ফিরে পাওয়া কৈশোর – নতুন রহস্য সমাধানে ফেলুদা ও ব্যোমকেশ
বই রিভিউ: রাজধানীতে তুলকালাম / গরল তমসা
লেখক: প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: অভীক কুমার মৈত্র
প্রকাশক: সৃষ্টিসুখ
বইটা হাতে ধরে পড়তে বসে একটা আশঙ্কা ছিল, আদৌ কৈশোরের ভালোলাগার স্মৃতিগুলো শেষ অবধি টিকে থাকবে তো! প্রথমত, বাংলা সাহিত্যের দুই তারকা চরিত্রকে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে – ফেলুদা ও ব্যোমকেশ; অর্থাৎ সত্যজিৎ ও শরদিন্দু উভয়ের জুতোয় যুগপৎ পা গলানো। এ যে কী কঠিন পরীক্ষা সে একমাত্র বাবা তারকনাথই জানেন! দ্বিতীয়ত, গল্প বলার এই ধরনের সঙ্গেও বাংলা সাহিত্য বিশেষ পরিচিত নয়। মূল লেখকের ঘরানা মেনে, লেখার প্রেক্ষাপট ও বৈশিষ্ট্য এতটুকু না পাল্টে, বিখ্যাত কোনও চরিত্রকে নিয়ে নতুন গল্প লেখার এই ধারাকে বলে প্যাস্টিশ (Pastiche)। এর আগে বাংলায় যা কিছু লেখা হয়েছে তা মূলত ফ্যান-ফিকশন, যেমন হুকাকাশির অনুকরণে শিবরামের কল্কেকাশি বা ব্যোমকেশের ছেলে জাম্বোকে নিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর লেখাগুলি। শরদিন্দুবাবুর অসমাপ্ত ব্যোমকেশ-কাহিনি ‘বিশুপাল বধ’ অবশ্য নারায়ণ স্যান্যাল শেষ করেছিলেন মূল লেখনশৈলী মেনেই, সেদিক থেকে বাংলা প্যাস্টিশের পূর্বসূরি বলা চলে এই লেখাটিকে। কাজেই বুঝতে পারছেন, এক অর্থনীতির অধ্যাপক যখন এমন প্রকল্পে হাত দেন, তখন সেই দুরূহ প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়েও পাঠকমন খুব একটা স্বস্তিতে থাকে না।
অস্বস্তির অবকাশ যে আদৌ নেই, সেটা বোঝা যায় পড়া শুরু হলে। বইটিতে দুটি গল্প – প্রদোষ মিত্রকে নিয়ে ‘রাজধানীতে তুলকালাম’ এবং ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে ‘গরল তমসা’। উভয় ক্ষেত্রেই লেখকের কাছে কোনও খসড়া ছিল না, অর্থাৎ কোনও অসমাপ্ত লেখার রূপদান নয়, দুটি একেবারেই মৌলিক সৃষ্টি। পড়তে পড়তে অবাক হয়ে যেতে হয়, কী অনায়াস দক্ষতায় সত্যজিতের ঝরঝরে লেখনীগুণ করায়ত্ত করেছেন প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়! ফেলুদার গল্পের চেনাজানা মোটিফগুলি এত সুন্দর ভাবে কাজে লাগিয়েছেন, এক একসময় খেয়াল থাকে না যে এ কলম রায়মশাইয়ের নয়। ‘হত্যাপুরী’ আর ‘টিনটোরেটোর যীশু’ বাদে মোটামুটি ফেলুদার সব গল্পই শুরু হয় তাঁর কোনও বক্তব্য বা তোপসের কোনও বর্ণনা দিয়ে, সময়কাল অনেক ক্ষেত্রেই জটায়ুর সাম্প্রতিক উপন্যাস বেস্টসেলার হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে। এই কাহিনির বুননেও লেখক সে কথা মাথায় রেখেই এগিয়েছেন। লালমোহনবাবুর রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়ার অভিজ্ঞতা এবং হোটেলের লবি থেকে সিধুজ্যাঠাকে ট্রাঙ্ককল করার