মায়াজমিনের রূপকথা
বইয়ের খবর: ‘হেমন্তের অন্নপূর্ণা’ - বেবী সাউ প্রকাশক: প্রতিভাস প্রথম প্রকাশ: আগস্ট ২০১৯ প্রচ্ছদ: সুদীপ্ত দত্ত দাম: ১০০ টাকা
আমজনতার সাধারণীকরণ-বৃত্তি চিরন্তন। অচেনাকে চিনতে আমাদের চিরকালের অনীহা। কিংবা ভয়। মানুষ হোক, বা সৃষ্টি হোক, বা সম্পর্ক –সর্বদাই সমস্ত কিছুকে আমরা ফেলে দিতে চাই পূর্বপরিচিত কোনও কাঠামোয়। স্বস্তি পেতে চাই, নিশ্চিন্ত হতে চাই, নিরুত্তাপ গতানুগতিকতার নির্বিকার আশ্বাসে। এমনই পাকেচক্রে বাংলা কবিতার বাজারে জীবনানন্দ পেয়ে যান ‘হেমন্তের কবি’র তকমা। কিন্তু তাঁর নিবিষ্ট পাঠকের কাছে এ অভিধা তার আপাত সারল্যকে ছাপিয়ে উন্মোচন করে এক ক্লান্ত, বিষণ্ণ, জটিলতাময় কথকতা। কার্তিকমাঠ আর অঘ্রান-প্রান্তরের আখরে যার নির্মাণ। হেমন্তের অনুষঙ্গে স্নিগ্ধ-রূপবিভোর, অথচ রিক্ততার কানায় দোলায়িত মনের অন্ধিসন্ধি উন্মোচন করে বাংলা কবিতার জগৎকে জীবনানন্দ দাঁড় করিয়েছিলেন একেবারে নতুন এক দিগন্তের সামনে। সেই আশ্চর্য ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকেই যেন আত্মস্থ করেছে বেবী সাউয়ের বই – ‘হেমন্তের অন্নপূর্ণা’।
এটি কবির ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। পূর্বে প্রকাশিত ‘গান লেখে লালনদুহিতা’, ‘ছয় মহলা বাড়ি’, ‘একান্ন শরীরে ভাঙো’ প্রভৃতি কবিতাগ্রন্থের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় ঘটেছে, বেবীর কবিতার শব্দ-সংযম, আঙ্গিক সচেতনতা, স্বল্পকথনের শৈলীতে বোনা অনুভবের গভীরতা সম্বন্ধে তাঁরা ওয়াকিবহাল। এই বইয়ের শৈলীও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনানন্দ-পাঠকের কাছে যে হেমন্ত ঋতু শূন্যতা ও পূর্ণতার যৌথ উদযাপনের দিকচিহ্ন তৈরি করেছিল, এখানে সে ঋতুকেই আমরা দেখব, আরও একবার, তার স্বকীয় মহিমায়।
আরও পড়ুন : উৎপলকুমার বসুর গদ্য সংকলন ‘সদাভ্রাম্যমাণ’
হেমন্তের পাকা ধান কেটে নেওয়ার পর পড়ে-থাকা খেতে একইসঙ্গে লেগে থাকে শূন্যতার হাহাকার আর পরিণতির সুখ, শান্তি, তৃপ্তি। এ হেন স্ববিরোধকে কাব্যিক সুষমায় ফুটিয়ে তুলেছেন বেবী সাউ। এ কাজে তাঁর অনিবার্য সহায়ক হয়ে উঠেছে কৃষিক্ষেত্র ও কৃষিসভ্যতালগ্ন অজস্র ইমেজ। যেমন,
*… ক্ষুধা তবু পেতে আছে হাত
দোনাভর্তি শস্যখেত; …
কোথায় ভাতের গন্ধ
কোথায় বা পোকাধরা রেশনের চাল
(‘লোকগান’)
