বইয়ের খবর

খসড়া থেকে সম্পূর্ণ শঙ্কু

সায়নদীপ গুপ্ত June 15, 2021 at 6:47 am বইয়ের খবর

বই: স্বমহিমায় শঙ্কু
প্রকাশক: কল্পবিশ্ব
লেখক: সত্যজিৎ রায় ও সুদীপ দেব
প্রকাশকাল: ২০২০



প্যাস্টিশের (Pastiche) সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। বিস্তর মাথা চুলকে ‘অনুকরণ শিল্প’ বলা যায় বটে, তবে তাতেও সবটা বলা হয় না। চলতি নিয়মানুযায়ী, মূল লেখকের লেখনশৈলী থেকে একটুও না সরে এবং মূল চরিত্রদের যা কিছু বৈশিষ্ট্য এবং প্রেক্ষাপট, তা যথাসম্ভব এক রেখে নতুন গল্পের অবতারণাই প্যাস্টিশ। সেইদিক থেকে দেখলে একে অনুসরণ শিল্পও বলা চলে। বলাই বাহুল্য, এই অনুসরণের পদে পদে কাঁটা আর তার মধ্যে সম্ভবত সবচাইতে বেশি খোঁচায় মূল লেখকের খ্যাতির ওজন। বিশেষ করে সে লেখকের নাম যদি হয় সত্যজিৎ রায়! বাঙালি পাঠকবর্গ এমনিতেও সাহিত্যের এই ধারার সঙ্গে অতটা পরিচিত নন, তার উপর “আইকন” নিয়ে খোদকারি তাঁরা মোটেই খুব একটা পছন্দ করেন না। সেইসব গোঁড়া পাঠকের চোখে এই বই কতটা আদৃত হবে তা জানা সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু এটুকু আপাতত বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে এই নতুন ধারায় লেখক সুদীপ দেবের কলম এক সার্থক সংযোজন।

প্রোফেসর শঙ্কুর দুইটি অসমাপ্ত কাহিনির সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে প্রকাশিত “স্বমহিমায় শঙ্কু”, দুইটিরই প্রাথমিক অংশ সত্যজিৎ রায়ের লেখা। দক্ষ কসমেটিক সার্জনের মতো সুদীপ সেই জায়গা থেকে গল্পদুটি এমন ভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যে নেহাত বলে না দিলে সেলাইয়ের দাগ বোঝা দুষ্কর। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পর ১৯৯২ সালের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় এই দুটি গল্পের অসমাপ্ত খসড়া প্রকাশিত হয়। সেই মূল খসড়া অনুযায়ী, প্রথম গল্প “ইনটেলেকট্রন”-এ শঙ্কু এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যা মানুষের বুদ্ধির পরিমাপক, সদ্য হামবুর্গের এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। এমতাবস্থায় সেখানে আসেন নকুড়বাবু, এবং স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অনাগত বিপদ সম্পর্কে শঙ্কুকে সাবধান করেন। দ্বিতীয় গল্প “ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা”-তে দেখা যায় জন্মদিনের সকালে স্মৃতিচারণায় মগ্ন শঙ্কুকে। সেই সময় বিখ্যাত বায়োকেমিস্ট জন ড্রেক্সেলের ছেলে এসে তাঁকে নিজের বাবার মৃত্যুসংবাদ জানায় এবং বাবার অসমাপ্ত গবেষণার দায়িত্ব শঙ্কুকে নিতে অনুরোধ করে। এরপরে এই দুই গল্পে রহস্য কীভাবে জট পাকায় আর শঙ্কু কীভাবে সেই জট ছাড়ান তা নিয়ে আলোচনা করলে গল্প পড়ার মজাই মাটি! এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কাহিনির চলনে কোথাও এতটুকু বিচ্যুতি ঘটেনি; বইয়ের পাতা উল্টালে সেই পুরনো স্মৃতিমেদুরতা ফেরত আসতে বাধ্য। গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লেখক কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ছকের সাহায্য নিয়েছেন, যা আদতে সত্যজিতের লিখে যাওয়া বাকি গল্পের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেমন, হামবুর্গের সম্মেলনের পরিপ্রেক্ষিতে উইলহেল্‌ম ক্রোলের উপস্থিতি। ক্রোলের বাড়ি যেহেতু মিউনিখে, তাই তাঁর আসাটা একান্তই স্বাভাবিক। আর এটাও লক্ষণীয় যে খুব বড়ো মাপের কোনও অভিযান ছাড়া সত্যজিৎ কিন্তু শঙ্কুর সঙ্গে সন্ডার্স ও ক্রোল দুজনকেই সঙ্গী করেননি। প্রথম গল্পের ঘটনাপ্রবাহ কিছু অংশে “প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু” গল্পের ছায়া অনুসারী, যদিও উন্নত বুদ্ধি ও কৃত্রিম বুদ্ধিকে একসঙ্গে হাজির করাটা একেবারেই স্বতন্ত্র। চেনা চরিত্রগুলির আদবকায়দা, আকস্মিক অভিব্যক্তি – সবকিছুই মূলধারা মেনেই যথাযথ ভাবে সাজানো। এমনকি নকুড়বাবুর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে লেখক নব্বইয়ের দশকে দাঁড়িয়ে দিব্যি একুশ শতক ছুঁয়ে এসেছেন। তবে এই ব্যাপারটাকে যদি কোনোভাবে গল্পের উপসংহারে কাজে লাগানো যেত, কাহিনির ধার আরও অন্যরকম হত! শুধু একটিমাত্র খটকা থেকে যায়, গল্পের অন্যতম চরিত্র প্যাট্রিক হফমান শঙ্কুকে বারকয়েক “শ্যাঙ্কো” বলে সম্বোধন করায় তাঁকে “বাধ্য হয়েই ... উচ্চারণটা শুধরে দিতে হল”। কেন? এর আগে শঙ্কুকে বিজাতীয় উচ্চারণের জ্বালা তো কম কিছু সহ্য করতে হয়নি। ইজিপ্টের মাটিতে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস সামারটন তাঁকে বলেছেন “শ্যাঙ্কু”, কোচাবাম্বার গুহায় বন্ধু ডামবার্টন বলেন “শ্যাঙ্কস্‌”; সব ছেড়ে তাঁর খামোখা স্বল্পখ্যাত এক বিজ্ঞানীকে শুধরে দেওয়ার ইচ্ছে হল কেন? লেখক সম্ভবত এই ব্যাপারে আলাদা কোনও ইঙ্গিত রাখতে চাননি, কিন্তু এও তিনি মাথায় রাখেননি যে এই বিষয়ে ভাবিত হওয়াটা শঙ্কুর চরিত্রেই নেই। তবে এমন একটি-দুটি অদরকারি সূত্র বাদ দিলে, মানের দিক থেকে বাকি গল্প যথেষ্টই ভালো। 

