নিবন্ধ

পারিজাত বক্সী—পাল্প ও মূলধারার দ্বন্দ্ব

সুকল্যাণী সেনগুপ্ত April 24, 2021 at 6:11 am নিবন্ধ

........................

ডিটেক্ট it : পর্ব ১০ 

‘পারিজাত বক্সী’ বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের ইতিহাসে অপেক্ষাকৃত কম চর্চিত নাম হলেও পুরোপুরি উপেক্ষিত, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ গ্রন্থে সুকুমার সেন গত শতকের ষষ্ঠ দশক অবধি আলোচনা করায় সেখানে হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় সৃষ্ট এই গোয়েন্দাচরিত্রটি ঠাঁই পায়নি। কিন্তু পপুলারিটির কারণেই সম্ভবত, বিভিন্ন প্রকাশনীর গোয়েন্দা সংকলনে চোখে পড়ে পারিজাতের উজ্জ্বল উপস্থিতি। হরিনারায়ণ একাধিক গোয়েন্দাচরিত্র সৃষ্টি করলেও শুধুমাত্র পারিজাতকে নিয়েই লিখেছেন এগারোটি গল্প-উপন্যাস। কাহিনিগুলি পড়লে জানা যায় পারিজাতের সাথে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল ও জনপ্রিয় গোয়েন্দার পদবির সাদৃশ্য লেখকের ইচ্ছাকৃত; তিনি পাঠকের দরবারে পারিজাতের পরিচয় করিয়েছেন বিখ্যাত গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভাইপো হিসাবে। স্বাভাবিকভাবেই তাই এসে পড়ে তুলনামূলক আলোচনার পরিসর। একাধিক গল্পে ব্যোমকেশের রেফারেন্স এনে পারিজাত বক্সীর পরিচয় করানো হয় মক্কেল তথা পাঠকের সাথে, এবং দক্ষতা নিয়েও প্রায় একই আসনে বসানো হয়। কিন্তু, ব্যোমকেশ কাহিনির সাথে পারিজাতের কাহিনির সাদৃশ্য সামান্যই। জনপ্রিয়তার সাথে সাথে কাহিনির বৈচিত্র্য, অপরাধের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, মানব প্রবৃত্তিগুলির স্বাভাবিক ও যথাযথ প্রকাশই ব্যোমকেশের মূল ইউএসপি। পারিজাত বক্সীর কাহিনিতে চেনা প্যাটার্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও নজর এড়ায় না কয়েকটি হত্যারহস্যে। ব্যোমকেশের সাথে পারিজাতের প্রধানতম তফাত বোধহয় এখানেই, যে, ব্যোমকেশ নিজের হাতেই কাহিনির রাশ ধরে রাখত—অপরাধীকে পুলিশের কাছে তুলে দেবে কি না এ সিদ্ধান্তও যেমন তার ছিল, তেমনি পুলিশি ব্যবস্থায় ব্যোমকেশের অনাস্থার চিত্রও শরদিন্দু একাধিক কাহিনিতে দেখিয়েছেন। তাই আইনমাফিক প্রথানুযায়ী শাস্তির বিধান না মেনেও ব্যোমকেশ শাস্তি দিয়েছে অপরাধীকে নিজের মতো করে, সেখানে আইনের হাত থেকে বাঁচিয়েও অপরাধীর মনে এঁকে দিয়েছে সারাজীবনের মতো দগদগে ক্ষত, উদাহরণস্বরূপ ‘আদিম রিপু’-র কথা মনে করা যেতে পারে। কিন্তু পারিজাত বক্সী নিজের হাতে আইন তোলেনি কখনো; শ্রীসুকুমার সেন দেখিয়েছিলেন অক্সফোর্ডশিক্ষিত গোয়েন্দাকাহিনির লেখকেরা ডিটেকটিভকে শুধুমাত্র রহস্য সমাধানের জন্য অনুসন্ধানের কাজেই যুক্ত করতেন, কিন্তু কাহিনির শেষরক্ষা করতে হত