কথায় স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে গল্পের ঘটনাকাল সত্যজিত-বর্ণিত সময়রেখা মেনেই নির্মিত। গল্পের মূলে আছে জয়পুরের রাজপরিবারের মহামূল্যবান একটি শিল্পকর্ম, হিরে-জহরতে মোড়া একটি সোনার টিয়াপাখি এবং একটি খুন। এই ঘটনা ঘিরেই কুহকের শুরু ও শেষ। কিছুটা ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’র চেনা ছকে শুরু হলেও, গল্পের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। এই প্রথমবার রহস্যের সমাধানে ফেলুদাকে দিল্লিতে ঘাঁটি নিতে হয়েছে, বাক্স রহস্যের সময় দিল্লি ছুঁয়ে চলে যেতে হয়েছিল। ক্লাইম্যাক্সে রাজধানী এক্সপ্রেসের গুরুত্ব গল্পের নামকরণকে আলাদা মাত্রা দেয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বোধ করি লেখকের কৃতিত্ব তুঙ্গে উঠেছে লালমোহনবাবুর সংলাপ নির্মাণে। এই একটি জায়গা যেখানে সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কৌতুক থেকে ভাঁড়ামি হয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা, সেইটিকে লেখক অসামান্য দক্ষতায় সামলেছেন। অবশ্য এই গল্পে অপরাধ সংঘটনে জটায়ুরও কিঞ্চিৎ ভূমিকা আছে, তাতে পরিস্থতির গুরুত্ব এবং রসবোধ দুইই ভালোমত জমে ওঠে। শুধু ‘বিষ্যুদবার’-এর পরিবর্তে ‘বিষ্যুতবার’ লেখা দেখে সামান্য খুঁতখুঁতানি থেকে যায়। আশা করা যায় আগামী সংস্করণে এটুকু শুধরে নেওয়া যাবে।
লেখক সত্যজিতের সম্ভবত সবচাইতে ভরসার মানুষ ছিলেন রেখাশিল্পী সত্যজিৎ। এই দুইয়ের মেলবন্ধনে যে ম্যাজিক, কোনও একজনের অনুপস্থিতিতে তা পুনরুজ্জীবিত করা যায় কিনা সন্দেহ! অভীক মৈত্রের সরেস হাতখানি সে সন্দেহও দূর করেছে। ফেলুদা অ্যান্ড কোং-এর চিত্রায়নে তিনি রায়-অনুগামী নন, অথচ সাধারণ পাঠকমানসে সযত্নে লালিত অবয়বগুলিকেও অস্বীকার করেননি। তাঁর রেখায় ফেলু-তোপসে-জটায়ু আমাদের কল্পনাকে পুষ্ট করে, গল্পের যোগ্য ধরতাই দেয় এবং একইসঙ্গে শিল্পীর নিজস্ব শৈলীর ছাপ বজায় রাখে। ফেলুদার গল্পের তুলনায় নিঃসন্দেহে ব্যোমকেশের গল্পের অলংকরণ সহজতর। একে তো শরদিন্দুবাবুর মূল গল্পের সঙ্গে কোনও ছবি ছিল না, ‘সত্যান্বেষী’ আর ‘সীমন্ত-হীরা’ ব্যতিরেকে অন্য কোনও গল্পে ব্যোমকেশের শারীরিক গঠনের আভাসও মেলে না। কাজেই শিল্পীর স্বাধীনতা ছিল পুরোমাত্রায় এবং তিনিও তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ করেছেন। কীভাবে, তা জানার জন্য বইতে শিল্পীর মুখবন্ধটি অবশ্যপাঠ্য।
আরও পড়ুন: খসড়া থেকে সম্পূর্ণ শঙ্কু / সায়নদীপ গুপ্ত
