পেন, স্ক্যালপেল, Life (তৃতীয় ভিজিট)
তৃতীয় ভিজিট
প্রেম আর ভালোবাসার পার্থক্য কী? কোনওদিন সঠিক ভাবে কেউ বলে উঠতে পেরেছে? আমরা সবাই নানা ভাবে এর উত্তর খুঁজে যাই। বাঁধভাঙা বৃষ্টির দিনে কফির কাপ হাতে কাউকে মনে পড়লে সেটা কী প্রেম বলা চলে? নাকি অবারিত কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে একা দাঁড়িয়ে কাউকে আচমকা মনে পড়ে গেলে সেটাকে প্রেম বলে? আচ্ছা, হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে পচা ড্রেসিং, পুরনো বিটাডিন আর ফেলে দেওয়া পুঁজের মধ্যে কি আদৌ প্রেম-ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়?
বহুদিন আগে একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিল। পচে যাওয়া ডান পা। মোটামুটি গোড়ালির নিচে থেকে পা পচে সবুজ হয়ে গেছে। মহিলার রক্তে সুগার আকাশছোঁয়া। এর আগে দুখানা আঙুল বাদ দিতে হয়েছে। সেসবও পচে গেছিল। তারপর সুগার ঠিক হয়ে পা খানা ভালোই ছিল। এবারে আর দুখানা আঙুলে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এবারে গোড়ালির নীচে থেকে পুরো পা। যাই হোক, এরকম পচা পা দেখলেই আমার মাথাটা গরম হয়ে যেত। কারণ দিনরাত এক করে এসবের ডিব্রাইডমেন্ট করতে হত। ড্রেসিং করতে হত। প্লাস অসম্ভব বাজে গন্ধ। মানে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে এরকম গন্ধ। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই পা পচে যাওয়ার বিষয়টা ঘটত রোগীর নিজের প্রতি অবহেলায়। পায়ে হয়ত একটা ফোঁড়া হয়েছে। ভাবখানা এমন, ওটা আর কী দেখব! দুদিন পর দেখা যেত পা পচে একদম কালো। এই মহিলারও একই কেস। পা পচে শুধু কালো না, একেবারে সবুজ হয়ে গেছে।
ওঁর স্বামীকে ডাকা হল।
-"আপনি দেখেননি পায়ের এই অবস্থা?"
-"স্যার, আমি আসলে ছিলাম না। বাইরে গেছিলাম কাজে। এসে দেখলাম পায়ের এই হাল। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।"
মাথা গরম ছিল। বলেই দিলাম, " ভালোই হয়েছে এনেছেন। এবারে মহিলা যোগাড় করুন যিনি এখানে সারাক্ষণ ওঁর পাশে থাকবেন।"
-"কোথায় পাব স্যার? মহিলা তো কেউ নেই। বুড়ো-বুড়ি থাকি। ছেলে স্যার বাইরে থাকে।"
-"দেখুন সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না। এটা মহিলা ওয়ার্ড। পাশে একজন মহিলা না থাকলে আপনার পেশেন্ট কে বাড়ি নিয়ে যান। ইনসুলিন চলছে, এবারে সুগার ফল হলে দেখবে কে?"
-"এটা তো ঠিক বলেছেন স্যার। দেখছি আমি।"
"দেখুন, কালকের মধ্যে আমাদের একজন মহিলাকে চাই। নইলে..."
রাগের মাথায় বলা কথা হলেও, এগুলো হাসপাতালের নিয়ম। মহিলা ওয়ার্ডে একজন মহিলাকে থাকতে হবে সবসময়। সেইরকম পুরুষ ওয়ার্ডে একজন ছেলেকে।
পা টাকে ভালোমতো ডিব্রাইডমেন্ট করে ড্রেসিং করে পরদিন গিয়ে দেখি একজন মহিলাকে ঠিক হাজির করেছেন। আমি বেশ খুশি। যাক, কালকের ঝাড় কাজে দিয়েছে।
-"কাকে নিয়ে এলেন?"
