পোয়ারো থেকে ফেলুদা—ছাঁচবদলের সত্যজিৎ
.................................
ডিটেক্ট it : পর্ব ১১
.............................
“টিভি-তে শার্লক হোম্স দেখে ফেলুদা মুগ্ধ। বলল, ‘একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে হোম্স আর ওয়াটসন। জানিস তোপসে—আমাদের যা শিক্ষাদীক্ষা ওই শার্লক হোম্সের কাছে। সব প্রাইভেট ডিটেকটিভের গুরু হচ্ছে হোম্স। তাঁর সৃষ্টিকর্তা কন্যান ডয়েলের জবাব নেই।’” (অপ্সরা থিয়েটারের মামলা)
ফেলুদা সিরিজের একাধিক জায়গায় এমনিভাবেই ফেলুকে দিয়ে অকপট গুরুদক্ষিণার স্বীকারোক্তি করিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য শুরু থেকেই (সে দেবেন্দ্রবিজয়-অরিন্দমই হোক কিংবা ব্যোমকেশ) হোমসের প্রতি এই ঋণ কোনও না কোনও ভাবে স্বীকার করে এসেছে, ফেলুদাও তার ব্যতিক্রম নয় একেবারেই। কিন্তু হোমসের পরেই পৃথিবীর দ্বিতীয় বিখ্যাততম গোয়েন্দা যিনি, সেই সম্পূর্ণ অ-গোয়েন্দাসুলভ অদ্ভুতদর্শন বেলজিয়ান উদ্বাস্তু এরকুল পোয়ারোকে ফেলুদা ঠিক কোন চোখে দেখত তা জানা যায় না। বাংলার গোয়েন্দাসাহিত্য হোমসকে যে দেবতার আসনে ঠাঁই দিয়েছে, পোয়ারোকে তা দেয়নি। কিন্তু রহস্যের রানি, ‘ডাচেস অফ ডেথ’ আগাথা ক্রিস্টির আওতা থেকে একেবারে বেরিয়ে আসাও সম্ভব ছিল না। সত্যজিৎ নিজে ছিলেন ইংরেজি রহস্যকাহিনির একনিষ্ঠ পাঠক এবং ক্রিস্টি ছিলেন তাঁর ও বিজয়া রায়ের অন্যতম প্রিয় লেখিকা। ‘আগন্তুক’ ছবিতে অনিলার (মমতাশঙ্কর) মনে উইল-সংক্রান্ত এক রহস্য ঘনীভূত হওয়ার মুহূর্তে অনুঘটক হিসেবে তার হাতে সত্যজিৎ ধরিয়ে দিয়েছিলেন পোয়ারোর ‘পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস’ বইটি। কাজেই ফেলুদা যতই হোমসকে গুরুর পদে বরণ করে নিক, সিরিজের আনাচেকানাচে হয়তো সত্যজিৎ না চাইতেও ছাপ ফেলেছেন পোয়ারো, আর একটু চেষ্টা করলেই চিনে নেওয়া যায় ক্রিস্টির ছায়া।
চেহারার দিক থেকে ফেলুদার সঙ্গে পোয়ারোর আদৌ মিল নেই, বরং ছ ফুট দু ইঞ্চির প্রদোষ মিত্তির শার্লক হোমসকে ছুঁতে চান। হোমসের মতোই শারীরিকভাবে সক্ষম, দৌড়ঝাঁপ আর অ্যাডভেঞ্চারে অভ্যস্ত ও নানা গুণের অধিকারী ফেলুদা কিন্তু অন্তত একটি গুণে পোয়ারোর কিছুটা কাছাকাছি যায়। সে হল তার খুঁতখুঁতেমি, যদিও পোয়ারোর মতো পান-থেকে-চুন-খসা বাতিকের পর্যায়ে কখনোই পৌঁছয় না সেটা। ফেলুদা চায়ের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে, আর পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে অসম্ভব ফিটফাট সবসময়। “ফেলুচাঁদ সারাক্ষণ বড় বেশি ফিটফাট, বড্ড (একেবারে শতকরা ১০০ ভাগ) সচেতন লোক” বলে লীলা মজুমদারের চোখেও ব্যাপারটা একটু অবাস্তব ঠেকেছিল (‘ফেলুচাঁদ’, সন্দেশ, অগ্রহায়ণ ১৪০২)। জাঁদরেল গোঁফ, পেটেন্ট