নিবন্ধ

সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (ষষ্ঠ পর্ব)

অর্পণ পাল Jan 27, 2021 at 8:46 am নিবন্ধ

................................................

অবলা বসু ও রবীন্দ্রনাথ (২)  

..............................................

মৃণালিনী দেবীর প্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে আরও একটি আঘাত আসবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হল, তাঁর দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে ১৯০৩ এর মার্চে হাজারিবাগে গেলেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায়, কিন্তু তাতেও তাঁর অসুস্থতা খুব একটা কমল না। জ্বর, কাশি আর ক্ষয় রোগে ভুগে একরত্তি কিশোরী শীর্ণ হয়ে যেতে লাগলেন। তাঁকে একটু স্বস্তি দিতে জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের পরীক্ষাগারে বসে নিজের হাতে বানালেন অক্সিজেন তৈরির যন্ত্র; পরপর দু’দিন চিঠিতে লিখলেন রেণুকার জন্য নির্মিত সেই ‘কল’-এর কথা— ‘নূতন কলটা করিতে দেরী হইল। নিজ বাসভূমে আমি এখন পরবাসী, আমার মিস্ত্রী এখন অন্যের হাতে, দু একটু তাহার প্রয়োজন ছিল, এ জন্যেই দেরী হইল। আমি parcel post কাল পাঠাইব, আশা করি নির্ব্বিঘ্নেই পৌঁছিবে। রেণুকার খবর সর্ব্বদা জানাইও। যতদূর সম্ভব বাহিরে গাছতলায় উন্মুক্ত বাতাসে থাকিবার বন্দোবস্ত করিও।’

রুমকর্ফের আবেশ কুণ্ডলীর সাহায্যে অক্সিজেনের মধ্য দিয়ে তড়িৎমোক্ষণ করলে অক্সিজেন আংশিক ভাবে ওজোনে পরিণত হয়। ওজোন মিশ্রিত অক্সিজেন থেকে পারমাণবিক অবস্থায় (জায়মান অবস্থায়) অক্সিজেন শ্বাসক্রিয়ার পক্ষে অধিকতর উপযোগী। ... জগদীশচন্দ্রের ১৯ মার্চ ১৯০৩ তারিখের চিঠি থেকে অনুমিত হয় যে তিনি এই যন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথের অসুস্থা মধ্যমা কন্যা রেণুকা দেবীর জন্য তৈরী করেছিলেন। [পত্রাবলী-র টীকা] 

এরপরের দিনের চিঠিতে আছে কলটি ডাকে পাঠাবার কথা— ‘আজ ওজোনের কল ডাকে পাঠাই। একদিকে যে দুটি তার দেখিতেছ তাহার সঙ্গে রূমকর্ফ কয়েল লাগাইও। মুখ দিয়া আস্তে আস্তে বাতাস নিতে হইবে, অথবা এক নাসিকারন্ধ্র বন্ধ করিয়া অন্য দ্বারা শ্বাস নিতে হইবে। ইহাতে ওজোন অধিক পরিমাণে হইবে।’ চিঠির শেষে ছিল পার্সেলটি সাবধানে খুলবার পরামর্শও। 

দু’দিন পর ১৯ মার্চের চিঠিতেও জগদীশচন্দ্র জানতে চেয়েছিলেন রেণুকার সংবাদ, যদিও তখন রেণুকা মোটেই সুস্থ হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন না। চিন্তিত রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁকে নিয়ে আলমোড়া যাওয়ার বন্দোবস্ত শুরু করেছেন। 

অন্যদিকে জগদীশচন্দ্রের ঘরে তখন নতুন অতিথি আসবার আয়োজন। অবলা দেবী সন্তানসম্ভবা হয়েছেন, সে খবর জেনেছেন রবীন্দ্রনাথ। ওই ১৯ মার্চের চিঠিতেই জগদীশচন্দ্র লিখছেন, ‘রাম না হইতেই রামায়ণ! তোমার বধুঠাকুরাণী এখন হইতে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের নিকট কুটীর নির্ম্মাণ করিতে উৎসুক। আমি এখন আর কেহই নই, এখন ভবিষ্যৎ গ্যারিবল্ডী অপ্রকাশ অবস্থাতেও স্বপ্রকাশ!’ 