পুলিশকেই, অর্থাৎ পুলিশি শাসনব্যবস্থাতেই তারা অন্তিম আস্থা রাখতেন। বিলিতি সাহিত্য থেকে সরাসরি প্রভাবিত হওয়ায় বঙ্গদেশের গোয়েন্দাসাহিত্যেও বরাবর গোয়েন্দা ও পুলিশের এক সমঝোতা চোখে পড়ে— ব্যোমকেশ থেকে ফেলুদা কেউই তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে গোয়েন্দাকাহিনির দুটি স্তর দেখা যায়, ক্রাইম সংঘটিত হওয়ার পর প্রথম স্তর অর্থাৎ পুলিশ, রহস্য সমাধানে ব্যর্থ হলে প্রয়োজন হয় দ্বিতীয় স্তরের, অর্থাৎ ডিটেকটিভের। ডিটেকটিভ নিজের অংশের কার্য সমাধা করে অপরাধী নির্ণয় করে আবার আইনের হাতেই বিচার ও শাস্তির ভার ছেড়ে দেয়। ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে একাধিক পুলিশের সাথে সুসম্পর্ক যেমন ছিল, তেমন সরকারি কাজে উপরমহল থেকে ডাকও পেত এই সত্যান্বেষী। পারিজাত বক্সীর সাথেও লালবাজারের অফিসারদের ওঠাবসা এবং সেখানে তার কদরের যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কাহিনির সাধারণ কাঠামো রক্ষিত হয়— অর্থাৎ যেখানে পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে বাহুবলে আইনি সহায়তা নিয়ে গোয়েন্দা এগিয়ে আসেন মগজাস্ত্রের দ্বারা রহস্য সমাধানে, কিন্তু অপরাধী প্রেপ্তারের পর বিচারের ভার ন্যস্ত থাকে আইনব্যবস্থার উপরেই।  হরিনারায়ণবাবুও কিন্তু পারিজাতের কাহিনিতে এই ধারারই অনুসরণ করেছেন। তবুও ব্যোমকেশের যে আবেদন পাঠকের মনে তৈরি করেছিলেন শরদিন্দু, সেই আবেদন পারিজাতের ক্ষেত্রে তৈরি করা যায়নি, যথেচ্ছভাবে অ্যাডাল্ট এলিমেন্ট থাকলেও ব্যক্তিত্বের তফাতের কারণেই পারিজাতের পরিচিতি কিশোরসাহিত্যের গণ্ডিতেই আটকে পড়েছে বলে মনে হয়। ব্যোমকেশ কাহিনি মূলধারার হয়েও গোয়েন্দাকাহিনিকে সাধারণ উপন্যাসের সাথে মিশিয়ে দিতে পেরেছিল অপরাধের মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র‍্যের কারণে, সেখানে হত্যা অভিনব উপায়ে দেখানো হয়নি হাতে গোনা কয়েকটি গল্প ছাড়া, বরং অপরাধীরা হয়ে উঠেছে অভিনব (‘চিড়িয়াখানা’র ভুজঙ্গধরবাবু কিংবা ‘পথের কাঁটা’র প্রফুল্ল রায়কে আমরা ভুলি কেমন করে!)। কিন্তু পারিজাত কাহিনি মূলধারার গোয়েন্দা সাহিত্য থেকে সরে এসেছে পাল্প ঘরানার দিকে, তাই সেখানে পাঠককে চমৎকৃত করার প্রচেষ্টা দেখা যায় অভিনব হত্যা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে— চেয়ারে আঁটা সিরিঞ্জ হোক, বা পোষ্যের পিঠে বাঁধা হাইড্রোসায়ানিক গ্যাস বাক্স, কিংবা বিষাক্ত গাছ, এসবই পাঠকমনকে অভিভূত করার জন্যই গল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। হত্যাকাণ্ড বাদ দিয়ে বাকি কাহিনিগুলিতেও পারিজাতকে নায়কোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে পাল্প ঘরানার প্রভাব।