তুলনামূলক ভাবে “ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা” আরও বেশি আকর্ষণীয় এবং নতুন করে লেখার বিচারে লেখকের কাছে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এই গল্পের খসড়ার সঙ্গে সত্যজিত-রচিত সর্বশেষ শঙ্কু কাহিনি “স্বর্ণপর্ণী”-র অত্যাশ্চর্য মিল। দুই গল্পের শুরুই প্রায় হুবহু এক। “স্বর্ণপর্ণী” প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে আর তার পরের বছর সত্যজিৎ “ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা” লেখায় হাত দেন, সম্ভবত শুরুর দিকে প্লটের পুনরাবৃত্তি দেখেই এই গল্প আর এগোতে চাননি। এই পুনরাবৃত্তিই লেখকের জন্য বিপদের যথেষ্ট কারণ হতে পারত, কিন্তু তিনি স্বীয় দক্ষতায় গল্পকে একেবারে অন্য ভাবে ভেবেছেন। যদিও গল্পের প্রেক্ষাপট সাজানোয় “মানরো দ্বীপের রহস্য”-এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু এরকম প্রভাব স্রষ্টার নিজের লেখাতেও ঘুরেফিরে এসেছে বহুবার। সত্যজিতের কাহিনির নায়কদের মূল বৈশিষ্ট্য হল তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা। শঙ্কুর সবকয়টি গল্পের মধ্যেই তাঁর নির্লোভ মনোভাব, প্রায় ঋষিতুল্য প্রজ্ঞা এবং বিপদের সময়ে ঘাবড়ে গেলেও পারিপার্শ্বিকের উপর নজর রাখার অভ্যেস লক্ষ্য করা যায়। সত্যজিতের রেখে যাওয়া কলম হাতে নেওয়ার সময় এর কোনোটিই ভোলেননি সুদীপ এবং এই গল্পে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখেন! শঙ্কুর গল্পগুলিতে বিজ্ঞানের তুলনায় কল্পনা এবং মানবিক ভাবনার প্রয়োগই বেশি। সুদীপ বরং একধাপ এগিয়ে রক্তের ABO গ্রুপিং, জিনতত্ত্বের মতো প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণা নিয়ে এসেছেন, যা আদতে এই কাহিনিকে কল্পবিজ্ঞানের আধুনিক ধারায় স্থান করে দেয়। ভারতীয় লোকগাথা ও অলৌকিকতাকে সত্যজিৎ যেমন বারেবারে গল্পের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছেন, সেই পথে চলেই অবিনাশবাবুর মতো চরিত্রকে সার্থক ভাবে কাজে লাগিয়েছেন লেখক। 

হর্ষমোহন চট্টরাজের আঁকা প্রচ্ছদ এই বইয়ের এক বিশেষ প্রাপ্তি, এক লহমায় পুরনো সংকলনগুলির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই তুলনায় ভিতরের অলংকরণগুলি মানানসই হলেও অতটা মনোগ্রাহী নয়। সবশেষে লেখক পরিচিতির ছবিতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় ও সুদীপ দেব উভয়েরই অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়! আশা রাখি, সাহিত্যের রসমুগ্ধ পাঠক ওটুকু নিজগুণে এড়িয়ে যাবেন। তবে পরিশিষ্টে প্রোফেসর শঙ্কুর বিভিন্ন আবিষ্কারের যে তালিকা সংযোজিত হয়েছে তাতে “প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল” গল্পে বর্ণিত “কার্বোথিন”-এর কোনোই উল্লেখ না-থাকাকে তারা কীভাবে নেবেন, সে কথা বলতে পারিনা। 



[কভার: আলোচ্য বইটির প্রচ্ছদ]

#বাংলা #বই #রিভিউ #সায়নদীপ গুপ্ত #সত্যজিৎ রায় #শঙ্কু #কল্পবিশ্ব

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

35

Unique Visitors

219276