নিবন্ধ

সমকাল ও জগদীশচন্দ্র প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (অষ্টম পর্ব)

অর্পণ পাল Feb 17, 2021 at 5:00 am নিবন্ধ

................................

 [রবীন্দ্র-রচনায় জগদীশচন্দ্রের সাহায্য]

.......................................

শিলাইদহে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প লেখবার উৎসমুখ যেন নতুন করে খুলে যায়। এর আগে তেইশ বছর বয়সে তিনি ঘাটের কথা ও রাজপথের কথা নামে দুটি গল্প লিখেছিলেন বটে, তবে এই সময়ে তার লেখা গল্পগুলোর সাহিত্যগুণ বা সৌন্দর্য সে গল্পদুটিকে অনায়াসে ছাপিয়ে যায়। আর এর পিছনে প্রধান কারণ ছিল বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নিবিড়ভাবে যোগাযোগ স্থাপিত হওয়া।  

১৮৯১ সালের দিকে, তখন কবির বয়স প্রায় চল্লিশ, যেন এক ‘গল্পপ্রবাহের সূত্রপাত হল’ (শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথনাথ বিশী, ৫৩ পৃ) কবির হাত থেকে। একের পর এক লিখে চললেন ‘ছুটি’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সমাপ্তি’, ‘অতিথি’, ‘নিশীথে’ ইত্যাদি অসাধারণ সব ছোটগল্প। আদর্শ ছোটগল্পের চেহারা বা প্রকরণ কেমন হওয়া উচিত, নিজের যেন তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা এবং প্রামাণ্য নমুনা নির্ধারণ করে দিলেন। 

আর এই সময়কালের প্রায় সব গল্পেই যেন এক চরিত্র হয়েই বিরাজ করত পদ্মাকূলের গ্রামীণ জীবন। 

যে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করবেন বলে সপ্তাহান্তে কলকাতা থেকে চলে আসতেন জগদীশচন্দ্র। বন্ধুর কাছে তার ফরমায়েস থাকত, তিনি এলে যেন নতুন গল্প বা কবিতা শোনবার সুযোগ থেকে কবিবন্ধু তাঁকে বঞ্চিত না করেন। রবীন্দ্রনাথও বন্ধুর আবদার নিষ্ঠাভরে মেটাবার প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। এতে অবশ্য তাঁর অন্য এক দিক থেকেও লাভ হত, কলকাতাকেন্দ্রিক সাময়িকপত্রের জন্য লেখা পাঠাবার যে তাগাদা, সেটাকেও তিনি মেটাতে পারতেন। 

ছোটগল্পের পাশাপাশি জগদীশচন্দ্রকে কবি শোনাতেন তাঁর সদ্য লেখা কবিতাও। তাছাড়া কলকাতায় থাকুন বা বাইরে, জগদীশচন্দ্র সবসময়েই সঙ্গে বহন করতেন কবির লেখা বইও। ১৮৯৯-এর ২০ মে তারিখের চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে লেখেন, ‘...আপনার গ্রন্থাবলী পড়িতেছিলাম। আপনার পৌরাণিক কবিতাগুলি সর্ব্বাংশে সুন্দর হইয়াছে। এগুলি কবে সম্পূর্ণ করিবেন? এখন ভারতীর বোঝা গিয়াছে! মহাভারত হইতে আরও অনেকগুলি লিখিবেন। একবার ‘কর্ণ’ সম্বন্ধে লিখিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম। ভীষ্মের দেবচরিত্রে আমরা অভিভূত হই, কিন্তু কর্ণের দোষ গুণ মিশ্রিত অপরিপূর্ণ জীবনের সহিত আমাদের অনেকটা সহানুভূতি হয়। ঘটনাচক্রে যাহার জীবন পূর্ণ হইতে পারে নাই, যাহার জীবনে ক্ষুদ্রতা ও মহৎভাবের সংগ্রাম সর্ব্বদা প্রজ্বলিত ছিল, যে এক এক সময়ে মানুষ হইয়াও দেবতা হইতে পারিত এবং যাহার পরাজয়, জয় অপেক্ষাও মহত্তর, তাহার দিকে মন সহজেই আকৃষ্ট হয়।’

কর্ণ চরিত্রের প্রতি জগদীশচন্দ্রের এই আকৃষ্ট হওয়ার মানসিকতা আমরা দেখেছি আগেও, আর এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার, তাঁর এই মহাভারতের প্রতি, বা বিশেষ করে কর্ণের প্রতি পক্ষপাত গড়ে ওঠবার পিছনে বেশ কিছুটা দায়ী পূর্ববঙ্গে ছোটবেলায় তাঁর পৌরাণিক যাত্রা দেখবার অভ্যেসটি। 

রবীন্দ্রনাথও বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন, মাস কয়েক পরে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’। তবে জগদীশচন্দ্রের চিঠিটি পড়ে বোঝার উপায় নেই তিনি রবীন্দ্রনাথের ঠিক কোন কবিতাটি পড়ে মুগ্ধতা জানিয়েছিলেন। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল অনুমান করেছেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ আর ‘বিদায় অভিশাপ’-এর কথা। 

