নিবন্ধ

ভূতের দাওয়াই

নির্মাল্য কুমার ঘোষ Aug 2, 2020 at 3:42 am নিবন্ধ

ওঁরা থাকে ওপারে (চতুর্থ কিস্তি)



দেখুন, ভূতেরা আছে থাকুক, তাতে অসুবিধা নেই। তা বলে তারা তো আর কিছু আমাদের মাথা কিনে নেয়নি! তাই ভূতকে খুব একটা ভয় পাবেন না। মনে রাখবেন সব রোগের যেমন ওষুধ থাকে, ভূতেরও তেমনি দাওয়াই আছে! প্রয়োগ করলেই জব্দ! কেমন তা? রেভারেন্ড লালবিহারী দে, উনিশ শতকের শেষে, 'ফোক টেলস অফ বেঙ্গল' নামে একটা বই লিখেছিলেন। সে-বইতেই ছিল 'দ্য গোস্ট হু ওয়াজ অ্যাফ্রেড অফ বিয়িং ব্যাগড' গপ্পোটি। একবার এক চতুর নরসুন্দর তার বিদ্যার জোরে একটি 'পিরেত'-কে ভয় দেখিয়ে নিজের গোলাম বানায়। কী করে ভূতকে ভয় দেখায় সে? ভূতের সামনে ধরে দেয় একখানা আয়না। বলে, আয়নার ভিতরে সে নাকি বন্দি করে রেখেছে আরেকখানা ভূতকে! আর ওই বোকা ভূত, নিজের ছবি দেখেই, বিশ্বাস করে ফ‍্যালে নাপিতের কথায়! তবে হ্যাঁ, মনে রাখবেন, ইউরোপের ভূতেদের কিন্তু আয়নায় ছবি পড়ে না! ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া 'ভ্যান হেলসিং' চলচ্চিত্রের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে, যেখানে নায়িকা অ্যান, ড্রাকুলার সঙ্গে নাচতে নাচতে, হঠাৎ ঘরের বড় আয়নার দিকে তাকিয়ে টের পায় যে, একা তাকে বাদ দিলে, ঘরভর্তি আর কারোরই আয়নায় ছবি পড়ছে না! ভারতীয় তথা বাঙালি ভূতেদের না-জানি কোন সিদ্ধি আছে, তারা কিন্তু দিব্যি আয়নায় নিজের মুখ দেখাতে পারে!



হেমেন্দ্রকুমার রায়, যিনি মারাত্মক ভালো ভূতের গল্প লিখতেন, তাঁরই একটি গল্প ছিল 'মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী'। ঝাঁঝা শহরে আচমকা রক্তাল্পতা রোগ দেখা দিলে, জানা যায় যে এর জন্য দায়ী রক্তচোষা বাদুড়প্রেতিনী মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী! বুঝতেই পারছেন, এ ভূত আমাদের নিজেদের দেশের নয়; বিদেশ থেকে এসেছে। তা ইউরোপে এইরকম ভূতকে মারা হয় কী দিয়ে জানেন? ক্রুশের ভয় দেখিয়ে অথবা রসুনের মালা দিয়ে। কিন্তু বাংলার জল-হাওয়া খেয়ে নেওয়া কুমুদিনীর ভূত কি আর অত সহজে মরবার পাত্রী! তাই হেমেন রায় কুমুদিনীকে শেষ পর্যন্ত লোহার শাবল দিয়ে মারলেন। আমাদের দেশের বিশ্বাস, লোহা ছুঁয়ে থাকলে ভূত-প্রেতে কোনও ক্ষতি করতে পারে না। তাই তো মৃত মানুষকে দাহ করে আসবার পরে, ঘরে ঢুকবার আগে এক টুকরো লোহা ছুঁয়ে নিতে হয়। অবশ্য শুধু লোহা নয়, বাঙালি ভূত আরো অনেকগুলি বস্তুর কাছেই জব্দ। লোকবিশ্বাসে ভূত গঙ্গাজল আর তুলসী গাছে ডরায়! শশীচন্দ্র দত্তের 'দ্য ইয়ং জমিনদার' উপন্যাসের মধ্যে, এক উপকাহিনিতে পাই, 'দানব'-কে আটকাবার জন্য নায়ক গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা ব্যবহার করে। চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দেন সুকুমার সেন মশাই― "গঙ্গাজল তুলসী-পাতা যথাক্রমে অলঙ্ঘ্য নদীর ও বনের আবির্ভাবের হিন্দুধর্মীয় রূপান্তর।" রাশিয়ার ইভান আর ভাসিলিসার রূপকথা মনে পড়ছে কি কারও কারও? তবে যমদত্ত মশাই ঠিকই লক্ষ করেছেন, পরশুরামের 'ভূশণ্ডীর মাঠে'-র ভূত ব্যতিক্রমী, না তো গঙ্গাজলে ডরায়, না তো ভয় পায় হাওড়ার লোহার পুলকে― "পরশুরাম গঙ্গার পূর্ব-পারের পানিহাটির ভূতকে গঙ্গাপার করাইয়া রিষড়া-কোন্নগরে লইয়া গিয়াছেন।"





লোকবিশ্বাসে ভূত তাড়ানোর জন্য মন্ত্র-পড়া সরষে খুব জনপ্রিয়। চমৎকার একখানা ভূত-ভাগানো 'মন্ত্র'-ও মিলবে ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে―
"অরে রে খবিস তোরে ডাকে ব্রহ্মদূত।
ও তোর মাতারি তুই উহারি সে পুত।।
কুপী ভরি গিলাইব হারামের হাড়।
ফতেমা বিবীর আজ্ঞা ছাড় ছাড় ছাড়।।"
ঝাঁটা-পেটা আর হলুদপোড়াকেও ভয়ংকর ভয় পায় ভূতের দল! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হলুদপোড়া' গল্পটি-তো আপনাদের মনে আছেই। গন্ধের চোটে ভূত পালায়― লোকমুখে এমন একটা কথা শুনতে পেলেও, আমরা এর কোনও সাহিত্যিক নিদর্শন পাইনি। তবে ভূতে নাকি "থুতু"-কে ভারী ভয় পায়, এ কথাটা আমাদের জানিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর 'ইঁদারায় গণ্ডগোল' গল্পে কুয়োতে আশ্রয় নেওয়া একদল 'পান্তো ভূত'-কে, তাদের ভিটে থেকে উৎখাত করার জন্য কেশব ভট্টাচার্য জলে থুতু ফেলার ভয় দেখান― "বলার সঙ্গে সঙ্গে ভূতেরা আঁতকে উঠে দশ হাত পিছিয়ে চেঁচাতে থাকে, "থুতু ফেলবেন না! থুতু দেবেন না!"



ও হ্যাঁ! আরেকটা কথা। যাঁরা ভাবছেন, রামনামের কথাটা বাদ দিলাম কেন, তাদের জানিয়ে রাখি, আছে, আছে ওটাও আছে! অনেকগুলো কথা তো! পরের দিন না-হয় জমিয়ে বলা যাবে।

#

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

45

Unique Visitors

182684