নাটককার পিকাসোর প্রথম নাটক
নাট্যজগৎ ও পিকাসো
........................
দ্বিতীয় পর্ব : নাটককার পিকাসোর প্রথম নাটক
....................................................................
হ্যাঁ, পিকাসো নাটকও লিখেছিলেন। অবাক করার মতো তথ্য হলেও এটাই সত্যি। তবে তাঁর এই নাটককার হয়ে ওঠা কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে মনে উদয় হওয়া ইচ্ছের বাস্তবায়ন নয় – এর পেছনে রয়েছে তাঁর দীর্ঘকালের নাট্যজগতের সাথে যুক্ত থাকার ইতিহাস, পরিস্থিতির চক্রব্যূহে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এক শিল্পীর শিল্পীসত্তার বিদ্রোহী ও বুদ্ধিদীপ্ত বহিঃপ্রকাশ। “There is no barrier between the arts for Picasso” – বলেছিলেন রোলান্ড পেনরোস, যিনি পিকাসোর নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। সারাজীবনই পিকাসোর বন্ধুমহলে কবি, লেখক, নাটককারদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। বার্সেলোনায় থাকাকালীন ‘এল কোয়াত্রে গাত্স্’ নামের সাহিত্য চক্র কিংবা প্যারি-তে গার্ত্রুদে স্তেইনের বাড়িতে পিকাসোর উপস্থিতি তাঁকে সবরকমের শিল্পধারার সঙ্গে যুক্ত থাকতে সাহায্য করেছিল।
১৯৩৫ সালের এপ্রিল নাগাদ বছর ৫৩-এর পিকাসো চিত্রাঙ্কন ছেড়ে লেখালিখিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৪১ সালের শীতকালে যখন ঘরবন্দি প্যারির বাসিন্দারা যুদ্ধে হারের বাস্তবতাটা অনুভব করতে পারছেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন পিকাসোও। নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সে প্রবল শৈত্য আর খিদের দ্বিফলা আক্রমণে তখন জনজীবন জেরবার। এই পরিস্থিতিতে নিজের শিল্পকর্মের মাধ্যমে ক্ষোভ উগড়ে দিতে চেয়েছিলেন পিকাসো, কিন্তু নাৎসিদের কাছে তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী চিত্রকর্ম ‘গের্নিকা’ খুব পরিচিত হওয়ার ফলে ফের আরেকটি চিত্রের মাধ্যমে বিরোধিতা প্রকাশ করাটা তাঁর কাছে ছিল বেশ বিপজ্জনক। তাই পিকাসো তাঁর রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন নাটকের মতো মাধ্যমকে। ১৯৪১-এর ১৪ই জানুয়ারি থেকে ১৭ই জানুয়ারি – এই তিনদিনের একটানা প্রয়াসে পিকাসো লিখে ফেলেছিলেন তাঁর প্রথম নাটক – 'Le Désir attrapé par la queue' [ইংরাজি অনুবাদে নাটকটির শিরোনাম 'Desire Caught by the Tail'] যেখানে তিনি তাঁর চারপাশে ঘটে চলা অরাজক অবস্থার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটকের শিরোনামটিতে পিকাসো ‘tirer le diable par la queue’ (to grab the devil by the tail) শব্দবন্ধের এক মজাদার প্রয়োগ করেছেন এবং শিরোনামটি নৈরাশ্য বিষয়ে একটি রূপক, যেখানে ‘Désir’ (Desire বা ইচ্ছা-আকাঙ্খা)-কে পার্সোনিফাই করা হয়েছে একটি খাঁচাবন্দি পশুতে। পিকাসো কিউবিস্ট লেখকদের মতো গোটা নাটক জুড়েই শব্দ নিয়ে খেলা করেছেন - কখনও শ্লেষ, কখনও বা বক্রোক্তির মাধ্যমে। সেইদিক থেকে বিচার করলে শিরোনামের ‘Desire’ শব্দটি ‘যৌন উত্তেজনা’ অর্থটিও বহন করে যা নাটকটির রচনাকালের সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
পিকাসোর প্রথম নাটকের ইংরেজি অনুবাদ বইয়ের প্রচ্ছদ