*মিছিল পেরিয়ে হাঁটে ধূসর পৌষের মাঠ
(‘কালী’)
*প্রকৃত কুশল জানো।
বিনিময়ে খসে যায় পাকা ধান
… পথে পথে ফেলে যাওয়া কৃষিখেত হেমন্তের বন সেই
(‘লক্ষ্মী’)
*বিনীত গমের ছায়া। মুহূর্তের অসামান্য দাগ
মধ্যবিত্ত ধানখেত
আলপথ ভেবে নিজেকে বাঁকায়
(‘ম্যাজিক’)
*অনুবাদে ভরে ওঠে ফলনের কথা
ফুটিফাটা মাঠ, খেত, ক্ষমতার লোভ
ইঁদুরের ঘরে যায় কাটা মন আরও
(‘কৃষি’)
*মাঠ থেকে সব ধান উঠে যায় দরবেশি রাগে
হেমন্ত প্রণাম রাখে গোধূলির বিষণ্ণ ধুলোয়
দৃশ্যের জানলা ভেঙে যেমন পথিক একা একা
দিগন্তের লোভে ছোটে মাঠবেশী ইঁদুরের ক্ষত
প্যাঁচার ডাকের স্রোতে ভেসে যায় সমসাময়িক
ছোটো মেয়ে ধান দেয় পোষা দুটি হাঁসেদের ঠোঁটে
(‘কবিকে…’)
*শীত শেষে খোঁড়া হয় পরিত্যক্ত কৃষিভূমি
ইঁদুরের দেহ
রাজকোষ ফুলেফেঁপে ওঠে
(‘আত্মহত্যা’)
*ঝড় এলে উড়ে যায় চাল, শস্য, তাও বলি – ‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল’
যেভাবে বানের জলে ভাসে কৃষিকাজ
কৃষকের মন ভাবে প্লাবিত এ মাটি
অধিক ফলন সুখে (‘পরিব্রাজিকা’)
‘কৃষি’, ‘নবান্ন’, ‘হেমন্তের অন্নপূর্ণা’ প্রভৃতি কবিতার নামকরণেও কৃষিলগ্ন রূপকগুলি স্পষ্ট। পাশাপাশি এই কাব্যগ্রন্থের শরীরে মিশে গেছে গ্রামজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা লোকঐতিহ্য, লোকাচার, লোকসাহিত্য, সংস্কার। বারবেলা, নিশিডাক, ইষ্টনাম, মানতের সুতো, তাবিজ, মাদুলি, কুমারী চালিশা, সিঁদুরদাগ, তুলসি, তেলহলুদের জল, লক্ষ্মীর পাঁচালি, কোজাগরি রাত, অন্নদামঙ্গল, মহানিমগাছ, সুপারি বন, রূপশালি মেঘ, ডহরি জঙ্গল, বাতাবিলেবুর গ্রাম, মহুলডাংরির মাঠ, মধুডাঙাতীর, হাঁসেদের উদ্দেশে চই চই ডাকে কবি বুনে তোলেন এক ভিন্নতর জগৎ। স্মৃতিমেদুর। পরিচিত হয়েও যেন ঈষৎ রহস্যমাখা। শহুরে যাপন থেকে বহু দূরে চলকে পড়া মায়াজমিনের রূপকথা।
*বর্শার ফলকে কারা রেখে গেছে তামাম সিঁদুর
সব এয়োতির দল আঁচলে ভরেছে
পাথরের জলরেখা
শ্রাবণের দিনে তারা নদীকে কাঁদাবে
(‘ভাসান’)
কবি কখনও কখনও লৌকিকের সঙ্গে মিশিয়ে দেন মহাকাব্যিককে। শমীবৃক্ষ বা ক্রৌঞ্চডাকের উল্লেখে তৈরি হয় সেই মহাকাব্যিক পরিসর। হেমন্তের অনুষঙ্গ বজায় রেখেই এ বইয়ে উঠে এসেছে সম্পর্কের টানাপোড়েন আর জটিলতার কথা। তৎসংলগ্ন রক্তক্ষরণের কথাও।
*অতঃপর ভাঙনের শব্দ গাঢ় হয়
সমস্ত বিশ্বাস মিশে যায় বালির
ধুলোয়
(‘বিসর্জন’)
*আলোচনা ছেড়ে আসে গতজন্ম
