নিবন্ধ

কলকাতার ভূত

নির্মাল্য কুমার ঘোষ Aug 23, 2020 at 5:42 am নিবন্ধ

৺ওরা থাকে ওপারে (সপ্তম কিস্তি)



আচ্ছা, "কলকাতার ভূত" বললেই আপনার কী মনে পড়ে? সেন্ট জনস চার্চের সমাধিভূমি-সংলগ্ন আকাশবাণীর গার্স্টিন প্লেসের অফিসে, সাহেব-ভূত রাতের বেলা পিয়ানো বাজিয়ে যান আর আলিপুরের বেলভেডিয়ার ভবন থুড়ি জাতীয় গ্রন্থাগারে আজও রাত্রে ঘোড়া ছুটিয়ে ফেরত আসেন হেস্টিংসের ভূত– এই সবই তো! তাই না? ঠিক কথা। ঐতিহাসিক শহর, ভূতেরাও সব ঐতিহাসিক। হেস্টিংস হাউসে ফেলে যাওয়া একখানা কাঠের বাক্স, যা খুঁজে পাওয়ার জন্য ভূতপূর্ব বড়লাট হেস্টিংস সাহেব ক্যালকাটা গেজেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে দুহাজার রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, সেই বাক্স খুঁজতে নাকি হেস্টিংসের আত্মা আসত সে বাড়িতে! স্বয়ং লর্ড কার্জন সাহেব ১৯০১ সালেও নাকি তাঁকে দেখেছেন! আলিপুর ছাড়িয়ে মেটিয়াবুরুজের একখানা ঘাট আছে, যার নাম ভূতঘাট। লা মার্টিনিয়ার স্কুল-হোস্টেলের মেয়েরা আবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেও নাকি ভূতের দেখা পেয়েছিল! আর আজ যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং, সেইখানে একসময় ছিল এক গোরস্থান। ফলে রাতের বেলা ওই বাড়িতে এখনো হেঁটে-চলে বেড়ান দীর্ঘকায় সব ইংরেজ সাহেবরা। এতেই শেষ নয়। চিৎপুর অঞ্চলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যেখানে এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অংশ, সেখানেই নাকি ১৯৬২ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভূতকেও দেখেছিলেন জনৈক ব্যক্তি! আর হাতিবাগান, যা ছিল কলকাতার থিয়েটারপাড়া, সেইখানে মিনার্ভা থিয়েটারে তো একখানা আস্ত পোষা ভূত ছিল বলেই, বিভিন্ন জনের কাছে গল্প শোনা যায়। এদের কথা বলে গেছেন অনেকেই। এ এম এফ আব্দুল আলীর 'ঘোস্ট স্টোরি অফ ওল্ড ক্যালকাটা', সুভাষ সমাজদারের 'পুরনো কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ি', দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের 'ভূতদর্শন' বা বারিদবরণ ঘোষের 'কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ি ও অন্যান্য প্রবন্ধ' বইতে, কলকাতার এই খুব চেনা ভূতুড়ে বাড়িগুলোকে নিয়ে প্রচুর গপপো পেয়ে যাবেন।


