আলিসিয়া পার্টনয়ের 'অবান্তর পাঠশালা' : এক সত্যি গল্পের পাঠ-প্রতিক্রিয়া
মূল গ্রন্থ: লা এসকুয়েলিতা লেখক: আলিসিয়া পার্টনয় অনূদিত গ্রন্থ : অবান্তর পাঠশালা অনুবাদক: জয়া মিত্র প্রকাশক: গুরুচন্ডা৯
কয়েকদিন আগেই একটা খবর চোখে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। দমদম জেলে আবারও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় একজন রাজনৈতিক বন্দির। হ্যাঁ এই “আবারও” শব্দটাই বারেবারে ঘুরে ফিরে আসে। জেলের ভৌগলিক সীমানা পাল্টে যায় , তার নাম পাল্টায় ,দমদম জেল কখনো হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেল,কখনো সুদূর আর্জেন্টিনার " দি লিটল স্কুল " ( La Escuelita ) । এমন কারাবন্দী আছে সারা পৃথিবী জুড়ে, সবার পিঠেই চাবুকের দাগ । সীমান্ত পেরোলে দেশের নাম পাল্টে যায়, চাবুকের দাগ পাল্টায় না। আর সেই যন্ত্রণা থাকে বলেই প্রতিনিয়ত বোনা হতে থাকে যন্ত্রণা মুক্তির কৌশলও । এমন এক কারাগারে বন্দী জীবনের অমানবিক যন্ত্রণা তাকে সাথে নিয়েই নতুন করে উঠে দাঁড়ানো ও মুক্তির আশার এক বাস্তব গল্প আলিসিয়া মার্বেল পার্টনয় এর “লা এসকুয়েলিতা”। যার বাংলা অনুবাদ করেছেন লেখিকা জয়া মিত্র "অবান্তর পাঠশালা"।
মারিও ক্যাম্পেস, মারাদোনা, মেসির বাইরে গিয়ে যে দেশের গল্প আমরা শুনতে চাইনা বা আমাদের শোনানো হয় না, সেই আর্জেন্টিনার অন্ধকার সময়ের গল্পই "অবান্তর পাঠশালা"। গল্পের ঢঙে লেখা এক সত্যি গল্প। রাজনৈতিক বন্দী হয়ে নির্বাসিত থাকাকালিনই আলিসিয়া পার্টনয় এই গল্পটি লেখেন। "লা এসকুয়েলিতা" গ্রন্থের ভূমিকায় লেখিকা নিজেই জানিয়েছেন, “লিটল স্কুলের কাহিনি আর বাস্তব ঘটনার মধ্যে তফাতের লাইনটি এত সূক্ষ্ম যে সময় সময়ে আমি নিজেও সেটা খুঁজে পাই না”। এ রচনা যেন এক সামাজিক- রাজনৈতিক ইস্তেহার।এক সময়ের দলিল।
১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সামরিক শাসনের ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে আর্জেন্টিনায় ধীরে ধীরে নিখোঁজ হতে থাকে প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। কিন্তু এত মানুষ নিখোঁজ হয় কেন? তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়? এমন সব প্রশ্ন ও তার স্পষ্ট জবাব এই "অবান্তর পাঠশালা"। আলিসিয়া পার্টনয় এর জন্ম ১৯৫৫ সালে। ঠিক সেই বছরই জুয়ান পেরেনের হাত থেকে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। পার্টনয় এর কৈশোরে জুয়ান পেরেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে পুনরায় নিবাচিত হলে লেখিকাসহ সেই প্রজন্মের অনেকেই পেরেনপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে এই বিশ্বাস নিয়ে যে এ আন্দোলন এক প্রকৃত সমাজতন্ত্রের জন্ম দেবে। ১৯৭৫ সালে পেরেনের মৃত্যু হয় এবং তার স্ত্রী ইসাবেল উপরাষ্ট্রপতি হন, কিন্তু তিনি শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কোনভাবেই চিন্তিত নন। সামরিক বাহিনীর হাতে উঠে আসে অত্যাচারের আইনত অধিকার, সেন্সর হতে থাকে সংবাদ মাধ্যমগুলি। আলিসিয়া পার্টনয় দেশের এই অবস্থার খবর গোপনে প্রচার করতে থাকেন। আর তাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক এই ব্যক্তির অর্থাৎ আলিসিয়ারও নাম জুড়ে যায় সেই ত্রিশ হাজার নিখোঁজ মানুষের তালিকায়, মিলিটারি কন্সন্ত্রেশন ক্যাম্প যার নাম দেওয়া হয় “দি লিটল স্কুল”। শুরু হয় কারাগারের বন্দী জীবনের লড়াই। হ্যাঁ লড়াই। রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লড়াই।অমানবিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যখন অনবরত সংগ্রামী কণ্ঠ রোধ করা হয় তখনই তা সেই আঘাতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক কণ্ঠ থেকে সমবেত কণ্ঠে পরিণত হয়। তাই লিটিল স্কুলের অত্যাচারের পদ্ধতির মধ্যেই একে অপরের হাত ধরে ভরসা জাগানোর উপায় খুঁজে বার করে আলিসিয়া,হুগরা। লিটল স্কুলের ভয়ঙ্কর ট্রেন ট্রেন খেলার মধ্যে দিয়েই তারা একে অপরকে বলে “সাহস রাখ।আজকের জন্য আর আগামি যতগুলো দিন আমাদের সহ্য করতে হবে সেগুলোর জন্যও।“ আমরা দেখতে পাই সমস্ত গর্জনকে তোয়াক্কা না করে আলিসিয়া অপর বন্দীর গালে যত্ন করে হাত বুলিয়ে দেয়। এই নিষ্ঠুরতা থেকে বাদ পরেনি গর্ভধারিণী গ্রাসিয়েলও।তার মধ্যেই জন্ম নেয় তার সন্তান। আলিসিয়া লিখছেন “A Prison child has been born,while the killer’s hand welcome him into this world,the shadow of life leaves the scene,half a winner,half a loser....who knows how many children are born every day at the Little School?” এই সব পেরিয়ে আসে বৃষ্টির দিন। আলিসিয়া স্বপ্ন দেখতে থাকে আর্জেন্টিনার একরকম তেঁতো চা আর বড়া ভাজার।
এ গল্প কেবল লড়াইয়ের কথা বলে না, বলে কিভাবে লড়াই জিততে হয়,বলে “সাহস রাখো।“