পিকাসো তাঁর এই ষষ্ঠাঙ্ক নাটকে কোনো মানবচরিত্র রাখেননি, রেখেছেন কিছু বিমূর্ত চরিত্রকে। Big Foot, The Onion, The Tart, Her Cousin, Round Piece, The Two Bow-Wows, Silence, Fat Anxiety, Thin Anxiety এবং The Curtains। চরিত্রগুলি রূপকার্থক এবং প্রত্যেকটিই নাৎসি দখলে থাকা প্যারি শহরের অসহায় অবস্থার ইঙ্গিত করে যেখানে বন্দিদশায় মানবজীবনের মূল্য শূন্য, মানুষের পারিপার্শ্বিক বস্তু ও প্রাণির গুরুত্ব সেখানে বেশি হয়ে দাঁড়ায়। আর পিকাসো এই চরিত্রগুলির মাধ্যমেই মজার ছলে সেই সময়ের ভয়াবহ সত্য তুলে ধরেছেন, এঁকেছেন মানবজীবনের করুণ অবস্থার ছবি। নাটক জুড়ে বারবার হিংসার ঘটনার ইঙ্গিত রয়েছে। বারবার দর্শক মুখোমুখি হন উত্তেজক মুহূর্তের, বারবার ফিরে যান সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে। নাটকটিকে ‘surrealistic’ ও ‘simply weird’ বলে আখ্যায়িত করেছেন গবেষকরা। নাটকটিতে বোধগম্য কোনো প্লট নেই বললেই চলে। দুর্বোধ্যতা ও অবাস্তবোচিত মঞ্চ নির্দেশনার কারণে ফলে এর প্রযোজনাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অবশ্য নাটকটির অরৈখিক আখ্যান ও বোধাতীত অর্থের কারণেই এটি প্রশংসিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসের মাঝে দাঁড়িয়ে জীবনের শূন্যতা, মূল্যহীনতা, অর্থহীনতাকে রূঢ় বাস্তবের ক্যানভাসে শব্দের তুলিতে এঁকেছেন পিকাসো। Big Foot-এর স্বগতোক্তির স্বপ্নরূপ অনুভূতি, নাটকে ভাষার অস্থিরতা সমকালীন সময়কেই ইঙ্গিত করে। অস্থির জীবনযাপনে ন্যূনতম ইচ্ছা-আকাঙ্খা পূরণে অপারগতা, জীবনের সামান্যতম প্রয়োজনকেও স্বপ্নে পর্যবসিত করে – দেখিয়েছেন পিকাসো। বার্নার্ড ফ্রেক্টম্যান তাঁর মুখবন্ধে নাটকটি সম্পর্কে লিখেছেন – “It says nothing of human destiny or of the human condition. In an age which has discovered man with a capital M, it is gratifying to advise the reader that Picasso has nothing to say of man, nor of the universe. This in itself is a considerable achievement.”
পিকাসোর প্রথম নাটকের প্রথম পাঠের দিন চরিত্র পাঠকরা ও পিকাসো একসঙ্গে এক ফ্রেমে
নাটকটিতে বারবার হাসির উদ্রেক হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই দৃশ্যের শেষ হয় এক বিপর্যয় দিয়ে; দ্বিতীয় অঙ্কে চরিত্রগুলির ভোজনপর্বের সমাপ্তিতে মৃতদেহ সৎকারকারীদের আগমন, তৃতীয় অঙ্কে Big Foot-এর প্রশংসকদের রক্তরঞ্জিত ও মূর্ছা যাওয়া – এসবই বন্দিজীবনে মৃত্যুভয়ের বাস্তবতার পরিচায়ক। এই প্রসঙ্গে জাঁ ক্যাশু যথার্থই বলেছেন, “Death is always present in the solitudes and caprices of the Spaniards.” নাটকটিতে পিকাসোর ভাষা অত্যন্ত কাব্যিক, বিশেষত Big Foot-এর বেশ কিছু কথায়, যেমন – “The galloping pace of his love crystalized into thought, the canvas born each morning in the fresh egg of her nakedness jumps the barrier and falls panting on the bed.” এবং পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে “The noise of unfastened shutters hitting their drunken bells on the crumpled sheets of the stones tears from the night despairing cries of pleasure”.