-"স্যার পাড়ার এক মেয়েকে যোগাড় করেছি। পয়সাপাতি দিচ্ছি। থেকে যাবে বলেছে। আপনি স্যার কোনো ওষুধ লাগলেই বলবেন।"
-"সরকারি হাসপাতাল এটা। বাইরের কোনো ওষুধ আমরা লিখি না। যদি একান্তই লাগে বলে দেব।"
৩-৪ দিনের ড্রেসিং করার পরে পা একটু ভালো হয়। স্যার এসে বলেন, “আর কত ড্রেসিং করবি? VAC লাগিয়ে দে।”
এই VAC এক অদ্ভুত মেশিন। নিজে থেকে ড্রেসিং করে। পচা জায়গার পুঁজ, খারাপ রক্ত, খারাপ মাংস সব বের করে নিয়ে ওই পচা জায়গাটা আবার ঠিক করে দেয়। যন্ত্রটা সারাক্ষণ পেশেন্টের পায়ে লাগানো থাকে। ওটা নিয়েই সে খায় দায় ঘুমায়। ৭-৮ দিন পরপর খুলে দেখা হয় ক্ষতস্থান ঠিক হল কিনা। নইলে আবার ৭ দিন। তারপর ঠিক না হলে আবার ৭ দিন।
যাক। স্যার বললেন আর পরেরদিনেই VAC লাগিয়ে দেওয়া হল। সরকার থেকে বিনামূল্যে আসে। বাইরে কিনতে গেলে খরচা প্রায় এক লাখ। পেশেন্ট ভারি খুশি। রোজ আমার ছুরি-কাঁচির অত্যাচার সহ্য করতে হয় না। দিব্যি আরামে আছে। বর এসে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে, চুল বেঁধে দিচ্ছে, গা-হাত পায়ে হাত বুলিয়ে টিপে দিচ্ছে। সারাদিন, সারা সন্ধে থেকে রাতের বেলা বাড়ি যায়। আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা হয়। বউকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। কথায় কথায় জানতে পারি ওঁর বাড়ি, আমার বাড়ির কাছেই। আমাদের আর ওঁদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানও এক। ভারি অবাক হই।
এইরকম করে কেটে যায় এক সপ্তাহ। VAC খোলার সময় হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন মহিলার সঙ্গে থাকার লোক বা ওঁর স্বামী কারুর দেখা পাওয়া যায় না। এদিকে নতুন করে আবার VAC লাগাতে গেলে বাড়ির লোক কাউকে একটা লাগবেই। আর ওই পচা পা এখনও অতটা ভালো হয়নি। আবার মাথা গরম হয়। আসল দিনেই এদের পাওয়া যায় না। অগত্যা আমরাই পায়ে VAC লাগিয়ে দিই।
-"ঠাকুমা, দাদু কই? এল না যে? আর তোমার পাড়ার মেয়েটাই বা কই?"
-"জানিনা। খাবারও আসেনি আজ।" ঠাকুমার গলা শুনে মনে হল, খাবার নিয়েই বেশি ক্ষেপে।
তারপর দু-একদিন ভদ্রলোক আর আসেন না। মেয়েটাও হাপিশ। আমার আর সত্রাজিৎ -এর মাথা গরম হতে থাকে।
তিনদিন পর ভদ্রলোক একদিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। সত্রাজিৎ আর আমি উত্তম-মধ্যম দিই। ভদ্রলোক চুপ করে শোনেন। শেষে বলেই ফেলেন,"সত্যি আমি ভুল করে ফেলেছি ডাক্তারবাবু। আর হবে না এরকম।"
-"ঠিক আছে। রোগীর কাছে যান, আমরা গিয়ে কথা বলে নেব।"
-"একটা মুশকিল হয়ে গেছে স্যার। যে মেয়েটাকে রেখেছিলাম, সে আর এই খারাপ ওয়ার্ডে থাকবে না বলছে। আর কাউকে পাচ্ছিনা। মাসি রেখে গেলে হবে স্যার?"