লেদারের জুতো, ছড়ি, পকেটঘড়িতে পোয়ারোকে যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছেন ক্রিস্টি, তেমন সত্যজিৎ ফেলুদাকে বাঁধেননি। সে অনেকটাই ঘরোয়া, পাজামা-পাঞ্জাবি থেকে কোট-প্যান্ট সবেতেই সমান স্বচ্ছন্দ, পোয়ারোর মতো আরাম বিসর্জন দিয়েও ফিটফাট থাকার বান্দা সে নয়। পোয়ারোর এই পিটপিটানি স্বভাব, যাঁকে অনেক গবেষক এবং পোয়ারোর চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হওয়া ডেভিড সুশে নির্দ্বিধায় ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার’ বলে চিহ্নিত করেছেন, তার পিছনে রয়েছে সিমেট্রি বা ভারসাম্য তথা প্রতিসাম্যের প্রতি অদম্য আনুগত্য। তাঁর মতে অপরাধ সমাজের ভারসাম্য টলিয়ে দেয়, তাই গোয়েন্দার কাজ শুধু অপরাধের মীমাংসা করা নয়, সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। যেহেতু অপরাধ স্বাভাবিক সাম্যের নকশা ভেঙে ফ্যালে, তাই অপরাধকে ধরে ফেলা খুব শক্ত নয়। ফেলুদাও যে কতকটা এই মতেই বিশ্বাস করে তা বুঝতে পারি যখন তাকে বলতে শুনি, “জিওমেট্রির বই বলে আলাদা কিছু নেই। যে কোনও বইই জিওমেট্রির বই হতে পারে, কারণ সমস্ত জীবনটাই জিওমেট্রি” (সোনার কেল্লা) আর “মাকড়সার জাল…জিওমেট্রি…। এখন অন্ধকার… দেখা যাচ্ছে না… রোদ উঠলে জালে আলো পড়বে— চিক্ চিক্ করবে… তখন ধরা পড়বে জালের নকশা!...এখন শুধু আলোর অপেক্ষা…” (ঐ)। আর যে ব্যাপারে পোয়ারোর সঙ্গে ফেলুদার অদ্ভুত মিল, তা হল দুজনেই সুখাদ্যের রসিক। পেটুক বা ভোজনবিলাসী দুজনের কেউই না। কিন্তু ফেলুদা শরীরচর্চার পাশাপাশি মিহিদানা কিংবা নলেন গুড়ের সন্দেশ নির্দ্বিধায় পেটে চালান করতে পারে। যদিও সপ্তাহে একদিন করে সবান্ধব রেস্তোরাঁয় খেতে যায়, তবুও ভাত-সোনামুগের ডাল-পাঁপড়-দই-খিচুড়ি-ডিমভাজার মতো আটপৌরে বাঙালি খানা তার বেশি পছন্দ। ওদিকে পোয়ারোকে দেখি ব্রেকফাস্টে চকোলেটের গ্লাসে চুমুক দিতে আর ব্ল্যাককারেন্ট ‘সিরপ’ (sirop) আর ছোট ছোট প্যাস্ট্রি দিয়ে অতিথিসৎকার করতে। পোয়ারোর এই খাদ্যাভ্যাস ‘ইংরেজসুলভ’ তো একেবারেই নয়, বরং ঘোরতর ‘কন্টিনেন্টাল’ এবং গড়পড়তা ইংরেজ পুরুষালি খাদ্যাভ্যাসের বিপ্রতীপে অনেকটাই ‘ফেমিনিন’। এবং পোয়ারো খাওয়াকে শুধু দৈহিক আনন্দের বস্তু মনে করেন না, খাদ্যাভ্যাস তাঁর কাছে “ইন্টেলেকচুয়াল রিসার্চ”-ও বটে (ডেথ ইন দ্য ক্লাউডস)।
