সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (সপ্তম পর্ব)
................................
অবলা বসু ও রবীন্দ্রনাথ (৩)
.................................
১৯০৪-এর অক্টোবরে ভগিনী নিবেদিতা, রথীন্দ্রনাথ-সহ রবীন্দ্রনাথ, সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র, যদুনাথ সরকার, স্টেটস্ম্যান পত্রিকার সম্পাদক এস কে র্যাডক্লিফ, সিস্টার ক্রিস্টিন প্রমুখ বেশ বড় একটি দল বুদ্ধগয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই ভ্রমণের বিস্তারিত বৃত্তান্ত আপাতত দেওয়ার সুযোগ নেই, তবে এই ‘বুদ্ধগয়া ভ্রমণ সময়কালে রবীন্দ্রনাথ-অবলাকে অনেকটাই ঘনিষ্ঠ করে তোলে’— জানিয়েছিলেন দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত [রবীন্দ্রনাথের আর এক বৌঠান। ৩০ পৃ]।
এই সফরের দেড় মাস পরেই আরও একবার শিলাইদহে গিয়েছিলেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র, আর ওই সফরে দিন কয়েক বাদে যোগ দিয়েছিলেন নিবেদিতাও। সিস্টার ক্রিস্টিনকে নিয়ে। বর্ষশেষ উদযাপন করে ১৯০৫-এর ২ জানুয়ারি সবাই একসঙ্গে ফিরে আসেন কলকাতায়। নিবেদিতার কাছে এই সফর কিছুটা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল; তিনি কবির সঙ্গে জগদীশ-অবলার ঘনিষ্ঠতা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মেনে নিতে পারেননি। যার প্রমাণ, কলকাতায় ফিরে ৫ জানুয়ারি মিসেস বুলকে লেখা তাঁর চিঠির কয়েক ছত্রে। সেখানে নিবেদিতা স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আর অবলা বসুর মধ্যে মেলামেশা থেকে একটু যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন বিজ্ঞানীপ্রবর, আর সেটা নিবেদিতার কাছেও লেগেছিল অসহ্য।
রবীন্দ্রনাথ আর অবলা দেবীর মধ্যে ১৯০৬/৭/৮ সালের দিকে মোট যে আটটি চিঠির আদানপ্রদানের ইতিবৃত্ত আমরা পাই, সেখানে ফুটে ওঠে তাঁদের অন্তরঙ্গতারই নানাবর্ণ চিত্র। কখনও কবিকে নিজের মহিলা-বিদ্যালয় স্থাপনা সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা ব্যাখ্যা করেন অবলা; কখনও লন্ডনে তিনি ব্রাহ্মসমাজের একটি শাখা খুলতে চান, সে ব্যাপারে পরামর্শ করেন কবির সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথও তাঁর চিঠিতে তুলে আনেন নানা প্রসঙ্গ, তাঁর শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খুঁটিনাটি থেকে পারিবারিক খবরাখবর।
আর ওই চিঠিগুচ্ছেই পাই এমন একজনের খবর, যাঁকে কেন্দ্র করে এই ১৯০৮ সাল থেকেই কবি আর অবলা দেবীর মধ্যে গড়ে উঠবে পারস্পরিক মনোমালিন্যের দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর। যা হয়তো সবসময় প্রকট নয়, তবু অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বাকি জীবন তাঁদের আন্তরিকতা আর হৃদ্যতার মধ্যে বাধা হয়ে তা থেকেই যাবে।