এরপরে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশ কয়েকটি পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে কবিতা রচনা করেন, সেগুলি একত্রিত করে ১৯০০ সালের ১৪ জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত হয় ‘কথা’। যে বইটি তিনি উৎসর্গ করেন জগদীশচন্দ্রকেই, লিখে দেন— 

‘সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানাচার্য্য/ করকমলেষু।’

আর নিচে— ‘সত্যরত্ন তুমি দিলে, —পরিবর্ত্তে তার

            কথা ও কল্পনামাত্র দিনু উপহার।’

‘কথা’র ওই প্রথম সংস্করণে কবিতা ছিল ২৪টি, পরে আরও একটি সমধর্মী কাব্যগ্রন্থ ‘কাহিনী’ প্রকাশিত হয়, এবং আরও পরে ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস থেকে দুটি বইই একত্রি হয়ে ‘কথা ও কাহিনী’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে। এখন বইটি এই নামেই প্রচলিত। প্রসঙ্গত, এই ‘কাহিনী’ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যকে।  


২/ 

প্রবাসে জগদীশচন্দ্রের নিত্যসঙ্গী হিসেবে থাকত রবীন্দ্র-রচনা, আগেই বলেছি। রবীন্দ্রনাথও তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই জগদীশচন্দ্রকে পাঠাতে দেরী করতেন না। এরকমভাবেই, ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ বইয়ের প্রথম খণ্ডটি বিদেশে জগদীশচন্দ্রের কাছে পৌঁছে যায়।  

খুব সাধারণ একটি ঘটনা, কিন্তু এই বইটির জগদীশচন্দ্রের হাতে পৌঁছানোর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। কীরকম? 

এজন্য ১৯০০ সালের নভেম্বরের ২ তারিখে রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্রের চিঠিটি একবার দেখা দরকার। এক হিসেবে এই চিঠিটির একটি বিশেষত্ব আছে; এই চিঠি থেকেই তিনি বন্ধুকে ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে শুরু করেন। যা জারি থাকবে আজীবন। 

আর এই চিঠিতেই ছিল সেই বিশেষ প্রসঙ্গ। বন্ধুর রচনাকে বিদেশের পাঠক মহলে প্রকাশ করবার জন্য উদ্বেগ আর পরিকল্পনার কথা। জগদীশচন্দ্র লেখেন, ‘তুমি পল্লীগ্রামে লুক্কায়িত থাকিবে আমি তাহা হইতে দিব না। তুমি তোমার কবিতাগুলি কেন এরূপ ভাষায় লিখ যাহাতে অন্য কোন ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব? কিন্তু তোমার গল্পগুলি আমি এ দেশে প্রকাশ করিব। লোকে তাহা হইলে কতক বুঝিতে পারিবে। আর ভাবিয়া দেখিও, তুমি সার্ব্বভৌমিক। এদেশের অনেকের সহিত তোমার লেখা লইয়া কথা হইয়াছিল। একজনের সহিত কথা আছে (শীঘ্রই তিনি চলিয়া যাইবেন) যদি তোমার গল্প ইতিমধ্যে আসে তবে তাহা প্রকাশ করিব। Mrs. Knight কে অন্য একটি দিব। প্রথমোক্ত বন্ধুর দ্বারা লিখাইতে পারিলে অতি সুন্দর হইবে। তার পর লোকেনকে ধরিয়া translate করাইতে পার না? আমি তাহাকে অনেক অনুনয় করিয়া লিখিয়াছি।’ (বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রকাশিত ‘পত্রাবলী’, ১৯ নং পত্র, ৪৪ পৃ) 

এখানে বেশ কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। প্রথমত, এই চিঠি পাওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর জন্য তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ বইটি পোস্ট করেই দিয়েছিলেন, যেটি বন্ধুর হাতে পৌঁছয় নভেম্বর মাসেই। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ নিজে মনে করতেন তাঁর এই গল্পগুচ্ছ বইটিতে তর্জমার যোগ্য গল্প রয়েছে কয়েকটিই— পোষ্টমাষ্টার, কঙ্কাল, নিশীথে, কাবুলিওয়ালা আর প্রতিবেশিনী। তবে জগদীশচন্দ্রের প্রস্তাবমত অনুবাদক ওই মিসেস নাইটের রচনা-নৈপুণ্যের ওপর তাঁর যে আস্থা ছিল না, সেটা জানা যায় তাঁর একটি চিঠি থেকে। 

আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (সপ্তম পর্ব) / অর্পণ পাল

তৃতীয়ত, এই ‘প্রথমোক্ত বন্ধু’টি কে, তা নিয়ে জল্পনা চললেও ইনি যে ভগিনী নিবেদিতা, তা জানিয়েছেন অনেকেই। আর নিবেদিতাও এই সময়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন বিজ্ঞানের কাজ আর অনুবাদের কাজে। বিজ্ঞানের কাজ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার বা তত্ত্বাদিকে প্রাঞ্জল ভাষায় লেখার কাজে জগদীশচন্দ্রকে সাহায্য করাকে, আর অনুবাদ বলতে এই রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্পের অনুবাদই। তাঁর অন্য একটি চিঠিতেও এই প্রসঙ্গ ছিল। 

