শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’ : আজকের রূপকথা
ছোটোবেলায় মোবাইল ফোনে কথা বলতে খুব ভয় পেতাম। যাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, তার গলা শোনা যাচ্ছে কীভাবে? ও বাবা! ভূত নাকি? আসলে নয়ের দশকের মফস্বলের বাচ্চা তো। ভূতের ভয়টা ছিল এক্কেবারে মজ্জাগত। পাড়ায় পাড়ায় ‘মিথ’-এ ভরা পুরোনো আম গাছ, কাঁঠাল গাছের বাগান ছিল। যার এই গাছে অমুক জন আত্মহত্যা করেছিল, ওই গাছে করেছিল তমুক জন। মাসি-পিসিদের মুখে শোনা যেত অসংখ্য ‘সত্যি’ ভূতের গল্প। পুরানা হাভেলি-টাভেলি যে দেখতাম না, তা নয়, আবার রাতে একা একা বাথরুমে যেতেও ভয় পেতাম। তারপর একদিন কেউ একজন গিফট করল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’। ধ্যাত! ভূত কোথায়? এঁরা তো সব বন্ধুলোক। রীতিমত অঙ্ক করে দেয়, ক্রিকেট খেলে দেয়। এবার আর শচীন-সৌরভ হওয়া আটকায় কে! তারপর একে একে পড়লাম হেতমগড়ের গুপ্তধন, পাগলা সাহেবের কবর, ছায়াময়, পাতালঘর, অদ্ভুতুড়ে ইত্যাদি সহ সমগ্র ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’। কখনও আনন্দমেলায়, কখনও বা বই আকারে। বিশ্বাসটা রয়ে গেল, শুধু ভয়টা উবে গেল।
ভূতের গল্প যে তার আগে-পাছে পড়িনি, তা নয়। তবে হয় ওই আটা-মাখা ভূত, নয় প্রতিশোধকামী নরকঙ্কাল, বড়োজোর স্কন্ধকাটা, শাকচুন্নি, বোম্মদত্তি এঁনারা। কিন্তু ভূতেদের যে এত ভ্যারাইটি আছে, তা ‘অদ্ভুতূড়ে’-র আগে জানা ছিল না। সম্ভবত ভূতেরাও জানত না। মানে ঠিক ভূত নয়, আমাদের মতোই সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ। পৃথিবীর প্রতি কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই এঁদের, প্রতিশোধ নিয়েও মাথাব্যথা নেই, বড়োজোর অভিমান আছে। ভূতের রাজার মত এঁদের বিশাল কোনো ক্ষমতা নেই। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এরা মারদাঙ্গা করে না, এমনকি অনেকে তো রক্তপাতই পছন্দ করে না। আর সবচেয়ে বড় কথা এঁরা উপকারি বন্ধুলোক। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাতে এই সব ভূতেরা জীবন্ত হয়ে উঠে প্রচলিত ভূত ধর্মের বাইরে গিয়ে অদ্ভুত সব কাজকর্ম করে বসে। আর সেই কারণেই এঁরা অদ্ভুতুড়ে।
তাই শুধু অপঘাতে মৃত্যু হলেই সে মানুষ ভূত হয় না। ভূত হওয়ার স্বাধীনতা ও অধিকার যে কোনো ভূতেরই হাতে আছে। ‘পাতালঘর’-এর বিজ্ঞানী ভূত অঘোর সেনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা— সব জিনিসেরই বস্তুগত রূপান্তর হয়, ভূত হল মানুষের মৃত্যু পরবর্তী বস্তুগত রূপান্তরিত রূপ। বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান, বিভিন্ন পেশা, বিভিন্ন গ্রামের ভূতেদের এক মহাসম্মেলন ঘটে ‘অদ্ভুতুড়ে’-তে। আছে দোদর্ন্ডপ্রতাপ রাজা কালীচরণ বা হরিশ্চন্দ্রের ভূত। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, এমনকি শরীরটা পর্যন্ত নেই, কিন্তু রাজার দেমাকটা ঠিক বজায় রেখে চলছেন। এখন তো আবার রাম চলে গেলেও অযোধ্যা ফিরিয়ে আনার ধুম পড়েছে। নেহাত ভোটবাক্সে গণতন্ত্র বজায় রাখার পদ্ধতিটা আছে। ‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসে ভূতেরাও ভোটের মাধ্যমে বেছে নেয় তাদের ‘নেতা’ লম্বোদরকে। তার সঙ্গে আছে সামাজিক নিয়মকানুন—পাড়া প্রতিবেশীর লাঞ্ছনা গঞ্জনা, একঘরে করে দেওয়া বা ভূতেদের অফিসে ডিমোশনের ভয়। আছে অসংখ্য দুঃখী ভূত, ভীতু ভূত, বোকা ভূত, নাস্তিক ভূত, ডাকাত ভূত, পুলিশ ভূত এমনকি Identity crisis-এ ভোগা ভূত। সব মিলিয়ে পুরো অদ্ভুতুড়ে সিরিজ যেন ভূতেদের এক গঙ্গাসাগর মেলা।