তবে একটি বিষয় দুক্ষেত্রেই দেখা যায়, গোয়েন্দাচরিত্রের প্রাধান্য বাড়াতে রিয়েল লাইফ চরিত্রের আমদানি শরদিন্দু করেছিলেন, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ডাকে ব্যোমকেশকে দেশের কিছু গোপনীয় কাজে দিল্লি যেতে হয়েছিল বলে জানা যায়। তেমনই পারিজাত বক্সী হত্যারহস্যের কিনারা করতে জুনিয়র পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখতে যান এবং শো-এর পর জাদুকরের সাথে দেখা করলে তিনি বলেন— “আরে আপনি এসেছেন! আগে জানালেন না কেন, কমপ্লিমেন্টারি পাঠিয়ে দিতাম।” অর্থাৎ একজন আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত মানুষের কাছে পারিজাতের প্রাধান্য বা ইম্প্রেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রয়োগ আসলে পাঠকের দরবারে গোয়েন্দার খ্যাতি প্রকাশেরই এক মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।

এবার পারিজাতের কাহিনিগুলির সাথে খুব সংক্ষেপে পরিচয় সেরে নেওয়ার পালা। এগারোটি কাহিনির মধ্যে ছয়টি কাহিনি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে— ‘মৃত্যু-শলাকা’, ‘মৃত্যুর ঠিকানা’, ‘মৃত্যুদূত’, ‘লা’, ‘কাঠের পা’, ‘কুয়াশায় ঢাকা মুখ’। মার্ডার মিস্ট্রি হলেও ‘মৃত্যুদূত’ এবং ‘কাঠের পা’ গল্পে চোরাকারবার নিয়েই অশান্তির সূত্রপাত হয় যা হত্যাকাণ্ডের এবং অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথের জন্ম দেয়। এই দুটি গল্প ছাড়াও আরও তিনটি স্মাগলিং-সম্পর্কিত রহস্য উদ্ঘাটনে পারিজাত বক্সীকে এনেছিলেন লেখক— ‘এক মুঠো হীরে’, ‘গোয়েন্দা ও প্রেতাত্মা’, ‘কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনী’। চাইল্ড ট্র্যাফিকিং নিয়ে লেখা পারিজাতের তিনটি কাহিনি— ‘সীমানা ছাড়িতে’, ‘বোলতার হুল’, ‘কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনী’ (এই গল্পে স্মাগলিং-এর পাশাপাশি অপহরণ চক্রও দেখা যায়)। ‘বোলতার হুল’ গল্পে এক দুর্ধর্ষ অপরাধী হিসাবে আনা হয়েছে বোলতাকে, যা অনায়াসেই আমাদের মনে করাবে স্বপনকুমার সিরিজের অপরাধীদের কথা (বাজপাখি, কালো নেকড়ে ইত্যাদি); অর্থাৎ পাল্পের প্রভাব আসছে। 

