পেন, স্ক্যালপেল, Life (চতুর্থ ভিজিট)
মাঝে মাঝেই পেশেন্ট পার্টির মুখে শুনতে হয়, "পেশেন্টকে বাঁচিয়ে দিন স্যার! আপনারা তো ভগবান!"
ডাক্তার ভগবান কিনা জানি না। ভগবানে আমার যে খুব একটা বিশ্বাস আছে সেও নয়। আগে ভূতেও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমার কলিগরা দেখতাম ভূতে ভালোমতোই বিশ্বাস করে। প্রায়শই ওদের জিজ্ঞেস করি, এমন কী ঘটনা ঘটেছে যে তোরা বিশ্বাস করিস ভূত বলে কিছু আছে? তারপর উঠে আসে নানারকম ঘটনা। নিজেও ব্যাখ্যাহীন কয়েকটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। আজ সেইরকমই দু একটা অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেব।
আমাদের হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ড, মানে যেখানে পুড়ে যাওয়া পেশেন্টরা ভর্তি হয়, সেখানে কেউ একলা যেতে চায় না। জয়েন করার পর একদিন একা গিয়েছিলাম শুনে সত্রাজিৎ বলেছিল, "একবার গেছিস ঠিক আছে। আর যাস না।"
স্বভাবতই প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, "কেন?"
সত্রাজিৎ তখন একটা গল্প শোনায়। ও MBBS করেছে নীলরতন থেকেই। এখানকার বহু পুরোনো ছেলে। ঘটনাটা ঘটেছিল ওর ইন্টার্নশিপের সময়। ২০১৭ সাল। বার্ন ওয়ার্ডে একটা বাচ্চা ভর্তি হয়। ১৪-১৫ বছর বয়স। ইলেকট্রিক বার্ন। মানে হাতে হাইভোল্টেজ তারের শক লেগেছে । এইরকম শকে অধিকাংশ পেশেন্ট শক লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। যারা কপালজোরে বেঁচে যায় তাদের নানারকম শারীরিক অসুস্থতা শুরু হয়। হার্টের নানা রোগ শুরু হয়। যেখানে শকটা লাগে সেই জায়গাটা আস্তে আস্তে পচে যেতে থাকে। প্রথমে কিছু হয় না। ৩-৪ দিন পর থেকে পচন শুরু হয়। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই জায়গাটা কেটে বাদ দিয়ে ফেলতে হয়। বাচ্চাটাও সেই কারণে ভর্তি হয়েছিল। যথারীতি হাতে পচন শুরু হয় ৪-৫ দিন পরের থেকে। ঠিক করা হয়, হাত কেটে ফেলা হবে। বাচ্চার বাড়ির লোক রাজি। বাচ্চাও রাজি। করানো হয় সব রিপোর্ট। অপারেশানের ঠিক দুদিন আগে বেঁকে বসে বাড়ির লোক।
"স্যার আপনারা আজ অপারেশান করে দিন। ছেলে থাকতে চাইছে না।"
"সে কী! কেন?"
"না স্যার! আপনারা আজ কেটে দিন হাত। নইলে আমি বাড়ি নিয়ে চলে যাই। রাতে ওয়ার্ডের লোক ওকে এসে ভয় দেখাচ্ছে।"
“মানে? ওরকম হয় নাকি?"
"আপনি জিজ্ঞেস করুন ওকে!"
অবাক হয়ে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করা হয়, "কে ভয় দেখায় তোকে?"