তবে দুঃখী হোক বা অসহায়, প্রতিটা গল্প-উপন্যাসের শেষেই ভূতের মুখে আছে যুদ্ধজয়ের হাসি। মনে হয় এ যেন ঠিক ভূতের গল্প নয়, এ যেন রূপকথা—আজকের দিনের রূপকথা। রাজপুত্র-কোটালপুত্র নেই, ‘এক যে রাজা-এক যে রানি’ও নেই, সোনার কাঠি-রূপোর কাঠিও নেই, নেই কোনও রাক্ষস-খোক্ষস। রূপকের অন্তরালে ভালোর জয়, খারাপের পরাজয়ের গল্পই বলে রূপকথাগুলো। ‘অদ্ভুতুড়ে’-র গল্পগুলোও বিভিন্ন অদ্ভুত আচরণের মধ্যে থেকে এই সত্যিটাকেই যেন আমাদের অন্ধ চোখের সামনে খাড়া করে দিয়ে যায়।
আজকের দিনে তো আর দাদু-ঠাকুমারা রূপকথার গল্প বলার সুযোগ পান না। বলবেনই বা কাকে? হয় তাঁরা আলাদা, নয়তো বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই মুখ ডুবিয়ে বসে আছে মোবাইলের স্ক্রিনে। Facebook, WhatsApp-এর virtual আলো কি আর ভূতেদের সহ্য হয়! তাই ওঁরা পালাচ্ছেন। গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বলে। শহরে এত আলো, ঝাঁ চকচকে শপিং মল, উড়ালপুল, হুমড়ি খেয়ে পড়া ঘর-বাড়ি, সিসিটিভির নজরদারির মধ্যে ওঁরা থাকবেই বা কীভাবে? এই ইট-কাঠের শহরে মানুষেরই শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই তো ভূতেরা কোন ছাড়! হয়তো তাই ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’-এর প্রায় প্রত্যেকটা গল্পই চলে যায় গ্রামের নিরিবিলি তালগাছ-বেলগাছ, লোডশেডিং, হ্যারিকেনের আলোয়। যেখানে একটা বড়ো দীঘি, একটা পুরনো রাজবাড়ি, একটা ভাঙ্গা মন্দির, একটা চণ্ডীমণ্ডপ, একটা থানা আর অবশ্যই একটা হাট। থানায় আছেন দারোগা বাবু—যার পেল্লায় চেহারা, যিনি ভোজনরসিক আর অবশ্যই ভীতু। সন্ধ্যেবেলা চন্ডীমন্ডপে জমে ওঠে বয়স্ক লোকেদের মধ্যে গুলতানি, হাতে হাতে ঘোরে হুঁকো। ভাঙা মন্দিরে এক ভন্ড কাপালিকের ক্ষুরধার বুদ্ধি ও প্রতিভা সম্পন্ন চোরেদের অভাব নেই গ্রামে। একই গ্রামে থাকে ডাকাত আর পালোয়ান। আছেন এক অঙ্কের মাস্টার, যিনি সারাদিন অঙ্কের মধ্যে ডুবে থাকলেও দিনের শুরুতে বাজারের হিসেবটা ঠিক মত করতে পারেন না। এই জীবন আর চরিত্ররা আমাদের জীবন থেকে আজ ভূত হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন : কলকাতার ভূত / নির্মাল্য কুমার ঘোষ
শুধু বাচ্চারা না, একবার নিজের কথাও ভাবুন তো! আপনার কথা শোনার, আপনার কথা বোঝার লোক ঠিক কজন আছেন? না আপনি কজনের কথা শোনার সু্যোগ পান? আপনার পুরনো মূল্যবোধগুলো কি মরে ভূত হয়ে যায়নি? আমি-আপনি পারব রাস্তায় একটা অচেনা লোককে বিশ্বাস করতে? নাকি নিজে কোনো অচেনার লোকের জন্য বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিতে পারব? আর সেখানেই নায়কের মতো এন্ট্রি ঘটে অদ্ভুতুড়ে ভূতেদের। মানুষের কর্তব্যগুলোকে তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। যেখানে সামাজিক নিয়ম কানুনের হাত পৌঁছোয় না, সেখানে ভূতেরাই মানুষের একমাত্র সম্বল। তারা কোথাও নিজেরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, কোথাও সাধারণ মানুষের সাহায্যে সেই অন্যায়কারীকে শাস্তি দিয়েছে। দুঃখী মানুষকে সে সান্ত্বনা দিয়েছে, দুর্বলকে মনের জোর দিয়েছে। মনে হয়, এঁরা যেন আসলে ভূত নয়, এঁরাও মানুষ - বড্ড ভালো মানুষ।
আরও পড়ুন : ভূতের দাওয়াই / নির্মাল্য কুমার ঘোষ
গতকালই ৮৬-তে পা দিলেন শীর্ষেন্দুবাবু। তিনি নিজেও প্রবলভাবে ভূতে বিশ্বাসী। বহুবার তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি ভূতেদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন। আশা করি এইসব ভূতেদের আশীর্বাদে তিনি আরও দীর্ঘায়ু হবেন এবং আরও অদ্ভুত সব ভূতেদের উপহার দেবেন। তৈরি হবে ভূতেদের এক বিরাট মুক্তাঞ্চল। বাংলার সমস্ত প্রান্ত থেকে ভূত এসে জড়ো হয় সেখানে। তারপর ভূতে আর মানুষে মিলে এক বিরাট মহোৎসব হবে। এক অদ্ভুতুড়ে মহোৎসব হবে।
...........................