বিরহ বিধুর
করতল পেতে বলে, ভালবাসি
ঘৃণার মতন
(‘মাথুর’)
*এসব ভাবের ঘরে গিয়ে তুমি
সেই যে বোঝালে রক্তযাপনের কথা
লোভাতুর জনগণ তারপর থেকে দেখা গেল
রক্তজবার বাগান রোপণ করেছে
রাতারাতি
(‘কালী’)
*হরণের অধিকার
জেনে
চুপ থাকে কৃষক-বউ;
চুপিসাড়ে ইতুঘট পাতে
(‘আত্মহত্যা’)
*দিতে তো পারিনি কিছু। শুধু বলে গেছি ‘থেকে যাও’
এই গৃহকোণ, ছাদ, অভিসারপথ শূন্য ভেবে
তুমিও নির্মম।
ভাঙো জমে-থাকা বিস্মৃতি অতল
লাজরক্ত ঢেলে দিয়ে
সমস্ত নির্দেশ ভেঙে একা হেঁটে যাও বিবাহ উৎসবে
(‘লগ্ন’)
এ বইয়ে একাধিকবার উঠে এসেছে ঈশ্বর বিষয়ে কবির নানামাত্রিক অনুভব। লোকগান কবিতায় ক্ষুধার্ত মানুষের দলই যেন কবির ঈশ্বরে পরিণত – ‘অসংখ্য ঈশ্বর হাঁটে শিকারের লোভে/পা-ছাপে নিশানা ফুটে ওঠে রোজ’। আবার ‘ঈশ্বর’ কবিতায় শিরোনামেরই অনুরণন রেখে কবি যখন বলেন ‘বেঞ্চের ওপরে মাথা রেখে/ঘুমিয়ে পড়েছে/ মেয়েটির চোখে বিন্দুবৎ’, তখন পাঠককে মুগ্ধ হতে হয় বৈকি! ‘বুদ্ধ’, ‘সুজাতা’, ‘শ্রমণ’, ‘ভিক্ষু’ প্রভৃতি শব্দের পুনরাবৃত্ত প্রয়োগে বৌদ্ধধর্ম-অনুষঙ্গ এ বইয়ের কোনও কোনও কবিতাকে বিশেষ মাত্রা দেয়।
আরও পড়ুন : লাল পিঁপড়ের বাসা : রাণা রায়চৌধুরী
এখানে বেবী সাউয়ের প্রতিটি কবিতাই পরিমিত। সংযত। মিতবাক। কোথাও অতিকথন নেই। এ কাব্যগ্রন্থ খোলার পরেই স্পষ্ট হয় - নৈঃশব্দ্যের তর্জনীসংকেতে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত করা যায় শব্দব্যবহার, কবির অধিগত আছে সেই কৌশল। কবিতাগুলি সমাপ্তিতে রেখে যায় তীব্র অভিঘাত। হাতে গোনা কয়েকটি শব্দমাত্র। সেটুকু পরিসরেই ঝলসে ওঠে তাঁর কলম। যেমন,
*তবুও নিশ্চিত হবে এই ফেরা, অপেক্ষায়
নিজেকে সাজাই রোজ
যেন অন্নপূর্ণা
(‘নবান্ন’)
*আলোচিত সংবাদ জুড়ে
কেবল ফিরেছে ঘর
এবার লক্ষ্মীটি, ঘরে ফেরো
(‘রুকস্যাক’)
এ বই সম্পর্কে এর চেয়ে অধিক বিস্তার অবান্তর। কবিতা-বিষয়ক আলোচনা-সমালোচনার জালে কখনোই ধরা যায় না কাব্যের ব্যাপ্তি, বিষণ্ণতা বা গহিন মাধুর্যকে। কবিতা পাঠকের শ্রদ্ধা ও অভিনিবেশ উভয়ই দাবি করতে পারে ‘হেমন্তের অন্নপূর্ণা’ – এটুকু কথা বলেই তাই ইতি টানা যায় এই আলোচনার। পরিশেষে আগ্রহী পাঠকের জন্য রইল এই বইয়ের রমণীয় উৎসর্গপত্রটি –
“অধিক ভেবে তোমার দিকে হাঁটি
ছায়ার মতো… লম্বা, প্রকাশিত…
অধিক ভেবে তোমায় ছুঁয়ে থাকি
নিপুণ তুমি
নিজেই নিজে বাজো…”