নাটকটি রচনার তিন বছর পরে ১৯শে মার্চ ১৯৪৪-এ প্রথমবারের জন্য নাটকটি পাঠ করা সম্ভব হয়েছিল। নাৎসিদের চোখরাঙানিকে তোয়াক্কা না করেই মিচেল লেরিস-এর বাড়িতে নাটকটির পাঠ করা হয়েছিল, যার প্রযোজনা ও নির্দেশনা করেছিলেন সাহিত্যিক আলবের কামু এবং বিভিন্ন চরিত্রের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ফরাসি লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা, যথা- Cousin-এর চরিত্রে সিমন দ্য বোভোয়া (ফরাসি দার্শনিক, লেখিকা ও তাত্ত্বিক), Thin Anxiety-এর চরিত্রে ডোরা মার (ফরাসি চিত্রগ্রাহক, কবি এবং পিকাসোর প্রেমিকা), The Onion-এর চরিত্রে রেমন্ড কুনু (ফরাসি ঔপন্যাসিক, কবি), Round Piece-এর চরিত্রে জঁ পল সার্ত্র (ফরাসি দার্শনিক, লেখক) প্রমুখ। পাঠকেরা একটি অর্ধচক্রের আকারে বসে নির্দিষ্ট অংশ পাঠ করেছিলেন ও কামু এক কোণায় দাঁড়িয়ে পাঠ করেছিলেন মঞ্চ নির্দেশনা এবং আবহসঙ্গীত বেজেছিল পাশের ঘরে থাকা এক গ্রামোফোন থেকে যার দায়িত্বে ছিলেন জর্জ উনিয়ে (ফরাসি গ্রাফিক শিল্পী, কবি)। সেইদিন দর্শকাসনে ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, লেখকেরা, যথা- পল এলুয়া, আরমঁ সালাখু, জাঁ লুই বারহু, অঁরি মিশু, জাক লাকঁ প্রমুখেরা। পিকাসোর এই নাটকটি অনেকের জন্যই দীর্ঘ বন্দিদশার পর ‘মরাল বুস্টার’-এর কাজ করেছিল বলে জানা যায়।
ঐ একই দিনে তোলা আরেকটি ছবি
পিকাসোর নাটকটিকে অনেকাংশেই অ্যাবসার্ড নাটক বলা যায়। কামু ও সার্ত্রের এই নাটকের সঙ্গে সংযোগ এই তত্ত্বকে আরও জোরদার করে তোলে। নাটকটিতে ‘surrealism’-এর ছোঁয়াও রয়েছে, যা লুই বুনুয়েল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ দ্বারা প্রভূতভাবে প্রভাবিত। Surrealism মুভমেন্টের শেষদিকে রচিত এই নাটক আদতে এই ধারার শিল্পকর্ম ও পাঁচের দশকের অ্যাবসার্ড থিয়েটারের মাঝের এক প্রশস্ত সেতু।
আরও পড়ুন : নাট্যজগত ও পিকাসো (প্রথম পর্ব ): থিয়েটার ডিজাইনার পিকাসো
তথ্যসূত্র :
১) Picasso, Pablo. Le Désir attrapé par la queue, Éditions Gallimard, 1989.
২) Picasso, Pablo. Desire Caught by the Tail. Trans. Bernard Frechtman. New York: The Philosophical Library Inc., 1948.
৩) Picasso, Pablo. Desire Caught by the Tail. Trans. Roland Penrose. London: Calder and Boyars, 1970.