উইলিয়াম বোলট্স : বাংলার মুদ্রণ-ইতিহাসের ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক
১৭৭২ সাল। কলকাতার মাটিতে প্রথমবার পা রাখছেন ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। স্বদেশ ছেড়ে প্রাচ্যের এক জঙ্গুলে দেশে আসার যে খুব ইচ্ছে ছিল এমন নয়। কিন্তু পুত্রের উপর হতাশ উইলিয়াম হ্যালহেড একরকম জোর করেই ন্যাথানিয়েলকে কলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং পাঠিয়ে যে একটুও ভুল করেননি তার প্রমাণ মিলবে এর ঠিক ছয় বছর পরেই। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড লিখে ফেলবেন ‘A Grammar of The Bengal Language’, যাতে দেখা মিলবে বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত রূপটির। হেস্টিংসের উৎসাহ, বন্ধু উইলকিন্সের সাহায্য এবং পঞ্চানন কর্মকারের কারিগরি দক্ষতার ফসল ছিল হ্যালহেডের এই বই। কিন্তু এ গল্প হ্যালহেড বা উইলকিন্সের নয়। এ গল্প এক ভাগ্যবিড়ম্বিত জার্মান সাহেব উইলিয়াম বোলট্সের। তাঁর ভাগ্য যদি একটু সহায় হত, বাংলা ভাষার সূচনালগ্নের ইতিহাসও নিশ্চিতভাবে অন্যভাবে লেখা হত।
চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারি সাহায্যে বাংলা মুদ্রণযোগ্য হরফ নির্মাণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তারও প্রায় পাঁচ বছর আগে লন্ডনে বসে উইলিয়াম বোলট্স বাংলা হরফ তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। কেবলমাত্র কোম্পানির সঙ্গে ব্যক্তিগত বিবাদের কারণেই বোলট্স তাঁর কাজের প্রাথমিক পর্যায়ে ইতি টানতে বাধ্য হন।
১৭৫৬ সাল নাগাদ উইলিয়াম বোলট্স কলকাতায় আসেন। প্রথমে কোম্পানির কুঠিয়াল হিসেবে কাজ শুরু করলেও অল্পদিনের মধ্যেই বেনারস কাউন্সিলের সহপ্রধানের পদ লাভ করেন। কিন্তু বিপদ শুরু হয় এখান থেকেই। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি নাকি কোম্পানির নাম ভাঙিয়ে নিজের ব্যবসা করছেন। এমনকি দেশীয় রাজা জমিদারদের সঙ্গে কোম্পানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেও তিনি জড়িত বলে দাবি করা হয়। ফলে যা হবার তাই হল। রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৭৬৮ সালে তাঁকে প্রায় জোর করে লন্ডনে ফেরত পাঠানো হয়। তাঁর বিরুদ্ধে এতটাই কুৎসা রটেছিল যে জাহাজের ক্যাপ্টেন পর্যন্ত তাঁকে জাহাজে নিতে রাজি ছিলেন না। কোম্পানি পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের জামিন স্বীকার করার পর ক্যাপ্টেন তাঁকে জাহাজে তোলে। লন্ডনে তো এলেন, কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে বিবাদে এখানেই ইতি টানলেন না বোলট্স। লন্ডনে ফিরে কোম্পানির কুশাসন সম্পর্কে প্রচার করার জন্য লিখলেন মোটা মোটা তিন খন্ডের বই ‘Considerations on India Affairs'। কোম্পানিই বা চুপ করে থাকবে কেন? কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হল মামলা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এই বিরোধই তাঁর কাজের পথে মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন : অন্য বিদ্যাসাগরের গল্প / টিম সিলি পয়েন্ট
কলকাতায় থাকাকালীন ১৭৬৬ সাল নাগাদ বোলট্স বাংলা ভাষায় মুদ্রণের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে বিবাদের জেরে সে সময় তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়নি। লন্ডনে ফিরে এসে সেই কাজে তিনি মন দিলেন। বাংলাটা ভালোই জানতেন, ফলে বাংলা হরফ তৈরির কাজে নেমে পড়লেন নিজেই। কিন্তু যুক্তাক্ষর সহ প্রায় ছয়শো হরফ তৈরির জন্য দরকার ছিল প্রচুর অর্থ। কলকাতায় তিনি যা উপার্জন করেছিলেন তার প্রায় কিছুই সঙ্গে করে আনতে পারেননি। এই অবস্থায় তিনি দ্বারস্থ হন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৭৭৩ সালে তাঁর কাজের ব্যাপারে জানিয়ে কোম্পানিকে একটি চিঠি লেখেন। যার বিষয় নির্দেশ করেছিলেন - ‘বাংলায় মুদ্রণ প্রচলন বিষয়ক প্রস্তাব’। সঙ্গে পাঠান তাঁর নিজের তৈরি হরফের কিছু নমুনা। কিন্তু যে আশঙ্কা তিনি করেছিলেন তা’ই সত্যি হল। কোম্পানির কুনজরে থাকায় বোলট্সের সে চিঠির উত্তর আসেনি কোনোদিন। এ চিঠি পাঠানোর পাঁচ বছর পর হুগলী শহরে অ্যানড্রুজের প্রেস থেকে প্রকাশিত হবে বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম বই ‘A Grammar of the Bengal Language’। হ্যালহেড এই বইয়ের ভূমিকায় জানান- বোলট্সের হরফ নির্মাণের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। অথচ হ্যালহেড, উইলকিন্স ও কোম্পানির কয়েকজন কর্মী ছাড়া সে সময় বোলট্সের হরফের নমুনা কেউ দেখেনি। বিদেশেও তা প্রচার পায়নি। উইলকিন্স ছিলেন কোম্পানির কর্মচারী। তিনি হেস্টিংসের নির্দেশে কাজ করেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় টাকা অগ্রিম পেয়েছিলেন। এমনকি পেয়েছিলেন পঞ্চাননের মতো যোগ্য সহকারী। উইলকিন্স পঞ্চাননের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত অক্ষরের তুলনায় চিঠির সঙ্গে নমুনা হিসেবে পাঠানো বোলট্সের অক্ষর মোটেই নিন্দনীয় ছিল না। তাঁর সামনে মুদ্রণযোগ্য কোনো হরফের আদর্শ ছিল না। কিন্তু উইলকিন্সের সামনে ছিল বোলট্সের নমুনা। কেবলমাত্র ভাগ্যের পরিহাসে বোলট্সের পরিকল্পনা সাফল্যের আলো দেখেনি। ইতিহাসও সহজেই ভুলে গেছে বোলট্সের মতো দুর্ভাগ্যতাড়িত মানুষদের।
...................................
[ঋণ : দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন, আনন্দ পাবলিশার্স]
#William Bolts # East India Company #silly পয়েন্ট