বাস্তব তথ্যমূলক মিল দেখিয়ে ফেলুদাকে পোয়ারোর পরমাত্মীয় প্রমাণ করা যায় না আর যাবেও না, কারণ সত্যজিৎ পোয়ারোর ছায়ায় ফেলুদাকে আঁকেননি, ঠিক যেমনটা হোমসের ছায়াতেও আঁকেননি। কিন্তু একটা জায়গায় পোয়ারোর স্রষ্টা ক্রিস্টি এবং ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ ভীষণভাবে এক— যে কথায় উপনীত হওয়ার জন্যই এই মিলগুলোর উল্লেখ করা। সত্যজিৎ ও ক্রিস্টি দুজনেই ফেলুদা আর পোয়ারোর মধ্যে তাঁদের নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটিয়ে রক্তমাংসের একটা অবয়ব দিয়েছেন, আর সেই চারিত্রিক অবয়ব কেবল ঘোর স্বতন্ত্র বা ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিকই নয়, অনস্বীকার্যভাবে রীতিমতো শহুরে। ‘শহুরে’ বা ‘আর্বান’ বলতে কেবল শহরে বসবাস করা গোয়েন্দাকে নির্দেশ করছে না, করছে একটা বিশেষ রুচিশীল উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। হোমসের ক্ষেত্রে এই ‘আর্বানিটি’-র প্রশ্নটা প্রায় ওঠেই না। হোমসের গল্প-উপন্যাসে ১৮৯০-পরবর্তী লন্ডনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি আঁকা হলেও হোমস সেই সমাজের কোন শ্রেণিতে পড়েন, তা একটা বিরাট ধাঁধার বিষয়। তিনি সাধারণ মানুষের এতটাই ঊর্ধ্বে থাকা দেবপ্রতিম ব্যক্তিত্ব যে তাঁকে একরকম সমাজবহির্ভূত বললে নেহাত অত্যুক্তি হয় না। তাই তাঁর মন্দিরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আর বোহেমিয়ার রাজার মতোই ঢুকে শরণ নিতে পারেন নিতান্ত নগণ্য মহিলা টাইপিস্ট কিংবা সাধারণ পুলিশ কনস্টেবল। পোয়ারোকেও হোমসের মতোই এই সাধারণ্যের ঢের উপরে থাকা গোয়েন্দার ছাঁচে ঢালতে চেয়েছিলেন ক্রিস্টি, তাই ওই অদ্ভুত চেহারা আর আচার-ব্যবহার। কিন্তু কালে-কালে ক্রমে-ক্রমে পোয়ারো সেই ১৯২০-’৩০-পরবর্তী লন্ডনের উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজেরই একজন হয়ে উঠেছেন, যে সমাজে বিচরণ ছিল ক্রিস্টির নিজের। পোয়ারো থাকেন আলিশান হোয়াইটহ্যাভেন ম্যানশন্সে, তাঁর জীবনযাত্রায় আর্থিক সমৃদ্ধি ও সুরুচির ছাপ স্পষ্ট, তাঁর মক্কেলের অধিকাংশই একই উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজবৃত্তের বাসিন্দা, তিনি বেড়াতে যান দেশ-বিদেশে, আমন্ত্রিত হন বড়লোক বন্ধুবান্ধবের দেওয়া পার্টি বা ডিনারে। অর্থাৎ অতিমানবিক গোয়েন্দার ছাঁচে ঢেলেও ক্রিস্টি পোয়ারোকে একটা সামাজিক অবস্থান দিলেন, যা তাঁর সমসাময়িক এবং যে অবস্থান ও তাতে ঘোরাফেরা করা মানুষগুলির সঙ্গে তিনি পরিচিত। ক্রিস্টির অন্য গোয়েন্দা মিস মার্পলের তো আরও বেশি করে সামাজিক উপস্থিতি ও পরিচিতি আছে, যদিও তাঁর অবস্থান লন্ডন থেকে ঢের দূরে সেন্ট মেরি মিড গ্রামে— ইংল্যান্ডের ‘কান্ট্রি’-র সমাজ। সত্যজিৎ যখন ফেলুদা লিখছেন, তখন ফেলুদাকেও ঠিক এইরকমই একটা সামাজিক অবস্থান নির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন। ফেলুদার পাঠক সন্দেশের গ্রাহক ১৯৬০-’৭০-’৮০-এর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সন্তান কিশোর-কিশোরীরা। ফেলুদা তাই তাদের পাশের বাড়ির দাদার ইমেজ পেল। যদিও তার মধ্যে