জগদীশচন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া গল্পগুলো থেকে বেছে নিয়ে দিন কয়েকের মধ্যেই নিবেদিতা অনুবাদ করে ফেলেন তিনটি গল্প। অবশ্য তাঁকে বসু-দম্পতি সাহায্য করেছিলেন নিশ্চয়ই। ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’ আর ‘দান প্রতিদান’ এই গল্প তিনটিই এখন স্বীকৃতভাবে রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম অনুবাদ, আর প্রথম অনুবাদিকা নিবেদিতাই। পরবর্তীকালে যাঁর ইংরেজি রচনা ভারতকে এনে দেবে প্রথম নোবেল পুরস্কার, তাঁর রচনা বিদেশের মানুষের মধ্যে প্রচার শুরু হল সেই প্রথমবার। 

জগদীশচন্দ্রও ততদিনে নিজের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও বন্ধুর রচনার প্রচার-ব্যাপারে পরিকল্পনায় মুখর ও উত্তেজিত। ২৩ নভেম্বর বন্ধুকে লেখেন, ‘তোমার পুস্তকের জন্য আমি অনেক মতলব করিয়াছি। তোমাকে যশোমণ্ডিত দেখিতে চাই। তুমি পল্লীগ্রামে আর থাকিতে পারিবে না। তোমার লেখা তরজমা করিয়া এদেশীয় বন্ধুদিগকে শুনাইয়া থাকি, তাঁহারা অশ্রুসম্বরণ করিতে পারেন না। তবে কি করিয়া publish করিতে হইবে, এখনও জানি না। Publisherরা ফাঁকি দিতে চায়। সে যাহা হউক তোমার ভাগে কেবল glory, লাভালাভের ভাগ্য আমার। যদি কিছু লাভ হয় তাহার অর্দ্ধেক তরজমাকারীর, আর অর্দ্ধেক কোন সদনুষ্ঠানে। ইহাতে তোমার আপত্তি আছে কি ? আমি অনেক castle in the air প্রস্তুত করিতেছি। 

এবার যদি তোমার নাম প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি তাহা হইলেই যথেষ্ট মনে করিব। ৬টি গল্প বাহির করিতে চাই। 

তোমার জগদীশ

শীঘ্র তোমার অন্যান্য গল্প পাঠাইবে। Mrs Knightকে দেই নাই। অন্যরূপে চেষ্টা করিব।’

এখানে একটাই কথা বলার, জগদীশচন্দ্র কেন অনুবাদকারীর নাম বন্ধুকে জানান না, সেটা বুঝে ওঠা দুষ্কর হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে ভালই চিনতেন, তাঁর সঙ্গে কোনও রকম শত্রুতাও ছিল না। তাহলে কেন বন্ধুর কাছে নিবেদিতার নাম তিনি গোপন করে যান বারবার? 

আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (ষষ্ঠ পর্ব) / অর্পণ পাল 

পরের বছরের জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে জগদীশচন্দ্রের লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে ততদিনে তিনটি গল্পের অনুবাদ সম্পূর্ণ, এবং জগদীশচন্দ্র সেগুলো যাঁদেরকে পড়ে শুনিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন (মিসেস ওলি বুল) তো ছুটি গল্পটি শুনে কেঁদে আকুল। বাকিরাও মুগ্ধ। গল্পগুলি নিয়ে বই হিসেবে প্রকাশ করবার জন্য প্রকাশকের সঙ্গে কথাবার্তাও চালানো হবে, ইচ্ছে ছিল জগদীশচন্দ্রের। তিনি এইসময় এক বা একাধিক গল্প পাঠিয়েছিলেন ‘Harder’s Magazine’ পত্রিকায়। কিন্তু তাঁরা দুঃখের সঙ্গে জানান যে, গল্প খুবই সুন্দর হলেও তাঁরা অনুবাদ ছাপান না। 

সুতরাং রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুবাদ সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে গেল। 

আরও দুঃখের ব্যাপার, এই তিনটি অনুবাদের মধ্যে দুটির কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না এখন। একটি গল্প ‘The Cabuliwallah’ অনেক পরে, ১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তার মাস তিনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন নিবেদিতা। 

রবীন্দ্রনাথের গল্পকে খেটেখুটে অনুবাদ করলেন, কিন্তু তাকে প্রকাশিত হতে দেখবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি! 

...........................................................................    

#জগদীশচন্দ্র বসু #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #Jagadish chandra Bose #Rabindranath Thakur #Series #পোস্টমাস্টার #সমাপ্তি #কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ # প্রশান্তকুমার পাল #গল্পগুচ্ছ #ভগিনী নিবেদিতা #অর্পণ পাল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

23

Unique Visitors

214985