না, সেইসব ভূতেদের কথাই আরেকবার ফিরিয়ে বলব না আমরা। বরং বলব বাংলা গল্পে কলকাতার ভূতেদের কথা। খাস কলকাতার বুকেই ভূতের আমদানি করেছিলেন পরশুরাম। 'মহেশের মহাযাত্রা' নামের সে গল্প আপনাদের সকলেরই পড়া। কলকাতার প্রেক্ষাপটেই একটা দারুণ ভূতের গল্প লিখেছিলেন গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু। 'ভূত নিয়ে খেলা' নামের সেই গল্প বেরিয়েছিল দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী "দেবালয়"-এ ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে। লীলা মজুমদারের "চেতলার কাছে" অথবা বুদ্ধদেব বসুর "দিনে দুপুরে"-ও কলকাতার ভূতেরই গল্প, তবে তেমন ভয়-দেখানো গোছের নয়। শিবরাম চক্কোত্তি আবার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই "দশ নম্বর বাড়ির রহস্য" গল্পে, খাস আলিপুরেই ভৌতিক আবহ গড়ে তুলে, তাকে একেবারে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন কল্পবিজ্ঞানের হাতুড়ি মেরে! তবে কলকাতার ভূত নিয়ে সবচেয়ে বেশি লেখালেখি করেছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। খাস কলকাত্তাই মানুষ। উত্তর কলকাতার অলিগলি তাঁর নখদর্পণে ছিল। রাতের কলকাতার গুপ্ত রহস্যও খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি। তাঁর "কী" গল্পের শুরুতেই পাই– "লোকে বলত আটাশ নম্বর হরি বোস স্ট্রীটে যারা বাস করে, তাদের সবাই মানুষ নয়।" আবার "ভূত-পেত্নীর কথা" নামের এক গল্পে হেমেন রায় শুনিয়েছেন কলকাতার জয় মিত্র স্ট্রিটের বাড়ি অথবা পে-অফিস লেনের বাড়িতে সত্যিকারের ভূত দেখার স্মৃতিকথা। পাথুরিয়াঘাটায় পৈতৃক বসতবাড়িতে, তাঁর বাবা কেমনধারা ভূত দেখেছিলেন সে গল্পও শুনিয়েছেন হেমেন্দ্রকুমার। আর ব্রাম স্টোকারের "ড্রাকুলা", যাকে হেমেন রায় "বিশালগড়ের দুঃশাসন" নাম দিয়ে বাংলায় রূপান্তর করেছিলেন, তাতে তো ড্রাকুলা ওরফে রক্তচোষা বাদুড়-মানুষটিকে এক্কেবারে খাস কলকাতার বুকেই টেনে এনেছিলেন তিনি। তবে এ'সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় তাঁর "টেলিফোন" গল্পখানা! প্রবল ঝড় বৃষ্টির রাত্রে সাত নম্বর সাতকড়ি সেন স্ট্রিটে, টেলিফোনের পাওয়া "কল"-এ গিয়ে যখন ডাক্তার বুঝতে পারেন যে, তাঁকে কল করেছিল পচে-গলে যাওয়া এক শবদেহ, তখন কলকাতার ইট-কাঠের ভিতরেও যে হৃৎপিণ্ড অবধি শিউরে-ওঠা ভয়াল ভয়ংকর কিছু রয়ে গেছে, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না!


কলকাতার ভূতেদের গল্প শোনানোর অবশ্য একটা মস্ত বড় সমস্যা আছে। সমস্যা হল এই যে, আস্তে আস্তে কলকাতা যত গায়ে-গতরে বাড়ছিল, ভূতেরা ততই ঠাঁইনাড়া হচ্ছিল। কেন? তা ধরুন, ত্রৈলোক্যনাথ বলেছিলেন মানুষের মনের অন্ধকার জমে নাকি ভূত হয়! সে আমরা জানি না, ততটা গবেষণা আমাদের নেই, তবে এটা তো ঠিক যে, অন্ধকার ছাড়া ভূতেদের গতি নেই! আর শহর কলকাতা তার আলোর জোরেই তেঁনাদেরকে এক্কেবারে উদ্বাস্তু করে ছাড়ছিল!রবীন্দ্রনাথ 'ছেলেবেলা' বইতে লিখেছিলেন– "তখন ভূতপ্রেত ছিল গল্পেগুজবে, ছিল মানুষের মনের আনাচে কানাচে। .... সেই ব্রহ্মদত্যির ঠিকানা আর পাওয়া যায় না। ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।" মনের "ভিতরে" কেমন করে আলো বেড়ে যাচ্ছিল, সে'কথা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি "ইষ্টিরসের দাপট"-এ।