ইনি জগদীশচন্দ্রের এক ভাগ্নে অরবিন্দমোহন বসু। আনন্দমোহন ও স্বর্ণপ্রভা বসুর পুত্র। ১৮৯২ সালে জন্ম তাঁর, আর প্রয়াণ ১৯৭৭ সালে। ১৯০২ সালের দিকে তাঁকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করা হয়, প্রথম দিকে তিনি এই পরিবেশে মানিয়ে চলতে একটু অসুবিধায় পড়তেন। তবু তাঁকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ দিয়ে আগলে রাখবার চেষ্টা করতেন রবীন্দ্রনাথ। যেমনটা করতেন আশ্রমের অন্য বালকদের জন্যেও। আস্তে আস্তে অরবিন্দমোহনের মনও আশ্রম জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে শুরু করে।
১৯০৪ সালের মার্চ মাসে একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অরবিন্দমোহন। সেইসময় তাঁকে আন্তরিকভাবে সেবা শুশ্রূষা করেছিলেন বসু পরিবারের আত্মজন নিবেদিতা। পরে তিনি সেরে উঠলেও তাঁর শরীরে স্থায়ীভাবে এক দুর্বলভাব রয়েই গিয়েছিল। যে জন্য শান্তিনিকেতনে তাঁর থাকবার সময় নিয়মিত চিঠিতে তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা রবীন্দ্রনাথ জানাতেন অবলা দেবীকে।
১৯০৮ সালে বাইরের দিক থেকে অন্তত কবির সঙ্গে তিক্ত এক সম্পর্কের সূত্রপাত হল অবলার। সৌজন্যে লন্ডন থেকে ভাগ্নে অরবিন্দমোহনকে লেখা তাঁর এক চিঠি। যা অরবিন্দমোহন নিতান্ত অবিমৃশ্যকারিতার বশে পাঠিয়ে দেন তাঁর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ চিঠিটি পড়ে খুবই মর্মাহত হন। বয়কট আন্দোলন নিয়ে তাঁর ধারণাকে সেই চিঠিতে কিঞ্চিৎ রুঢ় ভাষাতেই আক্রমণ করেছিলেন অবলা। যা আঘাত দিয়েছিল কবিকে। তিনি অরবিন্দমোহনকে পাল্টা চিঠি লেখেন এই সংবাদ পেয়ে। সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে বেদনা।
‘তোমার মামীর চিঠি পড়ে দেখলুম। তিনি আমার সম্বন্ধে এতটা বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে আমার মত কি তা ভাল করে পড়েও দেখেননি। আমি কোনো প্রবন্ধে কোনো জায়গাতেই বলিনি যে “বয়কট” বন্ধ করা উচিত। আমি কোথাও আভাসমাত্রেও বলিনি যে ভারতবর্ষে সব জাতিকেই ঠিক একই ধর্ম্ম গ্রহণ করতে হবে— পৌত্তলিকতার দোষগুণ সম্বন্ধে আমি কোনো কথা এ পর্য্যন্ত উত্থাপন করিনি। আমি কেবলমাত্র এই কথাটুকু বলেছি যে বয়কটই করি আর যাই করি অন্যায় অসত্য অধর্ম্মকে অবলম্বন করে চল্লে কিছুতেই আমাদের শ্রেয় হবে না...’
দীর্ঘ এই চিঠির শেষের দিকে আছে এমন কথা— ‘তোমার মামী যে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছেন সেটা কেবল বর্ত্তমান সময়ের উত্তেজনাবশত। এই জন্যই আমার উপরে অনেকেই বিরক্ত হয়েছেন। এ সমস্তই আমাকে গ্রহণ করতে হবে। আমি ঈশ্বরের কাছে বারংবার প্রার্থনা করেছি তাঁকে যেন আমি আমার সমস্ত সমর্পণ করতে পারি তাহলেই আমার সমস্ত বোঝা হাল্কা হয়ে যাবে— আমার খ্যাতি যদি তিনি কেড়ে নেন আমি যদি বন্ধু ও অন্য সকলের দ্বারা অবজ্ঞার সহিত তিরস্কৃত হতে পারি তাহলে আমার মঙ্গলই হবে...’।
বোঝাই যায় রবীন্দ্রনাথ এই সময় কতটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবলা বসুর সঙ্গে তাঁর এই মনোজগতের বিরোধ এরপরেও গড়িয়েছিল আরও কিছু দূর, যদিও সেসব সত্ত্বেও বন্ধুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অন্তত বাহ্যিক দিক থেকে বিচ্ছেদের সম্ভাবনাচিহ্ন দেখা যায়নি কখনও।
