লাবণ্যপ্রভা ঘোষ ও ভাবিনী মাহাতো : বিস্মৃতির আড়ালে পুরুলিয়ার বাংলা ভাষা আন্দোলনের দুই মুখ
_1366x1366.jpg)
পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হয়েছিল পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলে, যার সূচনা হয় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে। অথচ বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলন পূর্ববাংলা বা বরাক উপত্যকার আন্দোলনের মতো প্রচারের আলো পায় না। তেমন পরিচিত নাম নন এই আন্দোলনের এক সময়ের প্রধান নেত্রী লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, তৎকালীন পুরুলিয়ায় যিনি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন 'মানভূম জননী' নামে। তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী ছিলেন ভাবিনী মাহাতো। বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য এই দুই নারীর অসামান্য অবদান আজ মনে রাখি না আমরা অনেকেই।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পুরুলিয়ার এক ছোট্ট গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামী নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের ঘরে লাবণ্যপ্রভার জন্ম। নিবারণচন্দ্র নিজে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তিনি একটি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক হলেও সেই শিক্ষার আলো তখনও ছুঁতে পারেনি বাংলার ঘরের মেয়েদের। পুরুলিয়ার মতো গ্রামগঞ্জে তখন স্ত্রীশিক্ষা ব্যাপারটা সমাজের কাছে নেহাতই হাসির উপকরণ মাত্র। তাই বিদ্যালয় অবধি পৌঁছাতে পারেননি লাবণ্যপ্রভাও। তবে থেমেও থাকেননি তিনি। নিবারণচন্দ্রের পরিবারে জন্মগ্রহণের সুবাদেই তাঁর বিপ্লবী শিক্ষার, চেতনা-মুক্তির পাঠ শুরু হয়েছিল অনেক ছেলেবেলা থেকেই। সময়ের নিয়মে মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায় অতুলচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে, যিনি ছিলেন পুরুলিয়ার তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা।
লাবণ্যপ্রভা দেবীর বাবা ও স্বামী দুজনেই পুরুলিয়ার উন্নতিকল্পে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত এবং গ্রেপ্তার হন। এরপর লাবণ্যপ্রভা যুক্ত হোন কংগ্রেসের সঙ্গে। জোর কদমে চলতে থাকে তার সংগ্রামী কর্মকাণ্ড। নিবারণ দাশগুপ্ত ও অতুলচন্দ্র ঘোষের মিলিত উদ্যোগে পুরুলিয়ার তেলকলপাড়ায় স্থাপিত হয় 'শিল্পাশ্রম'। এর মাধ্যমে চলতে থাকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বৈপ্লবিক কাজকর্ম। গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস সকলেরই আনাগোনা ছিল এই আশ্রমে। লাবণ্যপ্রভা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন এই আশ্রমের সঙ্গে। নিবারণচন্দ্র একটি দ্বি-সাপ্তাহিক সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল ‘মুক্তি'। নিবারণচন্দ্রের অবর্তমানে লাবণ্যপ্রভার স্বামী অতুলচন্দ্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরে দায়িত্ব নেন লাবণ্যপ্রভা নিজে। এই পত্রিকাযই হয়ে উঠেছিল তাঁদের মুখপত্র। স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা বক্তব্য এবং পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই ‘মুক্তি’ পত্রিকা এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
লাবণ্যপ্রভা ঘোষ পুরুলিয়ার প্রথম মহিলা এম. এল. এ হিসাবে নির্বাচিত হন। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। এছাড়াও ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ১৯৪৫-এর পতাকা সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকবার অপরাধে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে বহুবার। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।
অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এলেও প্রকৃতপক্ষে সে স্বাধীনতা দেশের মানুষজন কতটা পেয়েছিল তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ নেই। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেলেও পুরুলিয়া অঞ্চলের মানুষের ওপর তখনও চলছিল শাসকের অত্যাচার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়পর্বে, বিশেষত ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সমগ্র মানভূম অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে পুরুলিয়া ছিল বিহারের অন্তর্গত। কিন্তু পুরুলিয়ার অধিকাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। বিহারের অন্তর্গত হওয়ায় তাদের নিজেদের ভাষা বাংলাকে মুছে দিয়ে তাদের ওপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। স্কুল,কলেজ ও সরকারি কাজে হিন্দি ভাষাকে একাধিপত্য চলতে থাকে। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা করার জন্যই সেদিন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল আপামর পুরুলিয়াবাসী। তবে প্রকৃত বিচারে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে অনেক আগেই। ১৯১২ সাল থেকেই মানভূমে এই ধরনের দাবি নিয়ে সোচ্চার হতে শুরু করেছিল সাধারণ মানুষ। কখনোই পুরোপুরি থিতিয়ে যায়নি ভাষার অধিকার নিয়ে মানভূমবাসীর এই বিদ্রোহ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেই একই দাবি আবার সোৎসাহে মাথা তুলে দাঁড়ায়। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবী শরৎচন্দ্র সেন, রজনীকান্ত সরকার, গুণেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখরা বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে জাতীয় কংগ্রেস দল ত্যাগ করে গড়ে তোলেন আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী দল ‘লোক সেবক সংঘ’। এই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন লাবণ্যপ্রভা দেবী। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য এবং এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে তিন বার গ্রেপ্তার হতে হয়। কিন্তু তা তাঁকে দমিয়ে রাখার পরিবর্তে আরও উদ্বুদ্ধ করতে থাকে প্রতিবার। ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল পাকবিড়া গ্রাম থেকে কলকাতা পর্যন্ত হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এক পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেন তিনি। এই পদযাত্রা শেষ হয় ৭ মে কলকাতা শহরে পৌঁছানোর পর। আর তারপরেই আসে এতদিনের পুরুলিয়ার বাংলা ভাষাপ্রেমী জনগণের বহু আকাঙ্খিত ফলাফল। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের সাথে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয়। জয় হয় বাংলা ভাষার। ভাষা আন্দোলনে তাঁর এই অবদানের জন্য ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা শহীদ স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লাবণ্যপ্রভা দেবী কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই এপ্রিল ১০৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।
এ কাজে লাবণ্যপ্রভার সহযোগী হয়েছিলেন আরও এক ভাষাপ্রেমী নারী। তাঁর নাম ভাবিনী মাহাতো। পুঁথিগত শিক্ষার মাপকাঠিতে অশিক্ষিত বাল্যবিধবা ভাবিনী লাবণ্যপ্রভাদের প্রতিষ্ঠিত শিল্পাশ্রমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। আশ্রমে আগত বিশিষ্ট মানুষজনের বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মন্ত্রে নিজেকে দীক্ষিত করেন। সদস্য হন কংগ্রেসের। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন তিনিও। গান্ধীজীর আদর্শ মেনে শুরু করেন ভাষা সত্যাগ্রহ অর্থাৎ টুসু সত্যাগ্রহ। টুসু গানের মধ্যে দিয়েই নিজেদের ভাষা আন্দোলনকে তুলে ধরেছিলেন ভাবিনী ও তাঁর অনুগামীরা। তাঁদের বাঁধা একটি টুসুগীতির কথাগুলি খুবই আকর্ষণীয় -
“শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই৷”
এরপর হিন্দি ভাষা বিরুদ্ধে নানা পদযাত্রায় সামিল হতে থাকেন ভাবিনী মাহাতো। ১৯৫৪ সালে বিহার সরকার এই আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা ঘোষণা করলে লাবণ্যপ্রভা দেবী, ভজহরি মাহাতো, ভাবিনী মাহাতো স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। এরপরই শুরু হয় কলকাতার উদ্দেশ্যে সেই ঐতিহাসিক পদযাত্রা, যার কথা আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে লাবণ্যপ্রভা দেবীর সঙ্গে ভাবিনী মাহাতোর নামও উঠে আসে শিরোনামে। ২০১৪ সালের ২৪ শে জুন মানবাজারে ৯৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।
আরও পড়ুন : ময়মনসিংহের তেভাগা আন্দোলনে প্রতিবাদের মুখ রাসমণি : এক বিস্মৃত অধ্যায়
আমাদের ইতিহাস আজ ভুলে গেছে লাবণ্যপ্রভা ঘোষকে। ভুলে গেছে ভাবিনী মাহাতোর লড়াইকে। তাই তো সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভাষা আন্দোলনের জন্য রাস্তা কেটে দেওয়া লাবণ্যপ্রভা দেবীকে তাঁর শেষ জীবনটা কাটাতে হয় অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বেঁচে থাকা ভাবিনী মাহাতোর কথা পরবর্তী প্রজন্মের কেউ জানতে চান না। নিদারুণ অবহেলা নিয়ে মরতে হয় তাঁকেও। ইতিহাস বই তাঁদের ভুলে গেলেও বাংলা ভাষার ইতিহাস তাঁদের ছাড়া সম্পূর্ণতা পাবে না কোনওদিন।
...........................
#পুরুলিয়া ভাষা আন্দোলন #মানভূম # বাংলা ভাষা আন্দোলন #লাবণ্যপ্রভা ঘোষ #ভাবিনী মাহাতো #মাতৃভাষা #নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত #টুসু সত্যাগ্রহ #অতুলচন্দ্র ঘোষ #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট