নিবন্ধ

রাষ্ট্র, ফুটবল ও আগুনে পোড়া একটি মেয়ে

সায়নদীপ গুপ্ত April 20, 2021 at 10:39 am নিবন্ধ

ক্ষমতার নিজস্ব কিছু খামখেয়ালিপনা থাকে। সেই খেয়ালের বশে সে কিছু দেওয়াল গড়তে থাকে সমাজ-সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। সবসময় যে দেওয়াল তুলে সে কিছু লুকোতে চায় তা নয়, নিজেকে মহান প্রতিপন্ন করতে চাওয়ার উদ্দেশ্যও চরিতার্থ করার থাকে না সবসময়। তবু, দেওয়াল সে তোলে নিজের যাবতীয় বস্তাপচা ধারণাকে একটা মান্যতা দেওয়ার তাগিদে। নাগরিক রোজনামচায় সেই দেওয়াল আস্তে আস্তে শাসকের উৎকট দম্ভের মনুমেন্ট হয়ে গেঁড়ে বসে।

গণতন্ত্রে এমন মনুমেন্ট বানানোর অনেক হ্যাপা। বিরোধীদের দুরমুশ করতে কিছু বশংবদ ডান্ডাধারী, গোটাকতক ভালো আইটি সেল, অথবা নিদেনপক্ষে সর্বক্ষণ খোঁচানোর মতো একটা পড়শি দেশ লাগে। কপাল ভালো থাকলে দু’একটা মহামারী জুটে যেতে পারে, তখন রোগের জুজু দেখিয়ে ঘর ফাঁকা করে ইচ্ছেমতো নিয়ম বানানো যায়। তবে সে সুযোগ তো আর রোজ মেলে না! এইদিক থেকে ধর্মপ্রধান রাষ্ট্রের হাতে একটি ‘সব-পেয়েছি’র মন্তর আছে। ফতোয়া। কারণে অকারণে এইটি চাপিয়ে দেওয়া যায়। ভালোমন্দ সবেরই দায় চোকাবেন স্বয়ং ঈশ্বর, সকলই তাঁহার ইচ্ছা। যেমন ইরান। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের হাত ধরে দেশের খোলনলচে যখন বদলানো হল, তখনই হঠাৎ চেপে বসল এক আজব হুকুম – পুরুষ অধুষ্যিত কোনও স্টেডিয়ামে মহিলারা খেলা দেখতে যেতে পারবেন না। ফুটবল সে দেশের জনপ্রিয়তম খেলা, তাই নিয়মের নিগড় বসল তার পায়েই। কালে কালে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় ভলিবল আর বাস্কেটবলের খেলাতেও চালু হয়ে যায় এই নিয়ম। শুরুর দিকের ‘আহা উহু’-তে একটা যুক্তিও দেওয়া হল। স্টেডিয়ামের অমন উত্তেজক পরিবেশ, সেখানে পুরুষরা স্বভাবতই একটু লাগামছাড়া। প্রিয় দলের সাফল্যে বা ব্যর্থতায় অনবরত চলতে থাকে দু অক্ষর-চার অক্ষরের ফুলকি। তা কি নারীর কানে আসা শোভা পায়? অতএব উত্তেজনায় শুধুই পুরুষের অধিকার। খটকা লাগে, ইরানি পুরুষ কি বাড়ির ভিতরে এতই ভব্য যে হাজার হতাশাতেও ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখেন? প্রোমোশন আটকে গেলে, ছেলেমেয়ে সময়মতো বাড়ি না ফিরলে, সারাদিন গতরে খেটেও রোজগার না হলে কাদের উপর হুজ্জুতি হয় ওদেশে? আর রাতের তীব্র আশ্লেষে কর্তা যখন উপুড় করে দিতে চায় সারাদিনের জমানো সব ক্ষোভ, সেই চরম মুহূর্তে কানে কানে কি বলে তারা? রুবাইয়াৎ? 

তবু এ নিয়ম রয়ে যায়। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে মেয়েরা ফুটবল খেলে যায় পর্দার আড়ালে, পুংদৃষ্টি বাঁচিয়ে। আশ্চর্যের বিষয়, তাদের ইচ্ছেগুলো দমে যায়নি এত বছরেও। বাধা এসেছে একের পর এক, আবার সহমর্মিতাও এসেছে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য চাই মহিলা প্রশিক্ষক; যে দেশে শুরু থেকেই একুশে আইনের এমন কড়াকড়ি সেখানে এমন প্রশিক্ষক হাতে গুনে মেলে। তবু এতটা পথ পেরিয়েছে তারা। প্রযুক্তির হাত ধরে ভিডিও কলে প্রশিক্ষণ এসেছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে থাকা মানুষের থেকে, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে। ২০০৬ সালে বিশ্ববন্দিত ইরানি চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহি একটি সিনেমা তৈরি করেন এই বিষয়ের উপর – ‘অফসাইড’। কাহিনির প্রেক্ষাপট ইরান ও বাহরাইনের মধ্যে বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ধারক ফুটবল ম্যাচ। উত্তেজনা স্বভাবতই তুঙ্গে; বাড়ি ছাড়িয়ে বাস, বাস ছাড়িয়ে রাস্তায় উপচে পড়েছে তার আঁচ। এমনই একটি সমর্থক ভর্তি বাসে দেখা মেলে এক কিশোরীর, পুরুষের অনভ্যস্ত সাজে আড়ষ্ট। এবং ভীত। এই বুঝি কেউ তার ছদ্মবেশ ধরে ফেলল। ছদ্মবেশ যে মোটেই পোক্ত নয়, তা সে সহজেই বুঝে যায় সহযাত্রী যুবকের সবিস্ময় প্রশ্নে। মজার কথা, বাসভর্তি যুবক, মাঠে উপস্থিত ছেলেপুলের দল, কেউ কিন্তু এই ঘটনায় বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হয় না। বরং বিস্মিত যুবকটিকে তার বন্ধু বারণ করে বারবার মেয়েটির দিকে তাকাতে, এতে মেয়েটির ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে বই কমবে না। কেউ এসে অযাচিত ভাবেই সাহায্যের আবেদন জানায়, লুকিয়ে মাঠে প্রবেশের ফিকির শোনায়। ছোটো ছোটো ঘটনার মধ্যে দিয়ে পরিচালক দেখিয়ে দেন, সমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিভেদ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হতে বসেছে। তবু ক্ষমতার বধিরতা ঘোচানোর সাধ্য তার হয় না। ব্ল্যাকে টিকিট কিনে প্রাথমিক নিরাপত্তা পেরিয়ে যদিও বা ভিতরে ঢুকে পড়ে মেয়েটি, শেষ অবধি ধরা পড়ে যায় রক্ষীর হাতে। ঠাঁই হয় ব্যারিকেড ঘেরা এক ছোট্ট পরিসরে, আরও কিছু দুর্ভাগা সঙ্গিনীর সঙ্গে। আলাপে আলাপচারিতা জমে, শুরু হয় খুনসুটি। পাহারাদার রক্ষীদের সঙ্গে বাগবিতন্ডার মধ্যে দিয়েই মানবিক সম্পর্কের তার বাঁধা হয়। ইরানে সামরিক কর্তব্যপালন বাধ্যতামূলক, তাই সহমর্মিতা থাকলেও কর্তৃপক্ষের সব আদেশ শিরোধার্য। খেলা দেখতে চাওয়া মেয়েদের আকুল অনুরোধেও নিরুপায় অসহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুরুষ সমাজ। কেউ চেয়েছিল দর্শকাসনে বসে খেলা দেখতে, কেউ চেয়েছিল গ্রামের বাড়িতে বাবা-কাকার পাশে থেকে কাজ করতে, তবু সামরিক দায়িত্ব তাদের এই আটক মেয়েদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই অবধারিত ভাবেই স্টেডিয়ামের জানলার ফাঁক দিয়ে খেলার টুকরো দৃশ্যের ধারাবিবরণী দিতে থাকে এক রক্ষী, মেয়েরা রুদ্ধশ্বাসে শুনতে থাকে ইরান আর বাহরাইনের আগুপিছুর বর্ণনা। প্রিয় খেলোয়াড় নিয়ে বাদানুবাদ লেগে যায় দু পক্ষে, বাথরুমে যাওয়ার সময় ক্ষণিকের অসাবধানতার সুযোগে পালিয়ে যায় একটি মেয়ে। আবার ফিরেও আসে, তার নিরাপত্তায় থাকা যুবক রক্ষীর অসহায়তার কথা ভেবে, সদ্য দেখা পাওয়া বান্ধবীদের সঙ্গে খেলা দেখার আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার তাগিদে। মেয়েদের সঙ্গে রক্ষীদের নিরন্তর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে পরিচালক স্বচ্ছন্দে বুনে চলেছেন সমাজের যুবা প্রজন্মের মধ্যে এই অদ্ভুত নিয়ম ঘিরে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের গল্প। সমাজ ঠিক নাকি মেয়েদের স্বাধীন ভাবে চলার ইচ্ছা, সেই দোলাচলে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে জমি হারাতে থাকে নিয়মের অসারতা। শেষ দৃশ্যে, মেয়েদের জেলে নিয়ে যাওয়ার পথে যখন রেডিওতে ইরানের জয় ঘোষিত হয়, সারা রাস্তা জুড়ে শুরু হওয়া আকস্মিক উৎসবের ছিটে আসতে থাকে তাদের গায়েও। ছিটে থেকে ক্রমে ঝাপটা হয়, তা থেকে ঢেউ। 


