লাল পিঁপড়ের বাসা : রাণা রায়চৌধুরী
কাব্যগ্রন্থ : লাল পিঁপড়ের বাসাকবি : রাণা রায়চৌধুরীপ্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০০২প্রকাশক : দাহপত্র
কবিতাগুলির রচনাকাল : ১৯৯৮ থেকে ২০০১
আমাদের ব্যবহৃত কপি - দ্বিতীয় সংস্করণ, বইমেলা ২০১৪প্রকাশক : নাটমন্দিরপ্রচ্ছদ : জিশান রায়মূল্য : ৬০ টাকা
দশকের প্রথাগত হিসেব ধরলে রাণা রায়চৌধুরীকে বলতে হয় নয়ের দশকের কবি। অসম্ভব শক্তিশালী একজন কবি তিনি। সেই তুলনায় অনালোকিত। বাজার তাঁকে চেনেনি। তিনিও বাজার চিনতে যাননি। তথাকথিত ‘ছোটো’ পত্রিকাতেই রাণা বেশি লিখেছেন, এখনও তাই লেখেন। তবে তাঁর নিষ্ঠ পাঠকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ‘একটি অল্পবয়সী ঘুম’ (১৯৯৬), ‘শরীরে সন্দীপন নেই’ (১৯৯৮), ‘বুনো গাধার ডাক’ (২০১০), ‘বাংলাভাষার মাদুর’ (২০১২)। গদ্যের বই ‘রঙ ও দাগের কাটাকুটি’ (২০১১), ‘পাগলদের বাড়ি’ (২০২০), ‘রাণার কথা’ (২০২০)। গল্পগ্রন্থ ‘দ্রাবিড়ের ভাঙা উইকেট’ (২০২০)।
এটি রাণার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। চার ফর্মার ক্ষীণতনু বই। মোট ষাটটি কবিতা। প্রবেশক কবিতাতেই রাণা স্পষ্ট বলে দেন তিনি ‘আউটসাইডার’। ফলে যা যা আছে, আর যা যা আছে বলে ভাবা হচ্ছে, সবই মায়ামাত্র -
জেল খাটতে এসেছিজেল খেটে চলে যাব একদিন... ... ... ...এইখানে, যা কিছু পেয়েছিএসব আমার নয়এই ঘটি- থালা, ফুলের সাজি - আমার নয়এই যে চমৎকার ফাঁসের দড়ি - আমার নয়এই যে শরীরভর্তি বিবাহ, আমার নয়তুমি শুধু ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছ;তোমার দেওয়া গণ্ডারের চামড়া,তোমার দেওয়া অভিশাপের আলোকয়েকদিন নাড়াচাড়া করে চলে যাব -রুগ্নশিল্প তোমার, গানবাজনাও তোমারকয়েকদিন নাড়াচাড়া করে চলে যাব... ।
কবিতাগুলি থেকে উঁকি মারে অপ্রেম, ব্যর্থতা, আত্মধিক্কার । উঁকি মারে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বিপন্ন আনাচ-কানাচ। ভীরু যৌনতা একান্তে মুক্তির বাসনা খোঁজে। কবিতায় বিশেষ রাখঢাক রাখেন না রাণা। শরীরবোধের অনিবার্যতার কথা অকপটে স্বীকার করেন বারবার –
শরীর কি মরুভূমি? শরীর কি খবরের কাগজ?যে পড়ে ফেলে দেব?”(কলকাঠি)
‘হাসি পায়’, ‘কষ্ট’, ‘কষ্ট ২’, ‘যুবক’, ‘হরিধ্বনি’-র মতো কবিতায় একরকম প্রচ্ছন্ন নৈরাজ্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে, নিজের অক্ষমতাকে নিয়ে হাসাহাসি করা ছাড়া একজন সৎ শিল্পীর কি সত্যিই আর কোনও সম্বল আছে? আমরা জানি হাসি অনেকসময়েই অসহায়তা, অনেকসময় ব্যঙ্গ কিংবা অস্বীকার। আবার হাসি অনেকসময় নৈরাজ্যও। ‘হাসি পায়’ কবিতাটি যেমন –