‘মৃত্যুদূত’ গল্পে স্কুলশিক্ষিকা চন্দনা সেন নিহত হলে হত্যাকারী হিসাবে ধরা পড়ল এক বৃহন্নলা, নাম যশোদা, সে চন্দনার বাড়িতেই ঠিকে ঝি সেজে থাকত এবং চন্দনার সাথে একই চোরাকারবারে লিপ্ত ছিল। এই গল্পটি হত্যাকাণ্ড হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলা সাহিত্যে বৃহন্নলা খুনিকে নিয়ে আসার নজির সেভাবে চোখে পড়ে না। আর এই গল্পটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরো এক কারণে— একজন বৃহন্নলাকে সমাজ কোন দৃষ্টিতে দেখে এবং দেখতে শেখায়, বৃহন্নলার প্রতি জনরুচির পরিচয় পাওয়া যায় এই গল্পে। তাই যশোদাকে পারিজাত বক্সী চন্দনা সেনের ফ্ল্যাটেই ঘায়েল করে বেঁধে রাখার পর ভোরবেলা চন্দনার প্রতিবেশী আনন্দ সরকার তাকে দেখলে যখন চমকে উঠে বলে, “আরে এ যে যশোদা”, তখন পারিজাত বক্সী হেসে বলেন, “যশোদা কি নন্দ জানি না মশাই…”। আবার ছোট দারোগা অপরেশ মুস্তাফি এসে চন্দনা সেন হত্যার আসামীকে একবার দেখেই বলে— “দুর্গা, দুর্গা! এ কি ব্যাপার, এ যে মাছও নয়, মাংসও নয়।” প্রত্যুত্তরে পারিজাত হেসে বলেন, “আমার এত বছরের গোয়েন্দা জীবনে বৃহন্নলা অপরাধী আর দেখি নি।” এই যে কথোপকথন, তা আসলে আমাদের দেশের প্রকৃত লিঙ্গচেতনার অভাবকেই পরিস্ফুট করে। পপুলার সাহিত্যে বৃহন্নলাকে অপরাধী বানানোর মধ্যে নতুনত্ব তো আছেই, তার থেকেও বড় কথা, পপুলার বা মূলধারার সাহিত্যরচনায় পাঠকের মনের মতো কাহিনিরচনার দায় থেকে যায় লেখকের, এ কথা আমাদের অজানা নয়। পাঠকের মনোতোষের কারণেই ডয়েল বাধ্য হয়েছিলেন হোমসের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে, এসবই জনপ্রিয় সাহিত্যের পাঠকের জন্য। একইভাবে তাই হরিনারায়ণের লেখাতে স্বয়ং ডিটেকটিভ এবং আইনরক্ষকও পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা বলে ওঠেন, যার মধ্যে মশকরা বর্তমান থাকে অপরাধীর লিঙ্গপরিচিতির কারণে, তখন তা আসলে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলনই ঘটায়। বর্তমানে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটের দৌলতে মানুষ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের খবর সহজেই জানতে পারছে, সংখ্যায় কম হলেও অনেক মানুষ আজ লিঙ্গচেতনা নিয়ে সচেতন, সংবেদনশীল হতে উঠেছে, দেশে ইতিমধ্যে ৩৭৭ ধারা নিয়ে চলেছে বিদ্রোহ, খাস কলকাতার বুকে গত কয়েকবছর ধরে সাড়ম্বরে ঘটে চলেছে রেইনবো প্রাইড ওয়াক, যেখানে হেটেরোসেক্সুয়াল মানুষও পা মিলিয়েছেন এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির সাথে, একসাথে লিঙ্গপরিচিতি উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে। এখনও যাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ছুঁৎমার্গ কাজ করে, তারাও কিন্তু সর্বসমক্ষে সেই বক্তব্য রাখতে এতটা স্বচ্ছন্দ নয় পারিজাত বা মুস্তাফির মতো— শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটিই বাস্তব। কিন্তু গত শতকের সাতের দশকে সবকিছু যে অনেক অন্যরকম ছিল, তার পরিচয় সেই সময়ে লেখা এই গল্পেই মেলে। সেখানে জনমানসে ‘হিজড়ে’ সম্প্রদায়কে নিয়ে ভীতি, মশকরা ইত্যাদি প্রতিক্রিয়ার সরাসরি প্রতিফলন এই গল্পে পাওয়া যায়, কারণ গোয়েন্দাকাহিনি মূলধারারই প্রতিনিধিত্ব করে। 