আরও পড়ুন

বর্তমান সময়ে সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন


এই ঢেউ গোঁড়ামিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন এখনও বাস্তব। জাফরের অন্যান্য সিনেমার মতোই এটিকেও ইরানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সিনেমা তৈরির তেরো বছর পরে ২০১৯ সালে ইরান প্রথমবার মহিলাদের অনুমতি দেয় পুরুষদের সঙ্গে বসে খেলা দেখার, জনমত আর আন্তর্জাতিক চাপের সামনে বাধ্য হয়ে। তবে কোনও কিছুই তো বিনামূল্যে পাওয়া যায় না, বিশেষত নারীস্বাধীনতার মতো সোনার পাথরবাটি মার্কা বিষয়ে সাফল্যের স্বাদ পেতে দাম লেগে যায় একটু বেশিই। কখনও কখনও একটা গোটা তাজা প্রাণ। বছরের পর বছর জুড়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ চলেছে অবিরত, সমাজের সব লিঙ্গের মানুষ একে একে সমর্থন জানিয়েছেন, তবু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ২০১৯-এর মার্চ মাসে আজাদি স্টেডিয়ামে পুরুষ সেজে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়েন ২৯ বছর বয়সী সাহার খোদায়েরি। নিয়ম অনুযায়ী ৬ মাস থেকে ২ বছরের জেল হত, কিন্তু দীর্ঘ চার দশকের বঞ্চনা আর তাচ্ছিল্যের প্রতিবাদ জানাতে সেপ্টেম্বর মাসে কোর্টের রায় বেরোনোর দিনটাই বেছে নিয়েছিলেন সাহার। কোর্ট চত্বরেই গায়ে আগুন লাগিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সমাজের সব স্তরে, জাতীয় ফুটবল টিমের প্রাক্তন অধিনায়ক ফুটবল খেলা বয়কট করার ডাক দেন। ফিফা হুমকি দেয় প্রতিযোগিতা থেকে বহিষ্কারের। ফলস্বরূপ ক্ষমতার নতি স্বীকার। সেদিন স্টেডিয়ামের মহিলা পরিবেষ্টিত বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে মহিলা দর্শকদের অভিনন্দন জানান জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা। প্রতিদ্বন্দ্বী কাম্বোডিয়াকে সেদিন ১৪-০ গোলে হারিয়েছিলেন তাঁরা। প্রতিটি গোল, রাষ্ট্রের দাঁতনখ বের করা আগ্রাসনের মুখে সপাটে আছড়ে পড়েছিল। সেই ঘটনার দু’বছর পরেও এই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে যায়নি, চোরাগোপ্তা ভাবে বলবৎ আছে। তবু আশা রাখা যায়, সমাজের সব স্তরে বিরোধিতার মূল সুরটি অক্ষুণ্ণ থাকবে। খোদায়েরির আত্মবলিদান রাষ্ট্রীয় গোঁড়ামিকে পেনাল্টিবক্সের মধ্যে আর এক ইঞ্চি জমিও ছাড়বে না। 


[ আলোচ্য  চলচ্চিত্র - অফসাইড 
  পরিচালক - জাফর পানাহি 
 পর্দায় মুক্তির বছর - ২০০৬
 দেশ - ইরান ]

[ কভার পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#বাংলা #নিবন্ধ #সায়নদীপ গুপ্ত #ইরান #বাহরাইন #কম্বোডিয়া #সিনেমা #অফসাইড #জাফর পানাহি #ফুটবল #ফ্যাসিবাদ #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #জুজু

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

90

Unique Visitors

184173