ভুলত্রুটি চোখে পড়েই না বলতে গেলে, কিন্তু তাও সে হোমস-পোয়ারোর মতো অতিমানবিক নয়। সে শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতিভূ। তরুণের উৎসাহে শ্যামবাজার থেকে বালিগঞ্জ পায়ে হেঁটে আসার দুরূহ অ্যাডভেঞ্চার করার খেয়াল চাপে তার মাথায়, সে তোপসেকে জানলার বাইরে থুতু ফেললে গাঁট্টা মারার ভয় দেখায়। কিন্তু তার মক্কেলদের মধ্যে সুধীর ধর আর জয়চাঁদ বড়াল বাদে বাকি সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ধনী, প্রতিষ্ঠিত, বনেদি বংশের সন্তান, দুষ্প্রাপ্য বস্তুর সংগ্রাহক বা অদ্ভুত হবিওয়ালা লোক। সকলেই প্রায় ফরসা ও লম্বাচওড়া চেহারার মানুষ। এবং ফেলুদা অর্থকৌলীন্যে বা বংশকৌলীন্যে এঁদের সমকক্ষ না হলেও সত্যজিৎ দেখিয়েছেন যে সে অনায়াসে এদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। ক্রিস্টির ছায়া এখানে দিব্যি স্পষ্ট। এমনকি ফেলুদার ভিলেনরাও অনেকেই আর্টের সমঝদার, জ্ঞানী, ধনী, বনেদি বড়লোক (বনবিহারী সরকার, মহাদেব চৌধুরী)—এবং সর্বোপরি বাঙালি ভদ্রলোক (মগনলাল মেঘরাজ ফেলুদার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শত্রু হয়ে ওঠার অন্যতম বড় কারণ বোধহয় এই যে, মগনলাল সেই বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে)। সত্যজিৎ নিজে যে বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করতেন তার ছায়াই পড়েছে ফেলুদার পরিমণ্ডল তৈরি করার সময়। তাঁর জীবন তাঁকে বহু শ্রেণির বহু ধরনের লোকের সংস্পর্শে এনেছিল, তাঁর চলচ্চিত্রে যার বাস্তবিক ও যথোপযুক্ত প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু ফেলুদার গল্পে তিনি যে সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণিকে একটু হলেও প্রাধান্য দিয়েছেন তার একটা কারণ মনে হয় তাঁর নিজের সমৃদ্ধ, বনেদি বংশকৌলীন্য ও বেড়ে ওঠা। আর একটা কারণ অবশ্যই আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দাগল্পের প্রভাব।
ক্রিস্টি-কাহিনির অনেকগুলো চেনা ছকের মধ্যে কয়েকটা হল— এক ছোট জায়গায় অপরাধ (প্রধানত খুন) সংঘটিত হবে। এই জায়গা কোনও ভ্রমণস্থান (দ্য ক্যারিবিয়ান মিস্ট্রি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ ডেথ), হোটেল (অ্যাট বার্ট্রাম’স হোটেল), বাড়ি (দ্য হলো, ডেড ম্যান’স মিরর) বা স্কুল (ক্যাট অ্যামং দ্য পিজন্স) হতে পারে, লঞ্চ (ডেথ অন দ্য নাইল) বা রেলগাড়ি (মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস) হতে পারে, বা নিছক কাহিনির মধ্যে স্বতন্ত্র জায়গা করে নেওয়া একটা ‘এনক্লোজড স্পেস’ (ফাইভ লিটল পিগস) হতে পারে। সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকবে ওই জায়গায় থাকা প্রত্যেকে, বিশেষত