মিশিও কাকু : আধুনিক বিজ্ঞান-সাহিত্যের প্রবল জনপ্রিয় এক নাম
আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, যদি বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বকে স্কুলের বাচ্চাদের বোঝানো না যায়, তবে সে তত্ত্ব মূল্যহীন (if a theory cannot be explained to a child, then the theory is worthless)। কথাটা ভেবে দেখার মতো। বিজ্ঞানের যে কোনো তত্ত্বকেই স্কুল-স্তরের বাচ্চাদের কাছে বোধগম্য করে তোলার মতো করে উপস্থাপিত করবার একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়া উচিত, সব দেশেই। আর এই কাজে পাঠ্যবই যথেষ্ট সহায়ক না হয়ে উঠলে এগিয়ে আসা উচিত বিজ্ঞান-লেখকদেরই। এই কথাটাকে প্রায় আত্মস্থ করে নিয়ে সেই কাজে যাঁরা নিয়োজিত করেছেন নিজেদের, তাঁদের মধ্যে প্রথম দিকেই নাম আসা উচিত মিশিও কাকু-র। না, ইনি আমাদের পাড়ার সুবল কাকুর কেউ হন না; ইনি আদতে আমেরিকার এক দারুণ বিখ্যাত বিজ্ঞান-লেখক অধ্যাপক। একাধিক বই লিখে, জনপ্রিয় বক্তৃতা দিয়ে, ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে (এবং বিজ্ঞান-গবেষণা করে তো বটেই) এখন ইনি বিজ্ঞান-জগতের একজন নামী স্টার। আজ তাঁর জন্মদিন।
ছোট থেকেই তাঁর ভালোবাসা বিজ্ঞানের প্রতি। ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলে পড়বার সময়েই তিনি বাড়ির গ্যারেজে বানিয়ে ফেলেছিলেন একটি আস্ত ‘পার্টিকেল অ্যাকসিলেটর’। সে এমন এক যন্ত্র, যার মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে ক্ষুদ্র কণাদের বেগ বাড়িয়ে তোলা যায় অনেকটাই। ছোট থেকেই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই পড়ে সময় কাটত তাঁর। টাইম ট্র্যাভেল, সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা বিগ ব্যাং— যেন হারিয়ে যেতেন বিজ্ঞানের এরকম সব হরেক বিস্ময়ভরা জগতের অলিতে-গলিতে। তারপর যখন বড় হলেন, বুঝলেন টাইম ট্র্যাভেল জাতীয় বিষয়গুলোকে আপাতত সরিয়ে রেখে বিজ্ঞানের যে প্রকোষ্ঠে ঢুকলে এ ধরনের বিষয়গুলোকে আরও বেশি করে দখলে আনতে পারবেন, সেটা একমাত্র ফিজিক্স, বা পদার্থবিদ্যা। যে বিষয়টাকে গভীরে গিয়ে অধ্যয়ন না করলে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কী ধরনের বদল আসতে চলেছে, তা নিয়ে বেশি দূর এগোনোই যাবে না। আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে লেখা সায়েন্স ফিকশন যত আকর্ষণীয়ই হোক, বিজ্ঞানের দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে না পারলে তা নিয়ে বেশি চর্চা করা সম্ভবই না।
সুতরাং মিশিও কাকু নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন আধুনিক পদার্থবিদ্যার জটিল জগতে, সেই সঙ্গে ভালো করে শিখলেন উচ্চ গণিতও। আর ওই সময়টায় তাঁর সামনে প্রকাণ্ড ইনস্পিরেশন হয়ে এসে দাঁড়ালেন আধুনিক বিজ্ঞানের মহানায়ক— আলবার্ট আইনস্টাইন। মিশিও কাকুর সেই দিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন তাঁদের ক্লাসে এসে শিক্ষক জানালেন, আইনস্টাইন তাঁর সবচেয়ে বড় আবিষ্কারটি সম্পূর্ণ করবার আগেই প্রয়াত হয়েছেন। সেটা ১৯৫৫ সালের কথা। আইনস্টাইনের সেই আবিষ্কার, যাকে সবাই জানেন ‘থিওরি অব এভরিথিং’ নামে, ওই সময় থেকেই লাইব্রেরিতে সে বিষয়ে বইপত্র খুঁজতে শুরু করেন মিশিও। অন্যদিকে মিশিওর পরিবারের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো না, তবু তাঁরা তাঁর এই উৎসাহকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো করেনইনি, বরং বাড়িতে যাতে তিনি নিজের মতো করে বিজ্ঞানের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাতেকলমে করে দেখতে পারেন, সে সুযোগ করে দিয়েছেন।