-"হ্যাঁ নিশ্চই। মাসি রেখে দিন।"
দু'দিন কোথায় গায়েব ছিল সেটা আর জানা হল না আমাদের। গুরুত্ব দিলাম না। হয়ত গেছিল কোথাও একটা। কিন্তু কোথায় গায়েব ছিল সেটা জানলাম আরো দুদিন পরে।
সেদিন বাড়ি যাব বলে তাড়াতাড়ি রাউন্ডে এসেছি। ভদ্রলোক দৌড়ে এসে বলেন,"একটু ইসিজিটা দেখে দেবেন স্যার?"
খুব অবাক হই। পেশেন্টের ইসিজি তো করাতে বলিনি।
-"এটা কার ইসিজি?"
-"স্যার আমার।"
-"ইসিজি কেন করালেন?" বলে ইসিজি খুলে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এ তো স্পষ্ট ‘Acute myocardial infarction’, গোদা বাংলায় যাকে বলে হার্ট অ্যাটাক।
-"আপনার কি বুকে ব্যাথা হচ্ছে নাকি?"
-“স্যার একটু হচ্ছে চিনচিনে। ৩-৪ দিন আগে খুব হয়েছিল। ইসিজি করিয়েছিলাম ইমার্জেন্সি গিয়ে। দেখে বলল আমার নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল এখানে কার্ডিয়োলজিতে। তাই তো স্যার দুদিন আসতে পারিনি। কোনোমতে বুকে ব্যাথা কমতেই নিজে থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।" একনাগাড়ে কথা বলে লোকটা হাঁফাতে থাকে।
-"তা আপনি এটা সেদিন কেন বললেন না?"
-“কী করে বলি স্যার! আপনাদের কাজ তো দেখছি। দোষটা তো আমার ছিল।"
-"আপনি এখন আমি যা বলব তাই শুনবেন," আমি লোক ডেকে নিয়ে যাই ওনাকে ইমার্জেন্সি। কিন্তু বলা হয় আবার কার্ডিয়োলজিতে ভর্তির মত অবস্থা না। তবে অবশ্যই এবং অবশ্যই অবজারভেশনে থাকতে হবে।
ওনাকে বলি, "আপনি বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিয়ে নিন।”
-"কে রাখবে স্যার অবজারভেশনে? বাড়িতে কেউ নেই। এখানে থাকা যাবে না। বাড়িতে থাকলেও তো সেই এক ব্যাপার। আমি আসব স্যার। আর বউকে বলবেন না আমার এসব হয়েছে।"
-"সে থাকুন। কিন্তু ওয়ার্ডের মধ্যে আপনার কিছু হলে কে দেখবে?"
-"কিছু হবে না স্যার। হলে উপরে যাব। নইলে কার্ডিয়োলজিতে," হেসে ফেলেন ভদ্রলোক।
সত্রাজিৎকে ফোনে বলি আমি। শুনে দৌড়ে আসে। সরি বলে। ভদ্রলোক পা ধরতে যান, "কী যে বলেন স্যার!"
আমরা ঠিক করি ভদ্রলোককে আর খাটাব না। নিজেরাই যতটা পারি করব। এর মধ্যে তৃতীয়বারের জন্য VAC বসে। আমরা খেটেখুটে সব কাজ করে দিই। ইন্টার্ণরা রোজ সকালে এসে দাদুর সাথে কথা বলে। ঠাট্টা তামাশা চলে। বুড়িকে আমরা কিছু বলি না স্বামীর ব্যাপারে।
তিন নম্বর VAC যেদিন খোলা হল, দেখা গেল পা তখনো ৪০% বাকি ঠিক হতে। সেদিন বুড়ি বেঁকে বসে। তার আর হাসপাতালে থাকা ভালো লাগছে না। তার ছেলে নাকি এসেছে দিল্লি থেকে। সেখানে সে কাজ করে। ছেলের জন্মদিন দু দিন পরে। তাই বাড়ি যাবে।
তার ছেলে আসে আমাদের সাথে দেখা করতে। সে মাকে জোর করে হাসপাতালে থেকে যেতে। বুড়ি কথা শোনে না। জোর করে সে ছুটি নেবেই। যাই হোক, কেউ হাসপাতালে না থাকতে চাইলে কী আর করা যাবে।
ছুটির দিন বুড়িকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, "এতদিন তো ঠিক ছিলে। হঠাৎ কী হল?"