রবীন্দ্রনাথ কন্যার অসুস্থতা স্বত্ত্বেও বন্ধু-সন্তানের আসন্ন সন্তানের নামকরণ নিয়ে এক প্রস্থ আলোচনা নিশ্চয়ই করেছিলেন এর আগের কোনও চিঠিতে, আর অবলা দেবী যে সন্তান জন্মগ্রহণের আগে থেকেই তাকে শান্তিনিকেতনে পাঠাবার কথা মনে মনে ভেবে ফেলেছেন, এই চিঠির বক্তব্যে তা স্পষ্ট। আর ইতিমধ্যে বসু পরিবার থেকে এক সদস্য সেখানে ভর্তি হয়েও গিয়েছে। আনন্দমোহন বসুর ছোট ছেলে অরবিন্দমোহন বসু ১৯০৩ এর ৬ ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। 

যদিও রবীন্দ্রনাথ তখন বসু পরিবারের এই আনন্দে খুব বেশি আনন্দিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, কারণ তাঁর কন্যার অসুস্থতা। একদিকে বিদ্যালয় পরিচালনা করবার নানাবিধ সঙ্কট, অন্যদিকে সন্তানের অসুস্থতাজনিত দুশ্চিন্তা, দুইয়ে মিলে কবি একেবারে নাজেহাল। 

তবে শেষরক্ষা হল না; মে মাসের ১৫ তারিখে বসু দম্পতির সব আশা ধুলোয় মিশিয়ে অবলা দেবী এক মৃতা কন্যা সন্তান প্রসব করলেন। অসুস্থ অবলা দেবীর জীবন সঙ্কট দেখা দিলেও শেষ অব্দি তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। বসু দম্পতির সন্তানবিচ্ছেদের ব্যথা আঘাত করেছিল আর এক কাছের মানুষ ভগিনী নিবেদিতাকেও। মে মাসের ২০ম তারিখে তিনি মিস ম্যাকলাউডকে লেখেন, ‘— প্রিয় শিশুটি— কন্যা— গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত্রে হয়েছিল— মৃত অবস্থায়— জন্মাবার আধ ঘণ্টা আগেই বোধ হয় গতপ্রাণ। মায়ের জীবনই শুধু বাঁচানো গিয়েছিল, তাও কষ্টে। বেচারা— বেচারা— ছোট্ট জননী। হারিয়ে গেল কতখানি।’

জগদীশচন্দ্রের এই দুঃসহ আঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব আন্দাজ করতে পারলেও তাঁর এই সময়কালে লেখা কোনও চিঠি আজ অব্দি পাওয়া না যাওয়ায় তিনি ঠিক কী ভাষায় স্বান্তনা দিয়েছিলেন, তা আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। 

তাঁর জীবনেও আর এক আঘাত নেমে আসে ১৯০৩-এর সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে, কলকাতায় রেণুকা দেবীর মৃত্যু হয়। শেষ সময়ে কন্যা তাঁর বাবার কাছে উপনিষদের শ্লোক ‘পিতা নোহসি’ শুনতে চেয়েছিলেন। সেই মন্ত্রটি শুনবার পরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র: প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (পঞ্চম পর্ব) / অর্পণ পাল 

রেণুকার মৃত্যুর চার দিন পর রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে উপস্থিত হন। এরপরে তিনি যে ক’দিন কলকাতায় ছিলেন, মাঝেমধ্যেই আসতেন এই বাড়িতে (রবিজীবনী থেকে জানা যায়, ১৮, ২০, ২১ এই তিন দিন তিনি এসেছেন), বন্ধু-দম্পতির সান্নিধ্য তাঁর হৃদয়ের ক্ষতে কিঞ্চিৎ প্রলেপ দিতে পারত নিশ্চয়ই। 

সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন দীর্ঘ দিন পর। 

আর এর কিছু পরে, সম্ভবত অক্টোবরের গোড়ার দিকে অবলা দেবী কবিকে চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানান, তাঁদের সঙ্গে কিছুকাল সময় কাটিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁরা তখন ছিলেন দার্জিলিং-এ। অবলা দেবীর এই চিঠিটি না পাওয়া গেলেও এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, সেটা পাওয়া যায়। সেই চিঠিটি আমরা পুরোটা উদ্ধৃত করব, অবলা দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বহুবর্ণতার একটি বিশেষ বর্ণ এতে আলোকিত হয়ে উঠেছে বলেই। 

[তারিখবিহীন চিঠি]