হাই স্কুলে পড়বার সময়েই মিশিও একটি অ্যাটম-স্ম্যাশার বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন। অত অল্প বয়সেই মিশিওর যন্ত্রনির্মাণের দক্ষতা এতটাই পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল যে তাঁর ওই যন্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে কুড়ি হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলা যেত! এই যন্ত্রটি ন্যাশনাল সায়েন্স ফেয়ারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এমনকি বিখ্যাত পদার্থবিদ এডওয়ার্ড টেলার সাহেব এসে যন্ত্রটি দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরই আগ্রহে হার্ভার্ডে মিশিও পড়বার সুযোগ পেয়ে যান। পরে তিনি হার্ভার্ড থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
২/
‘থিওরি অব এভরিথিং’, বা সর্বব্যাপ্ত তত্ত্ব বলতে পারি যাকে, তার মূল উদ্দেশ্য আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বের সঙ্গে কোয়ান্টাম তত্ত্বের মিলন ঘটানো। প্রথমটার কাজকারবার মহাবিশ্বের প্রকাণ্ড সব বস্তুদের গতিবিধি নিয়ে, দ্বিতীয়টা আবার পদার্থের একেবারে গহীন অঞ্চলে গিয়ে খুঁজে দেখতে চায় সেখানকার রহস্যকে। এই দুইকে মেলানোর ওই প্রক্রিয়া আইনস্টাইন তাঁর জীবদ্দশায় পারেননি, তাঁর পরে অনেকে সে চেষ্টা করেছেন, এখনও করছেনও।
এরকমই একটি আধুনিক তত্ত্ব হল স্ট্রিং থিওরি। আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী অশোক সেন এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিচিত নাম। আর স্ট্রিং তত্ত্বে ধরেই নেওয়া হয় যে এই মহাবিশ্ব আসলে এক না, একাধিক; এবং এবং আমাদের পরিচিত চার-মাত্রার বাইরেও রয়েছে আরও বহু মাত্রা। মিশিও কাকুর উচ্চস্তরের পড়াশুনো এবং কাজকর্ম এটা নিয়েই। স্ট্রিং তত্ত্বের মধ্যেই স্ট্রিং ফিল্ড থিওরি নামে আলাদা একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন : জন মিশেল : যিনি প্রথম বলেছিলেন ব্ল্যাক হোলের কথা / অর্পণ পাল
প্রিনস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার পর এখন নিউ ইয়র্কের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান পঁচাত্তর বছরের মিশিও। বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে গেলে আগে বেছে নেওয়া উচিত একজন রোলমডেলকে। বাস্তব জগতের কোনো বিজ্ঞানীর সঙ্গে সরাসরি মেলামেশা করতে পারলে তো সবচেয়ে ভালো। একজন আসল বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথাবার্তা বলার মধ্যে দিয়ে নিজের যে উন্নতিটা হয়, সেটার বিকল্প হিসেবে তিনি বেছে নিতে বলেন বিজ্ঞানীদের জীবনীকে। নিজের জীবনের গতিপথকে ঠিক কোন দিকে বইয়ে নেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে এঁরাই সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন।
আরও পড়ুন : চার্লস থমাস উইলসন আর তাঁর মেঘকক্ষ / অর্পণ পাল
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় জনপ্রিয় বিজ্ঞানে তাঁর প্রথম বই ‘হাইপারস্পেস’। এরপরে গত কয়েক বছরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ন-টি বই। এর মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি ‘বিয়ন্ড আইনস্টাইন’, ‘প্যারালেল ওয়ার্ল্ডস’, ‘দ্য ফিউচার অব দ্য মাইন্ড’, ‘ফিজিক্স অব দি ইমপসিবল’, ‘ফিজিক্স অব দ্য ফিউচার’। নাম দেখে বোঝাই যাচ্ছে, আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময় তাঁর লেখায় মুখ্য উপজীব্য হিসেবে ফুটে ওঠে। তাঁর লেখা যেমন সহজ, তেমনই সুখপাঠ্য। আমরা এই বিজ্ঞান-লেখকের জন্মদিনে তাঁকে জানাই অনেক শুভেচ্ছা।
....................