গুলজার ও একটি ‘রাজনৈতিক’ বই

তাঁর সঙ্গে আমাদের সবারই প্রথম পরিচয় গানের হাত ধরে। প্রথম কৈশোর পেরিয়ে গেলেই বুঝতে শেখা যায় তাঁর কথা – কোনও সিলেবাসের পাঠ লাগে না তার জন্য; জীবনই যথেষ্ট। যে কোনও গভীর সাহিত্যের মতোই তাঁর কথা বোঝার কিছু স্তর আছে – একের পর এক প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও বলিউডের যে-সব গ্ল্যামার সবার কাছে অমলিন হয়ে থেকে যায়, তার আলোয় প্রথম চেনা গুলজার সাহাবকে। ইনফ্যাচুয়েশন পেরিয়ে যখন ভালোবাসা গাঢ় হয়, তখন কিছু লেখায় সুর দিয়ে চলেন রাহুল দেব বর্মণ, কণ্ঠে কখনও কিশোর কুমার, কখনও ভুপিন্দর সিং, কখনও বা আশা ভোঁসলে বা লতা মঙ্গেশকর। আবার এরকমই কিছু গাঢ় হয়ে ওঠা ভালোবাসা থেকে যায় সাংঘাতিক নিভৃতে, নীরবে। গ্ল্যামারের আলো থেকে দূরে, সে সব নির্জন পথের ছবিগুলোতেও গুলজারের সেই সব স্পর্শ আসে মানুষের জীবনের অবিচ্ছিন্ন অন্তর্কথন হয়ে। অতি সাংসারিক সাধারণত্বে তাঁর নির্দেশনা বা চিত্রনাট্য যে কাব্য সঞ্চার করে, সেও অজানা নয় কারুরই। জগজিৎ সিংয়ের কণ্ঠে গজল কি সত্যিই অত মুগ্ধ করতো, যদি না গুলজার লিখতেন “খামোশি কা হাসিল ভি এক লম্বি সি খামোশি হ্যায়”? প্রতিটা প্রজন্ম চোখ ফুটে পৃথিবী দেখতে শিখে যখন অনুভব করে, তার সারাজীবনই দুর্বোধ্য রাজনীতির হাজার মোড়কে মোড়া, সে এমন এক পৃথিবীতে বাঁচছে যেখানে ভালোলাগার গান সামান্য গুনগুন করাও গ্লানিময় প্রিভিলেজের চিহ্ন, গুলজার সেই পৃথিবীতে যেন কোন জাদুবলে জীবনের নিখাদ সুখ-দুঃখকে শুধু তাদের সেই তাৎক্ষণিকতায় বলে চলা অপাপবিদ্ধ এক কবিয়াল!
কিন্তু এই এক আশ্চর্য সময়ে – যেখানে তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’, চিরন্তন, ইতিহাসের দায়মুক্ত সুখ বা দুঃখবিলাস একপ্রকার মুছে গেছে আমাদের স্বাভাবিক রোজনামচা থেকে – গুলজার এখনও কেন আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠেন? সাধারণ দৃষ্টি তাঁকে গ্ল্যামারের বাইরে খুঁজে পেয়েছে অনেকদিনই হল – তিনি নিভৃতে সফরকে লিপিবদ্ধ করেন। সেই লেখায় আমরা-ওরা নেই, নেই তরবারির মতো ক্ষোভ, নেই বিচারাধীন মানুষের মুক্তি চেয়ে বিদ্রোহ, বা অস্থির জ্বলে ওঠা। কিন্তু শুধু এটুকুই কি কারণ? কেবল আলুলায়িত দর্শন, ভাবুক লব্জ, কাব্যময় বুনন কি আমাদের এই সময়ে শান্তি দিতে পারে? শেষ কিছু বছরে আমাদের জীবনের বহু শক্তপোক্ত যুক্তি অসঙ্গত রূপকথায় পরিণত হয়েছে, নির্ভেজাল আনন্দও একপ্রকার ইউটোপিয়া। যতই চাই, আজ আর বাস্তববিচ্ছিন্ন গভীর দর্শন, কাব্য শান্ত করতে পারে না।
এই লেখা যখন লিখছি, মুঠোফোনের খবরের অ্যাপে একের পর এক নোটিফিকেশন এসে চলেছে টুংটাং শব্দে – আফগানিস্তানের কোন কোন শহরে ঢুকে পড়ছে তালিবানেরা, একে একে। খবরের কাগজের দিকে তাকাতে ভয় লাগে। মুখ ফিরিয়ে গুলজারের কাব্য যখন হাতে তুলে নিই, আচমকা মুখবন্ধে চোখে পড়ে –
“এমন যেন একটা বাধ্যবাধকতা হয়ে গেছে, যে দিন শুরু হয় খবরের কাগজ দিয়েই।
প্রথম পাতা বিশেষ বিশেষ ভয়ানক সব খবরে ভরা, পড়তে পড়তেই অবসাদ ভর করে। দ্বিতীয় পাতায় তেমন কিছু একটা থাকে না। তৃতীয় পাতায় অবিচুয়ারি, অর্থাৎ যারা মৃত, তাদের ছবি। বেশিরভাগ ছবিই স্মিতহাস্য। এমনকি কিছু কিছু ছবিতে তো বেশ ভালোমতোই হাসি। সবসময়ই মনে হয়, যেন হেসে জিজ্ঞেস করছে :
কবে আসবে? এখনও বেঁচে আছো?”
