরে ভেসে উঠল নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা। সংবাদপত্রে বেরোল নিখোঁজ কলাম। বৃষ্টি পদবিহীন। উচ্চতা অত ফুট তত ইঞ্চি। হঠাৎ করেই নিখোঁজ। হারিয়ে যাওয়ার সময় পরনে ছিল মেঘ রঙের শাড়ি। কপালে কালো টিপ।
অথচ বৃষ্টিকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এক বৃষ্টিহীন গ্রীষ্মে আখ্যান এসে দাঁড়াল কলকাতা মেট্রোয়। সেখানে এসেই আখ্যান দেখতে পায় এক আশ্চর্য বিজ্ঞাপন।
“মন খারাপ?
কিছু বলতে চান?
জীবনের ভার বইতে পারছেন না?
একা লাগছে?
কথা বলুন আমাদের সঙ্গে”
বলে একটা টেলিফোন নাম্বার দেওয়া। কেউ কি সত্যিই ফোন তোলে এখানে? ভাবতে ভাবতে আখ্যান ফোন করেই ফেলল। শীতরাতের মতো দীর্ঘ একটা রিংটোনের পর ওপার থেকে ভেসে এল গলা।
-শেষ পর্যন্ত তাহলে ফোন করলেন?
আখ্যান অবাক!
-আপনি আমায় চেনেন?
-চিনি না। তবে আমি জানতাম আপনি ফোন করবেন। আপনার ফোনের অপেক্ষায় আমি কতদিন বসে আছি। আসলে আপনার ফোনটা না এলে আমি চাকরি থেকে ছুটি পাচ্ছিলাম না। বড্ড সময় লাগালেন।
-মানে? কীসের চাকরি? আপনার চাকরির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?
-আপনার সঙ্গেই সম্পর্ক। আর কেউ কখনও এই নাম্বারে ফোন করেনি। আর কেউ কখনও এই নাম্বারে ফোন করবে না। এই একটা মানুষের জন্যই তো নাম্বার।
আখ্যান বুঝতে পারছিল না কিছু। একটা ভ্যাপসা গরমের দুপুরে আমাদের ঘামে ভেজা আখ্যান ঢুকে পড়েছিল মেট্রো স্টেশনে। বাড়ি ফিরবে বলে। কদিন থেকেই আখ্যানের প্রচণ্ড মনখারাপ। যে-কোনো মানুষ যে-কোনো অবান্তর খোঁজ দীর্ঘদিন চালিয়ে গেলে তার মন খারাপ হতে বাধ্য। তারপর তার পরিবারের প্রায় সমস্ত সঞ্চয় হঠাৎ করেই যেন ভেসে গেছে এক অলীক নৌকোয়। সেও এক বাড়ির খোঁজেই। নিজেদের বাড়ি বলতে আখ্যানের যা আছে তাকে ঠিক বাড়ি বলা চলে না। তার সমস্ত খুদকুঁড়ো জড়ো করে আখ্যানের বাবা এক ঘর কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঘর কেনা হল না আর। আইন আর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রোমোটারের চক্রব্যূহে একা অভিমন্যুর মতো হারিয়ে গেল জীবনের সমস্ত সঞ্চয়। আখ্যানের মা আগে থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ। এই ধাক্কায় তাঁর বাস্তবের সঙ্গে সমস্ত সুতো ছিঁড়ে গেল। বাসা ছেড়ে চলে আসার এক অন্ধ ভয় তো তাড়া করে এসেছে শৈশব থেকে। আবার বাসা না বাঁধতে পারার ভয় যেন খুলে দিল সেই অন্ধকার স্মৃতির দরজা। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই আমাদের আখ্যান এক ঘর খুঁজে দেওয়ার চাকরি করে চলল।
এখন আখ্যানের যা অবস্থা, তাতে জীবনের ভার দুঃসহ লাগারই কথা। যদিও আত্মহত্যার কথা আখ্যান অনেকদিন ভাবে না। এই ঘরটা না খুঁজে পেলে আখ্যানের মরেও মুক্তি নেই। প্রত্যেকদিন সে দ্যাখে রাগি সাপ চেয়ে আছে শহর কলকাতার অন্ধকার গলিগুলোর থেকে। ওরা মৃত্যুর পরেও যে পিছু ছাড়বে না তা আখ্যান বোঝে। কিন্তু আজ মেট্রোতে হঠাৎ এক অদ্ভুত বিজ্ঞাপন দেখে আখ্যানের কৌতূহল হল। মৃত্যুকাম মানুষের সঙ্গে যে কথা বলতে চায় সেই মানুষটার প্রতি কৌতূহল। তাই তো আখ্যান ফোন করল সেই আশ্চর্য নাম্বারে। আর সেই ফোনই আখ্যানকে বুঝিয়ে দিল, আজব আর উদ্ভট চাকরি আখ্যান একা করছে না।
