ভারভারা রাওয়ের জেলজীবনের আখ্যান : ‘Captive Imagination’
বই : Captive Imagination : Letters from Prison লেখক : ভারভারা রাওঅনুবাদ : কে.বালাগোপালপ্রকাশক : Penguin, India
সত্তর দশকে শুধু বাংলায় না, অন্ধ্রপ্রদেশেও একদল যুবক কবি পেট্রল দিয়ে আগুন নেভানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লববাদকে। কবি, অধ্যাপক, রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট ভারভারা রাও একাধিকবার বন্দী হয়েছেন রাষ্ট্রের কারাগারে। শেষবার সরকার তাঁকে বন্দী করেছে ২০১৮ সালে। অশীতিপর শরীর নিয়ে এখনও তিনি রাত কাটাচ্ছেন গরাদের ওপারে। মাঝে কোভিড-আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চরম অসুস্থ হয়েও ভারভারা যথেষ্ট যত্ন বা সুব্যবস্থা পাননি বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁর অনুরাগীরা। আমাদের আজকের আলোচনা আটের দশকের শেষদিকে ভারভারার লেখা জেল-যাপনের আখ্যান ‘সহচরুলু’-র ইংরেজি অনুবাদ ‘Captive Imagination’ বইটি নিয়ে।
আটের দশকে অন্ধ্রপ্রদেশে এন.টি. রামারাও-এর সরকার নকশাল-মনোভাবাপন্নদের প্রতি দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন। ফলে ভারভারা রাও ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা গ্রেফতার হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সেকেন্দ্রাবাদের জেলে বন্দী থাকাকালীন ভারভারা রাও তার সেই কারাজীবনের অভিজ্ঞতাকে অক্ষরে রূপ দেন। মূল তেলুগু থেকে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন কে. বালাগোপাল। ‘Captive Imagination’ বইটি প্রকাশ করেছেন পেঙ্গুইন।
ভারভারা রাও লিখেছেন যে এই কারাজীবনের সময় তিনি কথা বলার অভ্যেস হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভুলেই গেছিলেন স্বরথলির ব্যবহার। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাপ্তাহিক আলাপের জন্য তিনি রীতিমতো রিহার্সাল দিতেন যাতে নৈঃশব্দ্য তাকে গ্রাস না করে। এক বিপ্লবীর কাছে এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। জেলে ফাঁসিমঞ্চের সামনে উড়ে বেড়ানো পায়রাদের দেখে তিনি অবাক হতেন যে কীভাবে এই পরাধীন পরিবেশে তাঁরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। বৃক্ষরোপণকে ভারভারা রাও জেলখানায় এক প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে দেখেছেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা কারাগারে দেখা করতে আসা কমরেডদের কাছ থেকে গাছের কলম চেয়ে নিতেন। ১৯৬৪-তে কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙনের পর সি.পি.আই.(এম)- এর যেসব কর্মীরা সেকেন্দ্রাবাদ জেলে বন্দী হন, তারা সে সময় কিছু গাছ লাগিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যারা সে সময় জীবিত ছিল, সেইসব গাছের অস্তিত্বের গহনে ভারভারা রাও বন্ধুত্বের ভাষা খুঁজে পেতেন। তাই সেকেন্দ্রাবাদ জেল তাঁর কাছে ছিল "কমিউনিস্ট ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত সাক্ষী"। মস্তিস্কের টিউমারে ভুগছিলেন চেরাবান্দা রাজু। অসুস্থতার কারণে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন জেল চত্বরের একটি পুকুরে। সেই পুকুরের পাশেই ছিল একটি বেদানা গাছ। অনেকদিন পরেও বেদানা গাছের প্রস্ফুটিত কুঁড়িতে কমরেড চেরাবান্দা রাজুর স্মৃতি ভেসে উঠতো ভারভারা রাও-র মনে।