মাননীয়াসু

বিদ্যালয় আজ খুলিয়াছে। আমার কাজ আরম্ভ হইল। এ কয়দিন ছুটির সময় কয়েকটি ছেলে ছিল— তাঁহাদিগকে অল্প অল্প পড়াইতেছিলাম— আজ এখানকার শূন্যতা অনেকটা পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে। এখন হইতে এই কাজের মধ্যেই আমার বিশ্রাম— এই কাজের মধ্যেই আমার শরীর মনের চিকিৎসা। কাজ হইতে দূরে গিয়া কি আমার মন শান্ত হইবে? আমার অবর্ত্তমানে বিদ্যালয়ের যে অংশ বিকল হইয়া গিয়াছিল— সেই সমস্ত অংশ আমাকে সংস্কার করিতে হইবে। অধ্যাপক ও ছাত্রদের অন্তরের মধ্যে ভস্ম হইতে আগুনকে জ্বালাইয়া তুলিতে হইবে— সমস্ত উজ্জ্বল ও সজীব করিতে হইবে। এই সকল কাজের কথা স্মরণ করিলে আমার দুর্ব্বলতা চলিয়া যায়। আমার কাজ অসম্পন্ন থাকিবে না— আমি রণে ভঙ্গ দিব না। 

   ইংরাজি শিক্ষার সুবিধার জন্য আমি সুবোধকে আবার দিল্লি হইতে টানিয়া আনিয়াছি। সুবোধ ইংরাজি ভাল পড়াইত। দিল্লিতে সে হেড্‌মাষ্টার হইয়া আমাকে বড় বিপদে ফেলিয়াছিল। আমি তাহাকে জবরদস্তি করিয়া এখানে ফিরাইয়াছি। অরবিন্দ সম্বন্ধে এখন হইতে আপনি আর কিছুই ভাবিবেন না। 

   আপনি কেন আমাকে লোভ দেখাইতেছেন! দার্জ্জিলিঙে আপনার ওখানে যাইতে পারিলে আমি আর কিছু চাহিতাম না। কিন্তু বালককালে ইস্কুল পালাইয়াছি এ বয়সে আর চলে না। আমার অনেক লেখাপড়ার কাজ মুল্‌তবি আছে— আপনার আশ্রয়ে যদি যাইতে পারিতাম তবে অধ্যাপক একদিকে আর এই সম্পাদক আর একদিকে নিঃশব্দে আপন আপন কাজে লাগিয়া থাকিতাম— ক্ষুধার সময় আপনার কাছে গিয়া পড়িতাম— কিন্তু নিরামিষ, তাহা বলিতেছি— আর কই মাছ নয়— দ্বিপদ চতুষ্পদে ত কথাই নাই। কলিকাতার চেয়ে শরীরটা অল্প একটু সারিয়াছে। যদি ছুটি লওয়া সঙ্গত ও আবশ্যক বোধ করি তবে অগ্রহায়ণের পূর্ব্বে নড়িব না। আমার বোটে কি আপনাদের টানিতে পারিব না? আমাকে নিঃসহায় পদ্মায় বিসর্জ্জন দিবেন? আমাকে যদি এমন করিয়া অবহেলা করেন তবে একলা এই শরীরটাকে লইয়া কি করিব?

আপনাদের 

                                        শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিঙে না গেলেও মাস দুয়েক পরে বড়দিনের ছুটিতে অবলা দেবী স্বামীকে নিয়ে শিলাইদহে এসে কবির আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও পরোক্ষ ইঙ্গিত মেলে রবীন্দ্রনাথকে লেখা অবলা দেবীর ১৯০৮-এর ২০ মার্চ লেখা চিঠিতে—

‘সেবার বড়দিনের ছুটির সময় অশান্তিপূর্ণ চঞ্চল হৃদয় লইয়া শিলাইদহে গিয়াছিলাম, আপনার সঙ্গে দুটি কথা বলিয়াই নবজীবন লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়াছিলাম। সে কথা আমি কোনদিন ভুলিতে পারিব না।’

শোকতপ্ত কবি আর বিজ্ঞানীজায়া এর পরে আরও একবার কাছাকাছি আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন এর পরের বছরেই, আর সেই নৈকট্য অন্য একজন কাছের মানুষের নজরে পড়ে যায়। তবে সে প্রসঙ্গ, পরের পর্বে। 

(ক্রমশ)

.............................................................................................................................................

[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

#জগদীশচন্দ্র বসু #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #অবলা বসু #রেণুকা দেবী #Jagadish chandra Bose #Rabindranath Thakur #Lady Abala Basu #Series #অর্পণ পাল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219125