নজরে থাকুকঃ

৺ওরা থাকে ওপারেঃ ষষ্ঠ কিস্তিঃ ওঁরা 'নামে' যেভাবে


এবার নজর ফেরানো যাক "বাইরে"-র আলোর দিকে। রেড়ি পিদিমের কাঁপা-কাঁপা নিভু আলোয় বাসা বেঁধেছিল যেসব বাঙালি ভূতেরা, তারা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সাগরপারের আমদানি গ্যাসের আলো আর বিজলি বাতির সামনে পড়ে! ১৮৫৭ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় গ্যাসের আলোর আগমন। সৌজন্যে ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি। ভূতেদের আশ্রয় যে রাত্রির গহন অন্ধকার, গ্যাসের আলো কেড়ে নিল সেটুকুও–  "দিনরাত্রির নাই ভেদাভেদ দেখে শুনে প্রাণ জুড়াল।" একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর!! ১৮৮০-র দশকে কলকাতা মুখ দেখল বিজলি বাতির। দে শীল অ্যান্ড কোম্পানি খুলে বসল একচেটিয়া কারবার। বিশ শতকের গোড়াতেই জন্ম নিল ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই। তারপর থেকে, "বাইরে"-র আলোর থেকে একরকম পিঠ বাঁচিয়েই পালাতে হয়েছে কলকাতার ভূতেদের! কখনো তেঁনারা খুঁজে নিয়েছেন অন্ধকার গলিঘুঁজি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের "কলকাতার গলিতে" গল্পটা স্মরণ করুন। আর তা না হলে, তেঁনাদেরকে খাস কলকাতার বুকে দেখা দিতে হয়েছে সেরেফ লোডশেডিংয়ের সময়! ওই যে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই যেমন "অন্ধকারে" বলে একটা গল্প লিখেছিলেন না?


হাজারো সমস্যার চাপে পড়ে, আস্তে আস্তে মুছতে থাকবে  কলকাতার ভূতের গল্প!! ১৯৭৪ সালে দেব সাহিত্য কুটীরের যে পূজাবার্ষিকী বেরিয়েছিল "মণিদীপা" নামে, তাতেই ধনঞ্জয় বৈরাগী লিখেছিলেন "ভাইপোর পাল্লায় ভূত" গল্পটি।  গল্পের গোড়াতেই ধনঞ্জয় লিখে দেন কলকাতার ভূতেদের সমস্যার কথা–  "কলকাতায় আজকাল মারাত্মক রকম মানুষ বাড়ার ফলে ভূতেরা অনেকদিন কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছে। রাস্তায়, ঘাটে, মিটিং-এ, ট্রামে-বাসে হামেশা কত অদ্ভুত অদ্ভুত লোক দেখতে পাই, কিন্তু ভূত একটিও না।  বাড়ির চাহিদা এত বেড়েছে যে একটিও ভূতুড়ে বাড়ি আর নেই। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম হেস্টিংস সাহেবের ভূত ঘোড়ায় চড়ে ভোরবেলা টগবগ করে ময়দানে ঘুরে বেড়াত।  এ কাহিনীও এখন আর কেউ বলে না।" ফলে হেমেন্দ্রকুমার রায় যখন আর্থার কোনান ডয়েলের "Lot-249" গল্পের ছায়া অবলম্বনে লিখবেন "মড়ার মৃত্যু", তখনও শহর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র থেকে বুদ্ধি করে গল্পকে টেনে নিয়ে যাবেন শহরতলিতে–  "দিলীপ আজ চার বছর কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রজীবন যাপন করছে। সে নির্জনতা ভালোবাসত বলে টালিগঞ্জের এমন এক জায়গায় বাসা নিয়েছিল যেখানে লোকালয় কম, মাঠ-ময়দান ও গাছপালাই বেশি। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর পিছন দিয়ে যে সুদীর্ঘ রাস্তাটি সোজা গড়িয়াহাটার দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে, দিলীপের বাসাবাড়িটি ছিল তারই এক ধারে।" ক্রমশ নির্জনতা, বনাঞ্চল, অন্ধকারের খোঁজে শহর কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলিতে, তারপর সেই শহরতলিও যখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকবে কলকাতারই প্রসারিত অংশ, তখন তাকেও ছাড়িয়ে আরো সুদূর গ্রামের প্রত্যন্ত প্রান্তরে, নির্জন বনাঞ্চলে, ডাকবাংলোয়, পোড়োবাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে বাংলা ভূতের গল্পের প্রেক্ষাপট। এগুলো আগেও ছিল, এখনো আছে। মাঝখান থেকে শুধু একেবারে মুছে সাফ হয়ে গেছে কলকাতার ভূতের গল্প! কলকাতার ভূতেরাই এখন ভূত!!

#ভূত #ওঁরা থাকে ওপারে #কলকাতা #কলকাতার ভূত #নির্মাল্য কুমার ঘোষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

135

Unique Visitors

183785