মৃতের একদম কাছের লোকজন (মিসেস ম্যাকগিন্টি ইজ ডেড, মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড)। একাধিক লোকের একাধিক মোটিভ থাকবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে একটার সঙ্গে আর একটা মোটিভ জড়িয়ে যায় ও অনেক ক্ষেত্রে অপরাধও একাধিক এবং জটিলতর। চরিত্র বা ঘটনাগুলির মধ্যে পাঠকের দৃষ্টিকে ভুল পথে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাত-গুরুত্বপূর্ণ ‘রেড হেরিং’-এর অবতারণা করা হবে (দি এবিসি মার্ডার)। এই ‘ট্রোপ’-গুলি আজ বিশ্বের গোয়েন্দাসাহিত্যের রীতিরেওয়াজে পরিণত হয়েছে অনেকটাই ক্রিস্টির সৌজন্যে। ১৯৬৫ থেকে ফেলুদার গল্প যত এগিয়েছে তত এই ছায়া কিন্তু গাঢ় হয়েছে সিরিজের উপর। সিরিজের মাঝামাঝি ছিন্নমস্তার অভিশাপ-কে তো এই বাবদে ক্লাসিকাল ক্রিস্টি ঘরানার গল্প বলা চলে। শেষের দিকের দার্জিলিং জমজমাট, ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর, ডাঃ মুনসীর ডায়রি কিংবা বোসপুকুরে খুনখারাপি-তে ক্রিস্টি ঘরানার ছাপ সুস্পষ্ট। এগুলিতে খুন, প্রতিশোধ আর অর্থলিপ্সা মিলে গিয়ে একাধিক অপরাধ ও অপরাধীর সৃষ্টি করেছে। নেপোলিয়নের চিঠি-তে তোতা চুরি, চিঠি চুরি আর পার্বতীচরণ হালদারের খুনের রহস্য জড়িয়ে-পাকিয়ে এক হয়ে গেছে। কৈলাসে কেলেঙ্কারি-র জয়ন্ত মল্লিকের মতো রেড হেরিং বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে দুষ্প্রাপ্য।
এই ‘এনক্লোজড স্পেস’-এ একদল মানুষ থাকলে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন গল্পে উঠে আসা স্বাভাবিক এবং আগাথা ক্রিস্টির ক্ষেত্রে তা এসেছেও। যৌন ঈর্ষা, অবৈধ সম্পর্ক, পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ওঠানামা এবং আরও হাজারো সম্পর্কের জটিলতা অভাবনীয় সব সমস্যা তৈরি করেছে মিস মার্পল আর পোয়ারো সিরিজে এবং ক্রিস্টির অন্যান্য থ্রিলারগুলিতে, সেগুলিকে করে তুলেছে অত্যন্ত প্রাপ্তমনস্ক। মানুষের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েন সত্যজিতের বরাবরের আগ্রহের জায়গা ছিল, তাঁর সিনেমায় আমরা বহুবার সে পরিচয় পেয়েছি। সে আগ্রহ এতটাই জোরালো ছিল যে তাঁর প্রথম মৌলিক গল্পভিত্তিক ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-তেও আমরা ঠিক এই ছাঁচই দেখতে পাই— দার্জিলিংয়ের ‘এনক্লোজড স্পেস’-এ এক খাস কলকাত্তাইয়া বনেদি পরিবারের লোকগুলি নিজেদের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সম্পর্কগুলি প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে। সত্যজিতের শেষজীবনে তৈরি নিজের গল্পভিত্তিক ‘শাখাপ্রশাখা’-ও মূলগতভাবে একই ছবি দেখায়— একটি বাড়িতে জমায়েত হওয়া চার পুত্র, তাদের পরিবার ও বৃদ্ধ পিতার