‘এক মুঠো হীরে' গল্পটি আপাতভাবে সাদামাটা হলেও পারিজাত-কাহিনিতে এর গুরুত্ব আছে। মোটামুটি সব গোয়েন্দালেখকেরই এক প্রয়াস থাকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রটিকে সব দিক থেকে অসামান্য করে তোলার। ব্যতিক্রম থাকলেও এটিই অধিকাংশের বৈশিষ্ট্য। বিশেষত কিশোরদের জন্য তৈরি গোয়েন্দারা আবার সবাই অবিবাহিত হন, প্রেমবিবর্জিত জীবনেই তাঁদের আমরা দেখতে অভ্যস্ত। হরিনারায়ণ তাঁর মহিলা গোয়েন্দার বেলায় কিন্তু এই ছক ভেঙেছেন, অবিবাহিত নারী গোয়েন্দা কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেমিক তথা সহকারীকে নিয়ে শহর কলকাতার বাইরে ছুটেছে রহস্য সমাধানের আশায়। কিন্তু পারিজাতের বেলায় তার ব্যক্তিগত জীবন আলোয় আনেননি। দু-একটি গল্পে জানা যায় পারিজাত বিবাহিত, তাও সম্পূর্ণ অন্য সূত্র ধরে। ব্যোমকেশে সত্যবতীর ভূমিকা যেমন সরাসরি অনেক গল্পে থাকত, কিংবা তাদের দুজনের ব্যক্তিগত সমীকরণও অজিতের পার্স্পেক্টিভ থেকে শরদিন্দু দেখিয়েছেন, তেমনটা পারিজাতের বেলায় হরিনারায়ণ একদমই করেননি। আলোচ্য গল্পে (‘এক মুঠো হীরে’) এক হোটেলের সুন্দরী ও লাস্যময়ী নর্তকীর চোরাকারবারে লিপ্ত থাকার খবর পেয়ে পারিজাত তাকে হাতেনাতে ধরতে গেলে সেই নর্তকী তার শরীরকে ব্যবহার করেই অবস্থা সামাল দিতে যায়। কিন্তু গোয়েন্দা কিছুক্ষণের জন্য প্রথম রিপুর কারণে ভারসাম্য হারালেও তা দ্রুত কাটিয়ে উঠে নর্তকীর অভিসন্ধি বুঝে যায়। গল্পটিতে নর্তকীর শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা লেখক ইচ্ছাকৃতভাবেই অনেক সূক্ষ্মভাবে দিয়েছিলেন, তা হয়তো গোয়েন্দার চারিত্রিক দৃঢ়তার মাত্রা বোঝানোর জন্যেই। এটি একদিকে মূলধারার গোয়েন্দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনুসরণ করছে, আবার অন্যদিকে এই রাতের কলকাতার হোটেলের এক অন্যদিক তুলে ধরার প্রয়াস কিন্তু পাল্প ধারার প্রভাবেই এসেছে বলে মনে হয়।

‘কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনী’-তে মূর্তিচোরদের পিছু নিতে গিয়ে দুটি ছেলে সেই জালে জড়িয়ে পড়ে, আর এদের অপহরণের সাথে সাথেই পারিজাত বক্সীর আবির্ভাব ঘটে তাদের উদ্ধার করার জন্য। একাধিকবার অপহরণ হওয়া এবং শেষমেশ বিহারে গিয়ে রহস্যের কিনারা হওয়া এই উপন্যাসটিতে গোয়েন্দা পারিজাতের নানা দক্ষতার কথা এবং পারিজাতের নানা অ্যাকশনের কথা বলেছেন লেখক। তবে এই গল্পে গোয়েন্দা উপস্থিত থাকলেও  ডিটেকশনের থেকে গোয়েন্দার অ্যাকশনের বর্ণনা দেখে মনে হয় এই কাহিনিকে অ্যাডভেঞ্চার জঁরে অন্তর্ভুক্ত করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। 

পারিজাত বক্সীর কাহিনিগুলির মধ্যে হত্যারহস্যগুলিতে এবং স্মাগলিং-সম্পর্কিত কেসগুলিতে ‘ডিটেকশন’ ব্যাপারটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। কিন্তু কিডন্যাপিং কেসগুলিকে গোয়েন্দাকাহিনির দলে ফেলা যায় না। পারিজাত বক্সীর উপস্থিতি ছাড়া তাতে গোয়েন্দাকাহিনির উপাদান বা কাঠামো কোনোটিই সেভাবে মান্যতা পায়নি। এই গল্প তিনটিতে (কবন্ধ বিগ্রহের কাহিনী, বোলতার হুল, সীমানা পেরিয়ে) পারিজাত যেন গোয়েন্দা নন, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির নায়ক, যিনি প্রতিপক্ষের সাথে মারপিট করতে পারেন, শারীরিক শক্তি যেখানে ব্যর্থ সেখানে তিনি বুদ্ধির প্রয়োগ করেন, বারবার ছদ্মবেশ ধারণ করেন— এই গল্পগুলিতে ব্যোমকেশের ভাইপো হিসাবে পরিচয় দেওয়া পারিজাতের সাদৃশ্য চলে আসে পাল্প ফিকশনের নায়কের সঙ্গে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার গল্পগুলিতে তাই পারিজাত অনেকটাই লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠেন, যিনি ব্যর্থ হতেই পারেন না। মার্ক বিলিংহ্যামের মতে, “…today’s modern detetctive should be a bit less heroic and a bit more flawed…who exhibits both virtues and weeknesses…