১৯০৯ সালের জুলাই মাসে সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। দীর্ঘ প্রায় দু’বছর পর আবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল রবীন্দ্রনাথের; দেশে ফেরবার দিন কয়েক বাদেই পদ্মাবক্ষে কবির আতিথ্য গ্রহণ করলেন জগদীশচন্দ্র।
তবে এর বছর দুয়েক বাদে অরবিন্দমোহন বসুকে নিয়ে আবার একবার রবীন্দ্রনাথ আর অবলা দেবীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটল, যার পরিচয় পাওয়া যাবে অবলা বসুর লেখা ১৯১১ সালের ১১ এপ্রিল আর রবীন্দ্রনাথের লেখা ১৩ এপ্রিলের চিঠিতে। প্রথমটিতে অবলা বসু এমন কিছু কথা লিখেছিলেন যা কবিকে উত্তেজিত করে তোলে, যেমন ‘আপনি যে আমাদের বোলপুরে চান না সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই’ বা অরবিন্দমোহন সম্বন্ধে ‘তাহাকে সর্ব্বদা আমাদের নিকটই রাখিব কদাচিৎ দূরে যাইতে দিব স্থির করিয়াছি।’ বা ‘বাড়ি হইতে দূরে রাখাই আমাদের অন্যায় হইয়াছে মনে হয়’। শান্তিনিকেতনে অরবিন্দমোহনকে পাঠাবার জন্য আক্ষেপ করছেন অবলা, এমনটা জেনে কবির মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমান করা চলে। আর ওই চিঠিরই শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন এমন কিছু কথা— ‘এবারে আপনাকে বোলপুরে আসবার কথা বলি নি— তার কারণ, কিছুদিন থেকে আমি অনুভব করছিলুম এই বিদ্যালয়ের প্রতি আপনার হৃদয় অনুকূল নেই। অথচ এই বিদ্যালয়টি আমার জীবনের সাধনার ক্ষেত্র— আমার দেবতা এইখানে, আমার মুক্তি এইখানে— এ সামান্য ইস্কুলমাত্র নয়— এখানে আপনি মনে লেশমাত্র বিমুখতা নিয়ে আস্বেন, এখানে এসে কেবলমাত্র কৌতূহল চরিতার্থ করে যাবেন এ আমার পক্ষে অসহ্য। ... যে জায়গায় আমি সকলের চেয়ে সার্থকতা লাভ করেছি সে জায়গায় আপনাদের যদি কোনো বিরোধ থাকে তবে সেখানে খেলাচ্ছলেও আমাদের মিলন হতে পারে না— আর সব জায়গাই রইল— কলকাতা আছে, আমাদের পদ্মার চর আছে, যে যেখানেই বলেন সেখানেই কোনো বাধা নেই।’
আরও পড়ুন : সমকাল ও জগদীশচন্দ্র : প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (ষষ্ঠ পর্ব) / অর্পণ পাল
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এরপরেও চিঠিপত্রে বা সাক্ষাতে অবলা দেবীর কথা হয়েছে বিলক্ষণ, কিন্তু বোঝাই যায় তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের সেই আঠা স্বাভাবিক নিয়মেই ছিল না আর।
[অবলা দেবীর ওই চিঠিটি সম্পূর্ণ আকারে পাওয়া যাবে না ‘রবিজীবনী’ বা ‘চিঠিপত্র’-র খণ্ডে। কিঞ্চিৎ বিতর্কমূলক কিছু পংক্তি চিঠিটি থেকে সরিয়ে তা খণ্ডিত আকারে ছাপা হয়েছিল বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকে প্রকাশিত ‘পত্রাবলী’-তে। দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ চিঠিটি উদ্ধার করে প্রকাশ করেছেন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের আর এক বৌঠান’ বইয়ে।]
#জগদীশচন্দ্র বসু #রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর #অবলা বসু #Jagadish chandra Bose #Rabindranath Thakur #Lady Abala Basu #Series #অরবিন্দমোহন বসু #রবিজীবনী #আনন্দমোহন বসু #ভগিনী নিবেদিতা #দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত #অর্পণ পাল #সিলি পয়েন্ট