বাচ্চাটা প্রথমে কিছুই বলতে চায়না। অনেক জোরাজুরির পর বলে, "কাল রাতে একজন এসেছিল। এসে বলল, তোর ছুটি হয়ে গেছে, চল আমার সাথে। আমি যেতে রাজি হইনি। তখন বলে গেল, আচ্ছা কাল আমি আসব। কাল তোকে যেতেই হবে আমার সঙ্গে।"
ধমক খায় বাচ্চাটা। মনগড়া গল্পের তকমা পড়ে যায়। বাচ্চাটা খালি বলে, "আমারে ছুটি দিয়ে দেন। আমি আর থাকবনি।"
ধমকধামক দিয়ে চুপ করানো হয়। বলা হয়, "হাত কাটা হবে, তারপর ঠিক হবে, তারপরে বাড়ি যাবি।"
পরদিন সকালে দেখা যায় বাচ্চাটা মারা গেছে। একেবারে আচমকা।
অনেকে ভাবতেই পারেন যে সেপসিসে গিয়ে মারা গেছে। কিন্তু ব্লাড রিপোর্ট থেকে শুরু করে সবকিছুই নর্মাল ছিল। বাচ্চাটার মৃত্যুর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি পোস্টমর্টেম করেও এই আচমকা মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করার কোনো কারণ পাওয়া যায়নি।
সত্রাজিতের মুখে এই গল্পটা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল আমার। আসলে হাসপাতালে সব থেকে বেশি মৃত্যু দেখে বার্ন ওয়ার্ড। ভর্তি হওয়া পেশেন্টের ৯০% বাঁচে না। নীলরতনের বার্ন ওয়ার্ড এমন একটা জায়গায়, যেখানে সূর্যের আলো কোনোদিন ঢোকে বলে মনে হয় না। অজস্র অপঘাতে মৃত্যুর সাক্ষী থাকে ওই ঘরটা। মাসিরা মাঝে মাঝে ফাঁকা বার্ন ওয়ার্ডের দরজার পিছনে শুনতে পায় হাহাকারের আওয়াজ.. চিৎকারের আওয়াজ।
এরপর থেকে আর বার্ন ওয়ার্ডে একা ঢুকি না। কোভিডের সময় ওই ঘরগুলোকে সাসপেক্টেড কোভিড পেশেন্টের আইসোলেশান ওয়ার্ড বানানো হয়। তাতে যে পেশেন্টকেই ঢোকাতাম সে দুদিন পরে একটাই কথা বলত, "স্যার, এই ঘরটা থেকে আমায় বার করুন। এই ঘরে আমার থাকতে কেমন একটা লাগছে।
আমরা বলতাম, "সেকী? এসি ঘর! এত সুন্দর বিছানা! বাইরে গরমে এসে ভালো লাগবে?"
উত্তর আসত, "না স্যার, আমায় এখান থেকে বার করে নিয়ে যান!"
একবার একজন বলেই ফেলল, "কাল স্যার চোখ বুজলেই মনে হচ্ছিল পাশে কেউ বসে আছে। কেউ যেন আমার গায়ে হাত দিচ্ছে। ভয়ে সারারাত চোখ খুলে কাটিয়েছি। আমায় বের করে নিয়ে যান এখান থেকে।"
শুধু নীলরতন কেন, সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডেই লুকিয়ে থাকে প্রচুর অলৌকিক গল্প। আমার নিজের কলেজেও ছড়িয়ে আছে এরকম নানা গল্প।
আরো পড়ুন : পেন, স্ক্যালপেল, LIFE (তৃতীয় ভিজিট) / ঋতঙ্কর পাত্র
আমার এক জুনিয়র তার ইন্টার্নশিপে তখন গাইনি ডিপার্টমেন্টে ডিউটি করছে। অনেক সময় প্রেগন্যান্ট রোগীর ব্লাডপ্রেশার বেশী থাকলে প্রসব বেদনা ওঠার আগে খিঁচুনি হয়। মেডিক্যাল টার্মে একে বলে eclampsia। এসব পেশেন্ট সাধারণত খুব একটা বাঁচে না। তাই এদের বাঁচানোর জন্য আলাদা ICU বেড লাগে। ICU সেট-আপ লাগে। আলাদা রুম লাগে। সেখানে আমাদের ডিউটি পড়ত। সেখানেই আমার জুনিয়র একদিন দুপুরে হ্যান্ডওভার পায় এক খারাপ পেশেন্ট। তখন দুপুর ২টো। গাইনি ওয়ার্ডে আরো নানা কাজ করে সে ৩টে নাগাদ গিয়ে পেশেন্টকে নাম-ধাম এসব জিজ্ঞেস করে। পেশেন্ট দিব্যি তাকে সব বলে। সে ওই রোগী দেখে আরো বাকি রোগী দেখে নার্সের থেকে খারাপ রোগীর ফাইল চায়। নার্সের কাছ থেকে উত্তর আসে ওই পেশেন্ট তো আপনি আসার ৪০-৪৫ মিনিট আগেই মারা গেছে। হতবাক হয়ে সেই জুনিয়র আবার ছুটে যায় সেই রোগীর কাছে। দেখে রোগী মারা গেছে আগেই। হাত পা ঠান্ডা। পেশেন্ট পার্টিকেও জানানো হয়ে গেছে রোগী মারা গেছে।
আমার জুনিয়র সেদিন আর ডিউটি করতে পারেনি।
আরও পড়ুন : পেন, স্ক্যালপেল, LIFE (দ্বিতীয় ভিজিট) / ঋতঙ্কর পাত্র
আমরা সবাই জানি মেডিক্যাল সায়েন্সে আজগুবি বলে কিছু হয় না। সবকিছুর একটা বিজ্ঞানসম্মত কারণ থাকে। কিন্তু কিছু ঘটনা ঘটে যার কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। জানি না কারো কাছে এসবের কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা।
[লেখক নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক]
......................................
[কভার : অর্পণ দাস]
#বাংলা #ব্যক্তিগত গদ্য #পেন স্ক্যালপেল life #ঋতঙ্কর পাত্র