 readers care more about a detective who is imperfect…”; হয়তো এই কারণেই পাঠকের কাছে পারিজাতের গ্রহণযোগ্যতা সময়ের সাথে সাথে ফুরিয়েছে।

পারিজাত বক্সীর নানা দক্ষতার মধ্যে একটি দিক বিশেষভাবে বারবার উল্লিখিত হয়েছে— ছদ্মবেশ ধারণ। তিনি যখন খুশি সাহেব টুরিস্ট, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী নানা ছদ্মবেশ নিয়ে নেন, যাতে তাঁকে চেনাই দায় হয়ে পড়ে। কার্য সমাধার কারণে একই গল্পে একাধিকবার প্রতিপক্ষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তাঁকে ছদ্মবেশ নিতে দেখা গেছে। বাঙালি গোয়েন্দাদের মধ্যে ছদ্মবেশ অনেকেই নিয়েছেন, তবে এতবার কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কোথাও গিয়ে একই গল্পে একাধিকবার বেশ-বদল হয়তো কাহিনির ছন্দ নষ্ট করেছে পুনরাবৃত্তির কারণে। 

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রোনাল্ড নক্স এবং এস এস ভ্যান ডাইন আমেরিকার ডিটেকটিভ ফিকশন লেখার পাশাপাশি কিছু সূত্রাবলি বিধৃত করেন, যেগুলিকে গোয়েন্দাকাহিনির লেখকদের গাইডবুক ভাবলে ভুল বলা হবে না। সেই সূত্রাবলি পারিজাত বক্সীর কাহিনিতে কোথায় কোথায় মান্যতা পায়নি, সেই দিকটিও দেখা দরকার। তাহলে হয়তো কালের আড়ালে চলে যাওয়া এই ডিটেকটিভের পাঠকমন থেকে মুছে যাওয়ার কারণ  উপলব্ধি করা যাবে। 

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনে চিন অভিযানের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, যা ইতিহাসে ‘ইয়েলো পেরিল’ বলে চিহ্নিত। পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে ‘থ্রেট’ হিসাবে দেখা দিয়েছিল চিনা মানুষেরা। এই ঘটনার প্রভাবেই ফিল্পট্‌স-স্যাক্স রোমারদের লেখা ক্রাইমকাহিনিতে চিনা দুশমনের আবির্ভাব ঘটল, যা সাংঘাতিকভাবে জাতি ও বর্ণবৈষম্যকে প্রচার করে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতা এমন এক প্রভাব বিস্তার করে, যে, শাসককে অনুকরণ করাই উপনিবেশিতদের ভবিতব্য হয়ে পড়ে— তা সে জ্ঞানত হোক  বা না বুঝে, এ কথা হোমি ভাবার ‘অনুকৃতি’ তত্ত্বে পাওয়া যায়। মেকলেও কিন্তু এই একই ধাঁচে ঔপনিবেশিকের স্বার্থেই উপনিবেশ ভারতে বুর্জোয়া সম্প্রদায়কে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যারা অনুকরণের মাধ্যমে আচার-আচরণ-চিন্তা-ভাবনায় হবে ইউরোপীয়। উপনিবেশিতের সংস্কৃতিতে তখন শাসকের অনুকরণ করাটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়, সম্ভবত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকেই। ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্রিটেনের উপনিবেশে পরিণত হওয়ার পর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবিত (বা ক্ষতিগ্রস্ত) হওয়া যথেষ্ট দ্রুত চিহ্নিত করা গেলেও সাংস্কৃতিক প্রভাব বোঝা গেছে অনেক দেরিতে। এরই ফল হিসাবে দেখা যায় বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনির আবির্ভাব, যা প্রথম আসছে সরাসরি পাশ্চাত্য কাহিনি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিকের প্রবণতাই তখন উপনিবেশিতের প্রবণতায় রূপান্তরিত হচ্ছে, তার প্রভাব হিসেবেই প্রথমে অনুবাদে, তারপর মৌলিক লেখাতেও চিনা দুশমনের আবির্ভাব ঘটছে। প্রাচ্য সাহিত্যে প্রাচ্যের মানুষের প্রতি বৈষম্য কী অদ্ভুতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে— এই হচ্ছে ঔপনিবেশিকতাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যেখানে উপনিবেশিতের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা-উপলব্ধি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয় ঔপনিবেশিকের দ্বারা। 