অন্যদিকে শরদিন্দুবাবুর কলমখানা লেখক হাতে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর রসের দোয়াতটি রয়ে গেছে অধরা। ফলত, ব্যোমকেশ-অজিত-বীরেন দারোগার স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যগুলি যথাযথ ভাবে ফুটে উঠলেও কাহিনির বুনোট কিছুটা আলগা। রহস্যের গোড়াপত্তন যতটা যত্নে হয়েছে, যবনিকা পতনে সে যত্নের ছাপ কম। প্লেগ মহামারির সময়কালের রেঙ্গুন, কোকেনের চোরাচালান ইত্যাদির প্রসঙ্গ এসেছে কিন্তু তার বর্ণনায় অসঙ্গতি বিস্তর। ব্যোমকেশ যদিও বলেছে “কিছু জায়গায় আমার থিওরি আছে...”, কিন্তু অনুমানেরও একটা বাস্তব ভিত্তি চাই। ব্যোমকেশের অন্যান্য গল্পে তাঁর অনুমান-নির্ভরতা মূলত মানবমনের ধূসর গতিপ্রকৃতি ঘিরে; এখানে কোকেন পাচারের যে অদ্বিতীয় পদ্ধতি সে ব্যাখ্যা করেছে তার কোনও প্রমাণ গল্পে তো নেইই, এমনকি পুলিশ বা অন্যান্য সূত্রে এর কোনও আভাস যে ব্যোমকেশ পেয়েছে সে উল্লেখও নেই। ব্যোমকেশকে চিঠি লিখে অপরাধ কবুল করার প্রাসঙ্গিকতাও বোধগম্য হয় না। দেহোপজীবিনী শ্যামাকে খুন করে আংটি-সমেত অনামিকা কেটে নেওয়া এবং শেষে আবার সেই আংটি ফিরিয়ে দেওয়ার কারণও খুবই অপরিপক্ক। আর হ্যাঁ, শীতের কলকাতায় জাপানি বোমারু বিমান হামলার উল্লেখ থাকায় ধরে নেওয়া যায় ঘটনাকাল ১৯৪২-এর ডিসেম্বর, অর্থাৎ ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর সাক্ষাতের প্রায় ন-বছর অতিক্রান্ত। অথচ গল্পে সত্যবতীর উল্লেখটুকুও নেই। তাতে যদিও খুঁত ধরার জায়গা বিশেষ নেই, কারণ শরদিন্দু নিজেই ‘অর্থমনর্থম’-এর পরবর্তী কিছু গল্পে সত্যবতীর প্রসঙ্গমাত্র আনেননি। লেখক মাথা খাটিয়ে এমন একটা সময়কাল বেছেছেন যখন শরদিন্দু ব্যোমকেশকে নিয়ে একটিও গল্প লেখেননি (১৯৩৮-৫১), তাই সাধারণ পাঠক হিসেবে সাংসারিক ব্যোমকেশের রসবোধটুকু দেখার ইচ্ছে অতৃপ্তই থেকে যায়। তবে শরদিন্দুর বাঁধুনি খোঁজার চেষ্টা সরিয়ে রেখে প্রবীরেন্দ্রর সৎ প্রচেষ্টা হিসেবে যদি পড়েন, এতটুকুও ঠকবেন না।
পরিশেষে বলি, যেসব গোঁড়া সমালোচকরা “ক্লাসিকের জগতে এ কোন কালাপাহাড়!” বলে চেঁচামেচি করছেন বা যেসকল সদ্যজাত লেখক-লেখিকারা উদো থ্রিলারের পিন্ডি বুধো ইতিহাসের ঘাড়ে চাপিয়ে, পেইড রিভিউ আর সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং-এর দৌলতে নিজেদের বেস্টসেলার প্রমাণ করতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন, তারা কার্ডিফ-নিবাসী এই অধ্যাপকটির থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করতে পারেন। প্রকৃত গোয়েন্দা-গল্প লেখার এমন বলিষ্ঠ লেখনী এখনও আপনাদের অধরা।
*************
#ফেলুদা #প্রদোষ মিত্র # ব্যোমকেশ বক্সী # অজিত # শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় # সত্যজিৎ রায় # রাজধানীতে তুলকালাম # গরলতমসা # কলকাতা # দিল্লি # জটায়ু # রহস্য # ডিটেকটিভ # সত্যান্বেষী # প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় # সুচরিতা বসু # সিলি পয়েন্ট #বইয়ের খবর # রিভিউ #গল্পের বই # বাংলা পোর্টাল # ওয়েবজিন #web portal