সেই এক খবরের কাগজ, দুর্বিষহ খবরের ঝাঁপি ছুঁয়েও শেষ অব্দি গুলজারের এক চিলতে দুঃখময় হাসি ফুটে ওঠে – যে হাসি তিনি বারবার হেসেছেন গীতিকার হয়ে, নির্দেশক হয়ে। পুরো ঘটনাটির মধ্যে সবচেয়ে অবাক করে যে বিষয়, তা হল – গুলজার আজকের ছিন্নভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে (যার সঙ্গে তাঁকে ঠিক এক নৌকোয় দেখা যায় না কখনই) ব্রাত্য করলেন না তার লেখায়। বরং, তার উল্লেখ করে এমন এক উপসংহার টানলেন, যাতে এক লহমায় মুছে গেল প্রথম দু’ পাতার ক্লান্তি। মেজাজ ফুরফুরে করে দেওয়া যে কিছু উচ্চারিত হল তার বদলে, এমন নয়; কিন্তু অন্ধকারও কাব্যময় হলে সেদিকে কৌতূহলভরে তাকানো যায়।
এ এক আশ্চর্য বই গুলজারের, ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘সাসপেক্টেড পোয়েমস্’। নীরবতা ভেঙে বিদ্যুচ্চমকের মতো যাপনের কিছু সারসত্যে, নজমে নিজেকে নিমজ্জিত রাখা মানুষটি হঠাৎই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু কবিতা জড়ো করছেন, এবং শুধু হিন্দিতে নয়, একইসঙ্গে ইংরাজি অনুবাদ করে প্রকাশ করছেন আপাতভাবে অ-গুলজারোচিত একটি বই। মুখবন্ধে লিখছেন একেবারে আজকের সুরে, “আপনি যা কিছু বলেছেন, সবই দেখা হবে সন্দেহের চোখে”; বলছেন, উর্দুতে এই বইয়ের নাম দিলে বলা যেত “মশকুক নজমে” – সন্দেহভাজন পদ্য।
কেমন এইসব সন্দেহের কথা? আসুন, দেখা যাক দুয়েকটা পদ্য ঘেঁটে।
“নতুন দিল্লিতে নতুন কিছুই নেই এমনিতে,
কিন্তু প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নতুন সরকার আসে,
পুরোনো সমস্যাগুলোকে নতুন অভিপ্রায় দেয় ...”
লেখাগুলি প্রকাশিত হওয়ার সময় লক্ষ্য করুন – ২০১৭। দিল্লির মসনদে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে তিন বছর আগে। জড়বৎ জোটকে হারিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসেছে অন্য শক্তি – কিন্তু ভোটের আগে দেওয়া যত প্রতিশ্রুতি, তারা কি পূর্ণতা পেয়েছে? ওই শেষ লাইনেই কী আলগোছে বলা কথাটা – “নতুন অভিপ্রায় দেয়”, পূর্ণতার কথা তো বলা নেই কোথাও।
এই যুগের সবচেয়ে ভয়াল অস্ত্র – খবর, খবরের কাগজ – বারবার ফিরে আসছে গুলজারের এই বইতে –
“খবরের কাগজ হাতে নিই যেই,
কিছু খুচরো, অদরকারি খবর আমার কোলে ঝরে পড়ে।
ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া এক শিশুকে
তিনদিন স্তন্যদান করে বাঁচিয়ে রেখেছিল একটি কুকুর।”
ওই একই কবিতার শেষদিকে –
“পাসপোর্ট কমিশনার দরখাস্ত থেকে মুখ তুলে বললেন :
‘কোনও তিল বা আঁচিল আছে শরীরে?
কোনও জন্মদাগ?
এমন কোনও দাগ যা মোছা যাবে না?’