রোনাল্ড নক্স সরাসরি এর বিরোধিতা করে বলছেন, কোনো চিনাকে ক্রাইম কাহিনির কালপ্রিট বানানো ক্রাইমকাহিনির এক অন্যতম খারাপ লক্ষণ। এত কথা বলার কারণ, উত্তর-ঔপনিবেশিক জমানাতেও হরিনারায়ণবাবু এর প্রভাব সরাসরি এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাই ‘বোলতার হুল’ গল্পে চিনা এক অপরাধীর উল্লেখ থাকে, যে কাহিনিতে ‘প্রাইম কালপ্রিট’ না হলেও অপরাধকার্যে যুক্ত, এবং যাকে নিয়ে এই বাক্যটি লেখা হয়— “চিনাদের মুখ মুখোশের মতন, মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।” বলা বাহুল্য, এই জাতিবৈষম্য ইউরোপীয় মননের অনুসরণেরই ফল। 

নক্স কিন্তু ক্রাইমকাহিনিতে যমজ ভাই বা বডিডাবল আনাও কৃতিত্ব হিসাবে দেখছেন না, যদি না পাঠককে তার জন্য প্রথম থেকে মানসিকভাবে তৈরি করা হয়। ক্রাইমকাহিনি রচনার এই সূত্রেরও উল্লঙ্ঘন ঘটছে ‘লা’ গল্পে। যেখানে অভিযুক্ত নেপালি ছেলেটি ইচ্ছাকৃতভাবে তার যমজ ভাইয়ের অজান্তেই তাকে ব্যবহার করে নিচ্ছে অপরাধের জটিলতা বাড়িয়ে নিজে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য। আর পাঠক যমজ ভাইয়ের টুইস্ট জানতে পারছে কাহিনির অন্তিমে পৌঁছে।

এস এস ভ্যান ডাইন রচিত ‘Twenty Rules for Writing Detective Stories’-এর সপ্তম সূত্রে বলা হয়েছে, গোয়েন্দাকাহিনিতে মৃত্যু বা মৃতদেহ থাকাটা জরুরি। শুধুমাত্র পাঠকের মানসিক শক্তিক্ষয়কে এবং লেখার সাথে পাঠকের সংযুক্তিকরণকে প্রাধান্য দিলে একমাত্র হত্যাই ক্রাইমকাহিনির সঙ্গে যথার্থভাবে  খাপ খায়। পারিজাতের ছয়টি কাহিনিতে হত্যা বা মৃতদেহের দেখা পাওয়া গেলেও বাকি পাঁচটি কাহিনিতে তা অনুপস্থিত।

ভ্যান ডাইনের মতে, মাফিয়া বা গুপ্ত সংস্থার উপস্থিতি ক্রাইমকাহিনির ওজন কমিয়ে তাকে অ্যাডভেঞ্চার ফিকশন করে তোলে, যে কথা আগেই পারিজাতের কিছু কাহিনি সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে, বিশেষত স্মাগলিং কেসগুলির ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। 

অষ্টাদশ সূত্র জানাচ্ছে, “a crime in a detective story must never turn out to be an accident or a suicide.” ‘কাঠের পা’ গল্পটিতে এই রীতি লঙ্ঘিত হয়েছে, যেখানে মৃতদেহ থাকলেও তা হত্যা নয় বলেই কাহিনির শেষে জানা যাচ্ছে। যদিও সেখানে ক্রাইম বলতে মৃত ব্যক্তির চোরাকারবারে যুক্ত থাকাটুকুই দেখানো হচ্ছে, কিন্তু সেই ব্যক্তি ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে, তাকে খুন করা হয়নি, এই ব্যাপারটুকুই সূত্রটি মেনে চলেনি সেকথা বলা যায়। 