ফোনের ওই প্রান্তের মানুষ তখন বলতে শুরু করেছে এক আশ্চর্য গল্প। কে যেন একদিন তাকে পাঠিয়েছিল এক অদ্ভুত মেল। যেখানে ছিল চাকরির অফার। একটা অন্ধকার ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। সেইখানে গোল হয়ে আসা হলুদ আলো। আর একটা পুরোনো দিনের টেলিফোন। নাম্বার-কি নেই। ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করতে হয়। অথচ সেই ডায়াল ঘোরানোর নাকি প্রয়োজনই পড়বে না কখনও। ফোন করতে হবে না কাউকে। ফোন আসবে। আর একটাই ফোন। সেই ফোন পেলেই মুক্তি। অন্ধকার ঘরে আর ফিরে যেতে হবে না। গোল হলুদ আলোয় একজন একলা মানুষ আর টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে না। কন্ট্র্যাক্ট শেষ হয়ে যাবে।
এই পৃথিবীতে কত মানুষই তো আছে। চাকরি যাদের পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছে। ভালো লাগে না চাকরি করতে। অথচ করতেই হয়। তাদের চোখ পড়ে থাকে অফিসের জানলায়। তারা চাকরি শেষের দিন গোনে। আর তারপর একদিন চলেই আসে মুক্তি পরোয়ানা। এই যেমন আপনি ফোন করলেন…
ফোনে হারিয়ে গিয়েছিল আখ্যান। হঠাৎ চমকে উঠে দেখল তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশ। একজন তাকে জাপটে ধরেছে। মেট্রোর ভরা স্টেশনে এমন দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে অনেকেই। একজন পুলিশ ফোনে জানাচ্ছেন যে খবর আসা মানুষকে তাঁরা উদ্ধার করতে পেরেছেন। আত্মহত্যার জন্য আজকে কলকাতার কোনও মেট্রো চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে না।
২২
আপনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন কেন?
সকালের আলোর মতো মিষ্টি এক স্বর ঈষৎ নাকি সুরে প্রশ্ন করল আখ্যানকে। সেদিন কলকাতার সমস্ত সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছিল, মেট্রো রেলওয়ের সাফল্য! আত্মহননেচ্ছু যুবকের ফোন পেয়ে তৎপর মেট্রোর আপৎকালীন হেল্প ডেস্ক। রেল পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার যুবক।
আখ্যান কাউকে বোঝাতে পারেনি সে সুইসাইড করতে চায়নি। নিছক কৌতূহলবশত ফোন করেছিল বিজ্ঞাপনে দেওয়া সেই নাম্বারে।
-আমি কিন্তু শুনছি। নীল রঙের পেন টেবিলে হালকা ঠুকে বললেন ডাক্তার।
- শুনছেন। কিন্তু বিশ্বাস করছেন কী?
-উম্ম.. আমার বিশ্বাসের কথা থাক। এইটুকু বলতে পারি, আপনাকে অবিশ্বাস করছি না।
পুলিশের দৃঢ় আলিঙ্গন আখ্যানকে নিয়ে গিয়েছিল সরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর আখ্যানকে রেফার করে দেওয়া হয় এক মনস্তত্ত্ববিদের কাছে। এখন আখ্যান তাঁর সামনেই বসে।
এই পৃথিবীর সব মানুষের জিন এক নয়। কোনও কোনও মানুষের চাহনিতে টাটকা জুঁইফুলের হাসি। মৃদু কণ্ঠ হারিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। অথচ সমস্ত শব্দের গায়েই লেগে আছে আশ্বাসের রং। আখ্যানের বড় শান্ত লাগছে। তার ইচ্ছে করছে এই আলোমানুষের কাছে আর-একটু বসি। অথচ এই পৃথিবীতে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্টই অনন্তকাল নয়।
-আপনি কি আর কিছু বলবেন, না আমার পেনের দিকেই চেয়ে থাকবেন? মৃদু শব্দে হাসি মিশিয়ে ডাক্তার বললেন।
আখ্যান খানিক অপ্রস্তুত।
-আসলে আপনার পেনটা এত সুন্দর।
- এইটা আমার খুব প্রিয় পেন। অবশ্য আগে আর-একজনের প্রিয় ছিল। আমি তার বুকের থেকে খুলে নিয়েছি।
- সে দিয়ে দিল?