-"আমার স্বামীর না শরীর ঠিক ভালো নেই বুঝলেন তো। কদিন ধরে দেখছি। ও তো আমায় বলবে না। আমি ঠিক বুঝে যাই। আমি আর থাকব না এখানে।"
স্তম্ভিত হয়ে যাই। কেউ তো বলিনি আমরা। বুঝল কী করে?
ছোটোবেলায় তেতো ওষুধ খেতে হবে বলে আমি মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতাম গায়ের জ্বর। ছলছলে চোখ আর শুকনো মুখ দেখে মা ঠিক ধরে ফেলত। এটাও তাহলে সেই বস্তু? সেই ম্যাজিক? লোকে যার নাম দিয়েছে ভালোবাসা?
-"আমার কাছে লুকানো সোজা না, বুঝলেন ডাক্তারবাবু।" বুড়ি হেসে ফেলে।
আমিও হেসে ফেলি। ছুটি লিখে দিয়ে আসি। বুড়ো হেসে বলেন, "অনেক ধন্যবাদ স্যার।"
আরও পড়ুন : পেন, স্ক্যালপেল, LIFE (দ্বিতীয় ভিজিট) / ডাঃ ঋতঙ্কর পাত্র
এর প্রায় পাঁচ মাস পরে একদিন একজন ইন্টার্ন এসে আমাদের বলে, তোমাদের দুজনকে একজন লোক খুঁজছে। কে খুঁজছে বলাতে বলল, “জানি না। আগে কোনওদিন দেখিনি।”
আমরা যাই। দেখি সেই ভদ্রলোক।
আমাদের দেখে হাত নাড়েন, "আপনাদের জানাতে এলাম। আমার স্ত্রী এই ৪-৫ দিন হল মারা গেছেন। কিডনিটাও বিকল হয়ে গেছিল। শান্তিতে যেতে দিলাম।"
আমরা কী উত্তর দেব বুঝে পাইনা। চিরকালই কারোর মৃত্যুসংবাদ এলে আমি বুঝে পাইনা কি বলব।
-"সরি! আমরা খুব..."
-“কী যে বলেন স্যার! আপনারা তখন এত করেছিলেন। ভুলে যাওয়া যায় আপনাদের? আপনাদের তাই জানিয়ে যাওয়াটা আমার কর্তব্য মনে করলাম স্যার। আর আপনাদেরকে জ্বালাব না।" হেসে ফেলেন ভদ্রলোক।
-"আর আপনি কেমন আছেন? আপনার হার্ট?"
-"একদম সুস্থ সবল স্যার। আপনারা ভালো থাকবেন।"
-"একদম। আপনিও ভালো থাকবেন।"
মাথায় টুপি পরে ভদ্রলোক চলে যান।
আমাদের সেদিন ২৪ ঘন্টা ডিউটি। আমরাও আবার নিজের কাজে চলে যাই। আর এভাবেই ভালোবাসারা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকে। এভাবেই ভালোবাসারা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই আমরা মৃত্যুর পরেও লোকজনকে ভালোবেসে ফেলি। এভাবেই, মৃত্যুর পরেও লোকজন বেঁচে থাকে আমাদের মধ্যে।
[লেখক নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক]
..........................
[কভার : অর্পণ দাস]
#বাংলা #গদ্য #ব্যক্তিগত গদ্য #পেন স্ক্যালপেল Life