সংসারের বহুমুখী সমস্যা, যা তাদের ভিতরের ভেঙে পড়তে থাকা মুখগুলিকে তুলে ধরে। এই ছবিগুলির কাহিনি এক-একটি অমূল্য মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্যাত্রার কথা বলে, ঠিক যেমনটি বলে আগাথা ক্রিস্টির রহস্যকাহিনিগুলি। নিছক গোয়েন্দাগল্পের গণ্ডি ছাড়িয়ে সেগুলি এক-একটি সামাজিক দলিল, মনস্তাত্ত্বিক টেক্সটে পরিণত হয়। সত্যজিৎ যেহেতু ফেলুদা লিখছিলেন ছোটদের জন্য, তাই এই সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে কাহিনিতে প্রশ্রয় দেওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। তাও তিনি ডাঃ মুনসীর ডায়রি-তে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওই গল্পেই, দার্জিলিং জমজমাট এবং ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর-এ ফিরে ফিরে এসেছে পুত্রের পিতার অন্যায় মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা। আর পিতা-পুত্রের (অথবা পুত্রস্থানীয় কেউ) বা ভাই-ভাইয়ের সম্পর্কের দোলাচল তো ফেলুদা কাহিনিতে পুনরাবৃত্ত হওয়া অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (ছিন্নমস্তার অভিশাপ, বোসপুকুরে খুনখারাপি, ইন্দ্রজাল রহস্য, গোলকধাম রহস্য)। ফেলুদাকে তাই বলতে শুনি, “দাবার শেষ দিকে যখন দুপক্ষের পাঁচটি কি সাতটি ঘুঁটি বোর্ডের এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন অনড় অবস্থাতেই তাদের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ চলতে থাকে। যারা খেলছে তারা তাদের প্রত্যেকটি স্নায়ু দিয়ে ব্যাপারটা অনুভব করে। এই চৌধুরী পরিবারটিকে দেখে আমার দাবার ঘুঁটির কথা মনে হচ্ছে, যদিও কে সাদা কে কালো, কে রাজা কে মন্ত্রী, তা এখনও বুঝিনি।” (ছিন্নমস্তার অভিশাপ)
ফেলুদা এই সমস্ত রহস্যের সমাধান করার পথে যার উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে তা হল— না, ধরাছোঁয়া যায় এমন ক্লু নয়— জেরা, জবানবন্দি, কথোপকথন। তার মধ্যে থেকেই সে খুঁজে পায় সমাধানসূত্র (অপ্সরা থিয়েটারের মামলা)। এখানেও ফেলুদার সঙ্গে পোয়ারোর আশ্চর্য মিল— তাঁরও পছন্দ অন্তহীন কথাবার্তার পর সন্দেহভাজনদের মনোগহনে হারিয়ে যাওয়া। আর আশ্চর্য মিল দুজনের রহস্য-উদ্ঘাটনের নাটকীয়তায়। দুজনেই মামলার শেষ অঙ্কে ‘এনক্লোজড স্পেস’-এ উপস্থিত সকলকে ডেকে মিটিং করে পেঁয়াজের খোলা ছাড়ানোর মতো করে রহস্য উদ্ঘাটন করেন ও অপরাধীকে ধরিয়ে দেন। অবশ্য হোমসের মন্ত্রশিষ্য ফেলুদাকে এই পর্বের আগে কিছুটা হাত-পা ছুড়তে হয় অবশ্য কখনও কখনও। পোয়ারো ঘোষিতভাবেই পছন্দ করেন নাটকীয়তা, আর রহস্য সমাধানের শেষ পর্বে ফেলুদার গলা লালমোহনবাবুকে মনে পড়িয়ে দেয় তিব্বতি শিঙার আওয়াজ। তিব্বতি আচার-অনুষ্ঠানের ‘রিচুয়াল’ নাচের নাটকীয়তা সত্যজিৎকে যে রীতিমতো উত্তেজিত করেছিল তা বোঝাই যায় গ্যাংটকে গণ্ডগোল-এ লামানৃত্যের দৃশ্য নিয়ে আসায়।
আরও পড়ুন : পারিজাত বক্সী—পাল্প ও মূলধারার দ্বন্দ্ব / সুকল্যাণী সেনগুপ্ত
তবে ফেলুদা বাদ দিয়ে যে আর-একটি চরিত্রের উপরে ক্রিস্টির অন্তত পরোক্ষ প্রভাব অস্বীকার করাই যাবে না, তা হল জটায়ু। লালমোহন গাঙ্গুলি বাজারচলতি পাল্প রহস্যকাহিনির লেখক, গোয়েন্দাগল্পের হার্ডবয়েল্ড ধারায় তাঁর বিচরণ। সত্যজিৎ নিজের গোয়েন্দা ফেলুকে হু-ডান-ইট ধারাতেই আবদ্ধ রেখেছেন, পাল্প ঘরানার প্রতি তাঁর বিশেষ ভক্তি ছিল বলে মনে হয় না, অন্তত বাংলায় প্রচলিত পাল্প-সিরিজগুলির প্রতি তো নয়ই। সেই ঘরানার লেখা ও লেখকদের নিয়ে একটু মজা করার উদ্দেশ্যেই জটায়ুর সৃষ্টি। কিন্তু এই সৃষ্টির পিছনে মডেল হিসেবে নিশ্চয় কাজ করেছিল ক্রিস্টির সৃষ্ট চরিত্র অ্যারিয়াডনি অলিভার। ক্রিস্টি নিজে অবশ্য স্বীকার করেছিলেন যে মিসেস অলিভারের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি শুধু গোয়েন্দাগল্পের ধারাকে নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়েও অল্পবিস্তর মশকরা করেছেন। মিসেস অলিভারও তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দাগল্প লিখিয়ে, দিকে দিকে তাঁর পাঠককুল ছড়িয়ে আছে জটায়ুরই মতো। তিনিও পোয়ারোকে রহস্য সমাধানে সাহায্য করতে এক পায়ে খাড়া, কিন্তু যে ‘ফেমিনিন ইনটিউশন’-এর উপর নির্ভর করে তিনি নিজের মতো করে রহস্য সমাধান করতে যান তা তাঁকে প্রায়শই ভুলভাল দিকে নিয়ে গিয়ে ফ্যালে। ঠিক যেমন ফেলুদার ভাষায় জটায়ু আগে অপরাধীকে চিহ্নিত করে তার ঘাড়ে দোষটা চাপাতে চেষ্টা করেন। মিসেস অলিভারের প্রখ্যাত গোয়েন্দা ইংরেজ না, ফিনদেশীয় নিরামিষাশী স্বেন হ্যেরসন। জটায়ুও গর্বভরে নিজের গোয়েন্দা প্রখর রুদ্র সম্পর্কে বলেন, “রাশিয়ান নাম— প্রখর, কিন্তু বাঙালিকেও কী রকম মানিয়ে গেছে বলুন!” (সোনার কেল্লা) কিন্তু ফিনল্যান্ড বা স্ক্যান্ডিনেভিয়া সম্পর্কে তিনি প্রায় কিস্যুই জানেন না, ফলে জটায়ুর “উটের পাকস্থলী” আর “নর্থ পোলে জলহস্তী” মার্কা ভুলের ফাঁদে তিনি প্রায়ই পা দেন। পোয়ারো মাঝে মাঝে তা মৃদুভাবে শুধরে দেন বটে, তবে তা নিয়ে লজ্জা পাওয়া-টাওয়ার মধ্যে নেই জাঁদরেল মিসেস অলিভার। মিসেস অলিভার আর জটায়ু দুজনেই পোয়ারো আর ফেলুদার প্রতিনিধি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে রহস্যভেদে সাহায্য করেন মাঝেমধ্যে (কার্ডস অন দ্য টেবল, এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেম্বার, অপ্সরা থিয়েটারের মামলা)। তবে ক্রিস্টি আর সত্যজিৎ দুজনেই এই দুই লেখককে দিয়ে প্রধানত যে উদ্দেশ্যটি সাধন করেছেন— এবং সার্থকভাবেই করেছেন— সেটি হল গোয়েন্দাকাহিনির সিরিয়াস আবহে কমিক রিলিফ নিয়ে আসা।
সন্দেশের সম্পাদক সত্যজিৎ জানতেন যে, যে বিপুল সংখ্যক কিশোর-কিশোরী এই পত্রিকা পড়ে, তাদের মনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের দায়িত্ব তিনি পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে এড়াতে পারেন না। ফেলুদার মধ্যে দিয়ে তাই তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন নতুন প্রজন্মের এক অভিভাবককে যে শতেক অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যেও দায়িত্ব নেওয়ার শিক্ষা দিতে পারে, বন্ধুত্বের পাঠ দিতে পারে; একজন অল্পবয়সি দাদা যে নরমেগরমে, আদরে-গাঁট্টায় জগতের ভালো আর মন্দের হিসেবটা বুঝিয়ে দিতে পারে, মানুষের প্রতি— সে অপরাধী হলেও— সহানুভূতিশীল হতে শেখায়। তাই ফেলুদার গল্প থেকে কিশোর-কিশোরীরা কেবল জ্ঞানজগতের একের পর এক পরতের সঙ্গে পরিচিতই হয় না, পরিচিত হয় এক বিশেষ মূল্যবোধের সঙ্গে, নিতান্ত পার্থিব সম্পর্কগুলির জটিলতার সঙ্গে। তাই বিজ্ঞানী নীহার দত্ত খুনি জেনেও ফেলুদা চুপ করে থাকে, কারণ তিনি দস্তুরকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছেন (গোলকধাম রহস্য)। তাই ফেলুদার গল্পে দেখতে পাই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্ধেশ্বর মল্লিক তাঁর দেওয়া ফাঁসির রায় সম্পর্কে অনুতপ্ত (ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর), কিংবা মদের নেশায় আর রাগের চোটে বেয়ারাকে খুন করে ফেলা মহেশ চৌধুরী সেই বেয়ারার ছেলেকে নিজের পুত্রজ্ঞানে বড় করে তোলার মধ্যে দিয়েই মনের শান্তি খুঁজে পান (ছিন্নমস্তার অভিশাপ)। এই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব নিয়ে খেলায় কন্যান ডয়েলের হোমসের চেয়ে ক্রিস্টির গোয়েন্দারা অনেক বেশি সিদ্ধহস্ত। দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড-এ মিস মার্পল মেরিনা গ্রেগকে হত্যাকারী জেনেও ছেড়ে দেন, মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস-এ পোয়ারো ট্রেনের বারোজনকেই হত্যাকারী জেনেও চুপ থাকেন, কারণ ওই মূল্যবোধ— এরা প্রত্যেকেই আর-এক অন্যায় মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে মাত্র। শার্লক হোমসের একলব্য ফেলুদার গল্প লেখার সময় তাই বোধহয় না চাইতেও অনেক ক্ষেত্রেই ক্রিস্টির স্কুলে হাত পাকিয়ে ফেলেন সত্যজিৎ রায়।
তাই বোধহয় পোয়ারোর গর্বের ‘লিটল গ্রে সেলস’ রূপ নেয় ফেলুদার প্রিয়তম আয়ুধের, যার নাম— ‘মগজাস্ত্র’।
কৃতজ্ঞতা: ড. কৌশিক মজুমদার, ড. বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
..............................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]