সেই শিখ কয়েক মুহূর্ত ভেবে
হঠাৎই নিজের শার্ট খুলে ফেলল :
‘এই এখানে একটা পুড়ে যাওয়ার দাগ, স্যার জি,
সেই চুরাশি সালের।
এটা মোছা যাবে না।’”
বইটি পড়লেই স্পষ্ট বোঝা যায়, গুলজার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন ‘সন্দেহভাজন’ বিশেষণটি, কবিতাগুলির ক্ষেত্রে। ভারভারা রাও বা অরুন্ধতী রায়ের মতো বিপদসঙ্কেতের গায়ে গায়ে ঘোরে না তাঁর কথাগুলি। কিন্তু হয়তো বা কখনও প্রচ্ছন্নে, হয়তো বা কখনও কোনও দূরবর্তী ইতিহাস খুঁড়ে এনে, হয়তো বা এই অমানবিক দিনকালে হারিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্বকে দেখে পুরনো বন্ধুর মতো এক ঝলক হেসে ওঠায় কবিতাগুলি শত্রুপক্ষের ভুরু কুঁচকে দিতে সক্ষম। শত্রুপক্ষের অ্যারেস্ট ওয়ারাণ্ট নিয়ে তেড়েফুঁড়ে না উঠলেও, গলার কাঁটার মতো আটকে যায় কবিতাগুলি উপযুক্ত স্থানে।
লেখালেখির সূত্রে অল্প কিছুদিন আগে গুলজারকে নিয়ে একটি সার্ভে করেছিলাম। প্রত্যাশামতই, তাতে অধিকাংশ মানুষই তাঁকে চিহ্নিত করেছেন রোম্যান্টিক কবি, চলমান নস্টালজিয়া, দুর্দান্ত গীতিকার এমন নানা পরিচয়ে। মাত্র চার শতাংশ মানুষ তাঁকে দেখেছেন ‘পলিটিকাল কবি’ হিসেবে। অস্বাভাবিক নয় তা, কারণ রাজনৈতিক লেখালেখি বরাবরই আমাদের কাছে সংজ্ঞায়িত হয়েছে একটু অন্য চেহারায় – চরিত্রগত ভাবেই, সে প্রধানত প্রোপ্যাগান্ডিস্ট; তার উদ্দেশ্য, অভিমুখ একরোখা, আশু লক্ষ্য ব্যতীত রাজনৈতিক লেখার সুর খুব একটা অন্যদিকে বয় না। হয়তো কিছুটা সেই পাঠ থেকেই আমরা এখনও গুলজারকে ‘রাজনীতি’র বাইরে সযত্নে লালন করি।
দেখতে গেলে, দেশভাগের মতো বিষয় নিয়েও গুলজারের লেখার সংখ্যা নেহাত কম নয়। ‘ফুটপ্রিন্টস অন জিরো লাইন’ বলে তাঁর একটি সংকলনে এ বিষয়ে লেখা কবিতা ও গল্প স্থান পেয়েছে। প্রায় তেমনই নীরবে সংকলিত ‘সাসপেক্টেড পোয়েমস্’। এমনিতে রাজনৈতিক লেখার রক্তগরম মেজাজে বেশিরভাগ সময়ই ঢাকা পড়ে যায় নিভৃতচারণ। গুলজারের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো – রাজনৈতিক লেখার মধ্যেও নীরব, মিতভাষী কাব্যময়তা এমনভাবে নিয়ে আসেন তিনি, রাজনীতির বৈভব মুছে গিয়ে শেষ অব্দি সবকিছুর সার সেই মানবিকতাই পড়ে থাকে।
আরও পড়ুন : গজ়লের অনন্ত বিষাদজলে / তিতাস চট্টোপাধ্যায়
সাতাশি বছরে পা দিলেন গুলজার। তিরাশি বছর বয়সে প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থের মহিমায় তিনি এখনও আমাদের মতো অসংখ্য পাঠকের মনে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম, তাঁকে কি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক কবি বলা যায় না এখনও? জীবনের কথাই লিখছেন তিনি, কিন্তু জীবন কি রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন? হয়তো চাঁচাছোলা ক্ষোভ-প্রদর্শন ছেড়ে তিনি ঠাঁই নিয়েছেন নিঝুম হৃদ্যতার কথা বলাতেই, কিন্তু শুধু রাজ কেন, যে কোনও নীতির শেষের কথাই কি তা নয়? সে জন্যই গুলজারের পদ্যে স্তন্যদান করে শিশুটিকে বাঁচানো কুকুরটি খোঁজ করে যায় তার, লোকগুলি শিশুটিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরেও; হয়তো সে কারণেই গুলজার এখনও স্বপ্ন দেখেন, একদিন সীমান্তে কাবাডি খেলা হবে, আর একটা সময়ের পর এ’ পার ও’ পার বলে কিছুই থাকবে না। এই অবিচ্ছেদ্যতা বুঝতেও কোনও সিলেবাসের পাঠ লাগে না; জীবনই যথেষ্ট।
*লেখায় ব্যবহৃত গুলজারের কবিতাগুলির অনুবাদ আমারই করা; প্রয়োজনমতো পবন ভার্মার করা ইংরাজি অনুবাদের সাহায্য নিয়েছি।
..................................
সৌভিক
যারা গুলজার সাহাবের বিশেষ পাঠক তারা নিশ্চিত এই লেখায় এক নতুন আশ্রয় পাবে।