- আখ্যান, আমরা সম্ভবত আজ আপনাকে নিয়ে কথা বলছি। আমার কথা আপাতত থাক। সেই ঘর খোঁজার চাকরিটার কথা বলছিলেন? সেটা আর-একবার বলুন। একটু নোট নিতে হবে..
তারপর একসময় আলোমানুষের ঘর থেকে বেরিয়ে এল আখ্যান। এই সামান্য সময়টুকুতে জীবনের অনেক কথাই বলে ফেলা হল। এখন আখ্যানের মনে হচ্ছে তার জীবনে আর কোনও কথা নেই। জীবনটা হঠাৎ করেই ভীষণ হালকা লাগছে তার। ঘর না পাওয়ার দুঃখ, ঘর খোঁজার ক্লান্তি, সবটা যেন মুছে দিয়েছে কেউ। আখ্যানের মনের উঠোনে এখন ভরপুর রোদ। অনেকক্ষণ হেঁটে একটু বসার জায়গা।
বেশি ওষুধ দেননি ডাক্তার। দিনে মাত্র দুটো। arpiriprazol 5 আর sizodon 2। আসলে দিনে নয়। রাতে। খাওয়ার পর। ওষুধের দোকান থেকে বুঝে নিয়ে মেট্রো ধরল আখ্যান। আজকে রেস্ট। কাল থেকে আবার খোঁজ শুরু।
কালীঘাটের পর যতীন দাস পার্ক। তারপর নেতাজী ভবন। যতীন দাস ছেড়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু নেতাজী আসছেই না। আখ্যানের একটা হিসেব আছে। ব্লু লাইনে যে-কোনো একটা মেট্রো স্টেশন থেকে আর-একটা মেট্রো স্টেশনে যেতে সময় লাগে মোটামুটি দুই মিনিট। যতীন দাস পেরোলে আখ্যানের স্পটিফাইয়ে শুরু হল মাঝ খাম্বাজ। উস্তাদ আলি আকবর খাঁ আর নিখিল ব্যানার্জি। সেটা শেষ হয়ে গেল। আখ্যান দেখল একুশ মিনিট সাতাশ সেকেন্ডের বাজনা। তারপর অটোপ্লেতে চালু হয়ে গেছে আমজাদ আলি খাঁর ছায়ানট। অথচ নেতাজী আসছেই না। মেট্রো যে দাঁড়িয়ে আছে তাও নয়। প্রচণ্ড জোরে ছুটছে। শুধু পরবর্তী স্টেশনের দেখা নেই।
মেট্রোর জানলার বাইরের ছুটন্ত অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে আখ্যান। সেই অন্ধকারের মধ্যে যেন সহস্র সাপ। মেট্রোর গায়ে আষ্টেপৃষ্টে লেগে যাচ্ছে তারা। নাকি তারাই মেট্রোকে টেনে নিয়ে চলেছে কলকাতার তলার অন্ধকারে। অন্য কোনও শহরের অন্য কোনও স্টেশনে। জানলার বাইরে আবার আলো ততক্ষণে। কিন্তু এটা তো নেতাজী ভবন নয়। এই স্টেশনের সব দেওয়াল নীল। মেঝে সাদাকালো চক মেলানো। দেওয়ালে তিনটে তাসের ছবি ফোটোফ্রেমে বাঁধানো। হরতন, রুইতন আর ইস্কাবন।
-ভাই… মাথাটা একটু তুলবে? পরের স্টেশনে আমি নামব।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে আখ্যান। ঘুমের অতল অন্ধকার থেকে তাকে যেন ডেকে তোলে এক দীর্ঘ মানুষ। লোকটার বয়স দেখে আন্দাজ করা যায় না। কোঁকড়ানো কাঁচাপাকা চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। মাথায় কাঁচা চুল শতকরা তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ। মুখভর্তি দাড়ি। সেইখানে অবশ্য পাকা চুলের আধিক্য কম। চামড়া টানটান। সুগঠিত দেহটা ঢাকা আছে পাঞ্জাবিতে। পাঞ্জাবির খোলা বোতাম থেকে বেরিয়ে এসেছে সাদা রোম।
আখ্যান উঠে বসতেই ভাবলেশহীন মুখে নেমে যায় লোকটা। আখ্যান দ্যাখে মেট্রো পার্ক স্ট্রিটে ঢুকেছে।
(ক্রমশ)
..................
[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]
Jayita Dutta
এমন আশ্চর্য মন কেমন করা উপন্যাস , এমন রহস্যময় গড়ন , একাকিত্বের এমন অভিমানহীন অধিকার, স্ফটিক আবেগ আর ইশারার এমন ধারা ইচ্ছে খুশি চোখ ধাঁধানো আলো ফেলা, .. কি জানি, আগে যদি পড়েও থাকি এখন মনে নেই।