পার্টি অফিস দেখে হেসেছিলাম বলে আমি একবার মার খেয়েছি,কবিতা উৎসব দেখে হেসেছিলাম বলেএক মৌলবাদী আমাকে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছিল।সোনাগাছি গিয়ে তো তুমুল হাসি, মেয়েগুলো জল ঢেলে দিয়েছিলকি ভাগ্যিস পার্লামেন্ট দেখিনি এখনো...।
‘ঝিয়ের সৌন্দর্য’ একটি আশ্চর্য কবিতা। মধ্যবিত্ত মিডল এজ ক্রাইসিস মূলত কামতাড়িত, তবে শুধুই লিবিডো দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করলে একদেশদর্শিতা হয়ে যাবে। এই কবিতায় তীব্র, অসহ্য অবদমিত কামনার আড়াল থেকে খুব সূক্ষ্ম এক অন্যতর বিচ্ছুরণ চোখ এড়িয়ে যায় না –
ওগো তুমি এতদূর রমণী হলে কবে?কামুক ব্যাটাছেলে তোমাকে ধ্বংস করতে পারেনিসেনাবাহিনী গুলি চালালেও তোমার ‘পাখির নীড়’ভেঙে পড়বে না কিছুতেইআর তুমি ভেঙে তছনছ হবে না বলেইআমি বেঁচে যাব আরও কিছুদিনকী ভাগ্যিস তুমি বাসন মাজতে আসো আমাদের বাড়িতুমি পেখম ছড়িয়ে হাঁড়ির কালি তোলোআর আমি প্যান্টশার্ট পরে একা হয়ে যাই।
ঈশ্বরের কথা যেখানেই এসেছে, এসেছে খুব তির্যক ভঙ্গিমায়। তবু সন্দেহ হয় ভিতরে ভিতরে রাণা সত্যিই ঈশ্বরবিশ্বাসী। ‘মূর্খ’ এমন একটি কবিতা যাকে ইচ্ছে করলে পাঠক ‘প্রেম’ বা ‘পূজা’ যে কোনও পর্যায়ে ফেলতে পারেন।
তোমার প্রবল হাওয়ায়আমার ইশারা ভেঙে যাচ্ছেছিঁড়ে যাচ্ছে পালআমার নৌকো তোমাকে পার হতে পারছে না...তোমার প্রবল ইঙ্গিত, আমি মূর্খ হয়ে যাচ্ছিতুমি ঢেউ, আমি অল্পস্বল্প মাঝি।
প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কথা এখানে দুটি কবিতায় এসেছে। রাণা প্রণবেন্দুর বিশেষ অনুরাগী। ‘জীবাত্মা পরমাত্মা’য় তো একেবারে নিঃশেষে আত্মনিবেদন জানিয়েছেন। প্রণবেন্দুর স্বরক্ষেপের সঙ্গে রাণার বাক্যবিন্যাসের মিল নেই অবশ্য। রাণার স্বরক্ষেপে ব্ল্যাক কমেডিজাতীয় এক মেজাজ রয়েছে। আড্ডার ছলে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে ডার্ক হয়ে যান তিনি, এবং সেটা ঘটে খুবই মসৃণভাবে। ‘বৃদ্ধাশ্রম ২’ কবিতাটি যেমন -
বল চুক্কি মারছে লাথিকেলাথি চুক্কি মারছে বলকেতুমি লাথি আর চুক্কির দিকে তাকিয়ে আছতুমি সজাগ হয়ে উঠছো লাথির প্রতিদূরে তোমার ঘোড়া - সেক্স নেই –নির্জীব - ঘাস খাচ্ছে আকাশরেখায়...।
একইসঙ্গে আত্মরতি আর আত্মহননের সুর জাগিয়ে রাখেন তিনি অবলীলায়। এ বছর বইমেলায় নাটমন্দির প্রকাশ করেছেন রাণার কবিতাসংগ্রহ। কেমন বিক্রি হয় জানিনা। নিজেরা নিয়মিত কবিতা লেখেন না, বাংলা কবিতার এমন কোনও নিয়মিত পাঠকও নেই। মূলত কবিরাই একে অন্যের কবিতা পড়েন।
এমনই একটা সময়ে আমরা বাস করছি যখন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাই বাতুলতা, জানি। তবু, রাণা রায়চৌধুরীকে বৃহত্তর পাঠক চেনেন না, এই সত্যকে আমি এতদ্বারা অভিশাপ দিতে চাই।
#বইয়ের খবর