ভারভারা রাও বইকে অভিহিত করেছেন ‘বন্দীর ডানা’ হিসেবে। সেকেন্দ্রাবাদ জেলে বন্দী থাকাকালীন কে. বালাগোপালের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন ডি.ডি. কোসাম্বীর ইতিহাসের বই। অন্যান্যরা পাঠিয়েছিলেন সত্য সাঁই বাবা, চার্লি চ্যাপলিন, জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তির উপর লেখা বই, ইয়ারোস্লাভ হাসেঘোর রচনা। এছাড়া তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ম্যাক্সিম গোর্কি, পাবলো নেরুদা প্রমুখের রচনা। এক বন্দীর কাছ থেকে ধার করে পড়েছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জীবনী ও চার্লস ডিকেন্সের কয়েকটি উপন্যাস। প্রায় তিনবছর ভারভারা রাও কোনো বিপ্লবী পত্র-পত্রিকা পড়তে পারেননি। বন্দীদের দেওয়া পত্র-পত্রিকাগুলোতে বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং শ্রেণীসংগ্রামগত চেতনার কোনো কথাই থাকত না। তবে সকালে রেডিওতে খবর শুনে তিনি বুঝে নিতেন কোন কোন খবরকে চেপে দেওয়া হচ্ছে, বা বিকৃত করে পরিবেশন করা হচ্ছে।
বন্দীজীবনে ভারভারার সবসময় মনে পড়ত তাঁর পরিবার ও আপনজনদের কথা। একদিন জেলখানায় রেডিওর বিবিধ ভারতী চ্যানেলে "আধা হ্যায় চন্দ্রমা রাত আধা" শুনতে শুনতে তাঁর মনে পড়ছিল স্ত্রী হেমার কথা। কারাবাসের নির্জনতায় তিনি যেন অনুভব করতে পারছিলেন হেমার উপস্থিতি।
এ লেখায় ভারভারা রাষ্ট্র ও প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে অনেক মৌলিক তেজস্ক্রিয় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। ১৯৮০-র শেষলগ্নে রাজনৈতিক বন্দীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা শুরু হয়। এই নিখোঁজ হওয়া ছিল কারাগারে মৃত্যু ও এনকাউন্টারের মতোই সমার্থক ও 'স্বাভাবিক'। তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে. বালাগোপালের নিঁখোজ হওয়ার খবর পেলে ভারভারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি লিখেছেন যে ১৯৮৯-এর প্রায় রোজদিনই এনকাউন্টারের খবর পাওয়া যেত। আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় ভারভারাকে হাতকড়া পরিয়ে ধাক্কা মেরে ঠেলে দেওয়া হত গেটের বাইরে। যেন তিনি একটা জড়পিণ্ড—যার কোনো বোধ কোনো অনুভূতি থাকতে পারে না। সে সময় একইসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা চলছিল ভারাভারা ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। তবু মাথা নোয়াননি তাঁরা। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ঋজুকন্ঠে ভারভারা প্রশ্ন ছোঁড়েন বিচারকের দিকে—"আমাদের নাম থাকলেও আপনি আমাদের এ-১,এ-২ বলে সম্বোধন করে থাকেন। এ-১,এ-২ দুজন মানুষ ছিলেন যাদের এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয়েছে। মানুষ হিসেবে আপনি তাঁদের চিনতে অস্বীকার করলেও একথা কী জানার প্রয়োজন নেই যে মামলায় অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আদালতে অনুপস্থিত কেন।" রাষ্ট্রের চোখরাঙানিকে ফুৎকারে উড়িয়ে ভারভারা চেরাবান্দা রাজুকে স্মরণ করার কথা বলেন।
আরও পড়ুন : অবান্তর পাঠশালা : এক সত্যি গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়া / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়
এভাবে ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির সূত্রে শুধুমাত্র এক চিন্তাশীল মেধাবী মানুষের মনোজগতই যে শুধু আলোকিত হয়ে ওঠে তা-ই নয়, স্বাধীন রাষ্ট্রের কারা-কাঠামোর বিভিন্ন অজানা দিক আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে। তবে সব ছাপিয়ে যেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় কারাবাসের সবচেয়ে বড় অভিশাপের মুখচ্ছবি - অনন্ত নিঃসঙ্গতা। অনন্ত নিষ্ফলা সময় —যাকে ভারী বস্তার মতো টেনে নিয়ে যেতে হয়। একাকীত্ব, যন্ত্রণা, প্রতিবাদ, হার-না-মানা - সবই মিলেমিশে ভারভারার এক পরিপূর্ণ ব্যক্তিস্বরূপের পরিচয় ধরা আছে তাঁর জেলজীবনের এই আখ্যানে।
..................................
#Captive Imagination: Letters from Prison #Varavara Rao #Autobiography #Poet #Marxist #critic # activist #Prison #Political Activist #ভারভারা রাও #জেলজীবন #রাজবন্দী #আত্মজৈবনিক রচনা #Book Review #বই রিভিউ #প্রগত #সিলি পয়েন্ট