ঊনবিংশ সূত্রে বলা হয়েছে, “the motives for all crimes in detective stories should be personal. International plottings and war politics belong in a different category of fiction…”। বিশ্ব রাজনীতি আনা না হলেও চোরাকারবার বা শিশুপাচার, নারীপাচারজনিত গল্পগুলি কিন্তু পারিজাত বক্সীর কাহিনিগুলির দুর্বলতাকেই চিহ্নিত করে। 

আরও পড়ুন : পৌরাণিক নাকি সাংসারিক : গোয়েন্দা দময়ন্তী / বসুন্ধরা মন্ডল

এ ছাড়াও, যে-কোনো ক্রাইমকাহিনিতে গোয়েন্দার সহকারীর উপস্থিতি থাকে গোয়েন্দাকে হাইলাইট করার জন্যই। সেই সহকারী, গোয়েন্দার থেকে বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে অনেকটাই খাটো হবে, তার চোখ দিয়েই গোয়েন্দাকে পাঠক চিনবে এবং তার অবজারভেশন অনুযায়ীই পাঠকের অবজারভেশন এগোবে, যাতে কাহিনির শেষে গোয়েন্দার চমৎকারিত্বে পাঠক সহকারীর মতোই অভিভূত হয়। সহকারী গোয়েন্দার অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কৌশলে পাঠকমনে প্রবেশ করিয়ে দেয়, এবং পাঠকদের সাথে সহকারীর অবস্থান একই স্তরে থাকে। সহকারী মাঝে মাঝে কমিক রিলিফ দেওয়ার জন্যও তৈরি হয়। পারিজাত বক্সীর কোনো সহকারী কিন্তু হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেননি। এই সিদ্ধান্ত ব্যোমকেশের রেফারেন্স টেনেও ব্যোমকেশের থেকে আলাদা হয়ে ওঠার ইচ্ছা থেকেই প্রসূত কি না, তা জানা না গেলেও একটি সম্ভাবনা হিসেবে ধরা যেতে পারে। যেখানে ব্যোমকেশের কাহিনিতে অজিতের অনুপস্থিতি ভাবাই যায় না, সেখানে তারই ভাইপো বলে পরিচিত পারিজাতের কোনো সহকারী নেই— এর আর অন্য কোনো কারণ থাকবে বলে মনে হয় না। অপর একটি সম্ভাবনাও উঁকি দেয় লেখকের এই সিদ্ধান্তগ্রহণের নেপথ্যে— পাল্প ঘরানার প্রভাবে লার্জার দ্যান লাইফ পারিজাতকে একাই একশো করে তোলার প্রয়াসই হয়তো সহকারী চরিত্রের সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এই সহকারী না থাকার কারণেই প্রায় সব গল্পেই পারিজাতের ইন্ট্রোডাকশন কোনো না কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিতে হয় লেখককে, ‘ধীরে ধীরে কাকার মতই নাম করছে পারিজাত’, এ কথাও বলানো হয়— কোথাও যেন বারবার এই পরিচিতি প্রদান কাহিনির ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ করেছে বলেই মনে হয়, এবং কাহিনির মানও এই কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একজন সহকারী সৃষ্টি করলে হয়তো এই অসঙ্গতিটুকু এড়ানো যেত।

...................................

[সিরিজ পোস্টার : অর্পণ দাস] 


#পারিজাত বক্সী #গোয়েন্দা #ডিটেকটিভ #বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য #ডিটেক্ট it #series #হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় #সুকুমার সেন #ব্যোমকেশ বক্সী #শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় #সুকল্যাণী সেনগুপ্ত #সিলি পয়েন্ট #পাল্প কাহিনি #ক্রাইম কাহিনি #crime thriller #pulp thriller

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

24

Unique Visitors

219068