নিবন্ধ

জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (চতুর্থ পর্ব)

অর্পণ পাল April 6, 2024 at 4:36 am নিবন্ধ

..................

 পর্ব ৪। কলকাতায় নিবেদিতা: সূচনাকালের কর্মকাণ্ড 

নিবেদিতা-জগদীশচন্দ্র: সম্পর্কের দিকনির্দেশ 

স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ভারতে এসেছিলেন বটে মার্গারেট নোব্‌ল, কিন্তু আস্তে-আস্তে তিনি জড়িয়ে পড়লেন কলকাতা-কেন্দ্রিক শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আরও নানা ক্ষেত্রের সঙ্গে। এখানে এসেই তিনি বুঝেছিলেন যে শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে রয়েছেন ব্রাহ্মরাই, অনেকটা সেই কারণেই কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশতে লাগলেন তিনি, পরে অবশ্য সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রটাকে আরও বেশি প্রশস্ত করে দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিলেন। 

        ব্রাহ্মসমাজের আলোকপ্রাপ্ত নারীদের সঙ্গে মিশতে গিয়েই তাঁর আলাপ হয় রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবীর সঙ্গে, এর কিছু আগে আলাপ হয়েছিল লাবণ্যপ্রভা বসুর সঙ্গে, এবং তাঁরই সূত্রে তিনি জগদীশচন্দ্রের জীবনে প্রবেশ করেন। এরপরে দ্রুতই জগদীশচন্দ্র ও অবলা দেবীর সঙ্গে বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাঁর। যে ঘনিষ্ঠতা স্থায়ী হবে নিবেদিতার অকাল-প্রয়াণ পর্যন্ত। 

        অন্য দিক থেকে দেখলে গবেষণা-জীবন শুরুর পর থেকে যে কয়জন মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে জগদীশচন্দ্রের জীবন-কর্মকাণ্ড আর মানসিক গড়নে, তাঁদের মধ্যে নিবেদিতার নাম প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই থাকবে। নিবেদিতার সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্কের এই চলন একরৈখিক নয়, এবং তাকে কোনও সূত্রে বা গোত্রে ফেলা চলে না। চিকিৎসক ও সুলেখক দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত নিবেদিতা আর জগদীশচন্দ্রের মধ্যেকার এই রসায়ন নিয়ে চমৎকার একটি বই ‘নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্র/ এক অচেনা সম্পর্কের সন্ধান’ (গাংচিল, ২০১০) লিখেছিলেন বছর কয়েক আগে, সেখান থেকে এই দুই ব্যক্তির সম্পর্কের গতিরেখা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। তা ছাড়া শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ম্যাগনাম ওপাস চার খণ্ডের ‘নিবেদিতা লোকমাতা’-র প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় পর্বে জগদীশচন্দ্র আর নিবেদিতার মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে বহু তথ্য আলোচিত হয়েছে, সেখান থেকেও চাইলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনমতো রসদ সংগ্রহ করা যায়। পাশাপাশি ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-র বিভিন্ন খণ্ডতেও রয়েছে প্রচুর তথ্য। এই বইগুলো বিশেষ করে নিবেদিতা-জগদীশচন্দ্র পারস্পরিক রসায়নের আন্দাজ পেতে অনেকটাই সাহায্য করে থাকে। 

      এই পর্বে নিবেদিতার সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের আলাপ-পর্বের মূলত গোড়ার দিকের কিছু কথা আলোচনা করব আমরা। ভারতে আসবার পর আবার বিদেশ সফরের (১৮৯৯-এর জুন) আগেকার সময়কালে সীমাবদ্ধ থাকবে এই আলোচনা। এবং এই প্রসঙ্গে আসবেন এঁদের কমন-ফ্রেন্ড স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথও। পরবর্তী কয়েকটি পর্বেও নিবেদিতা-প্রসঙ্গ আসবে কালানুক্রমিকভাবে। নিবেদিতার সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্ক নিবেদিতার অকালমৃত্যুতে শেষ হয়নি, তা অনিঃশেষ প্রবাহিত হয়ে চলেছে জগদীশচন্দ্রের জীবনের পরবর্তী প্রায় প্রতিটি অধ্যায় জুড়েই। 

শঙ্করীপ্রসাদ বসু ‘নিবেদিতা লোকমাতা’র প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় পর্বে জগদীশচন্দ্র-প্রসঙ্গ আলোচনার শুরুতে আক্ষেপ জানিয়েছিলেন এই বলে যে তিনি দুজনের পারস্পরিক সম্পর্কে আলো ফেলার জন্য দরকারি বহু তথ্য চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারেননি। যেমন নিবেদিতাকে লেখা জগদীশচন্দ্রের প্রচুর চিঠির হদিস নেই, তেমনই জগদীশচন্দ্রকে লেখা নিবেদিতার চিঠিগুলিও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে প্রকাশিত হতে পারেনি আজও। এছাড়া জগদীশচন্দ্রের কাছে নিবেদিতার ডায়েরি থাকার কথা, যাতে তিনি জগদীশচন্দ্রের কাজের বিষয়ে তথ্যাদি লিখে রাখতেন, সে ডায়েরিরও হদিস মেলেনি। অনেকে অনুমান করেন এই ডায়েরি রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে, যা তাঁরা হয়তো কোনও দিনই প্রকাশ্যে আনবেন না। 

তবু শঙ্করীপ্রসাদ বসু খেটেখুটে যা সংগ্রহ করেছেন তা পর্বতের মতোই বিরাট, বিপুল; আর এটা স্বীকার না করা মুর্খামি। আমরা সেই মহাগ্রন্থের কাছে ঋণী। আর এখানে এটাও বলে নেওয়া ভালো, তাঁর এই বইয়ে (বা অন্যত্রও) বেশ কিছু অসঙ্গতি বা তথ্যভ্রান্তির দিকে নির্দেশ করেছেন পরবর্তীকালের একাধিক গবেষক। এই আলোচনায় আমরা প্রসঙ্গক্রমে আনব সে-কথাও। 


বসু-পরিবারের সঙ্গে নিবেদিতার আলাপ-পরিচয়ের সূচনা 

কলকাতায় আসবার পরে এখানকার মানুষজনদের সঙ্গে পরিচিত হতে, এখানকার নারী-শিক্ষার হাল কেমন সেসব ব্যাপারে জানতে নিবেদিতা আর সারা বুল ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। যেমন একটু আগেই বলছিলাম, সুকিয়া স্ট্রিটের কাছে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয় এরকমই একটি স্কুল, যেখানে নিবেদিতা আসেন ১৮৯৮-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি। বছর আটেক আগে তৈরি এই স্কুলটির সঙ্গে তখন যুক্ত ছিলেন লাবণ্যপ্রভা বসু। দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত অনুমান করেছেন: ‘সম্ভবত তাঁর সূত্রেই জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে নিবেদিতা ও সারা বুলের যোগাযোগ।’ (সূত্র— নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্র/ এক অচেনা সম্পর্কের সন্ধান,  ১৪ পৃ)। নিবেদিতা-জীবনীকার প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণাও মনে করেন: ‘ইতিমধ্যে শ্রীমতী সরলা ঘোষাল ও জগদীশচন্দ্র বসুর ভগ্নী শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা বসুর সহিত তাঁহার আলাপ এবং শিক্ষা সম্বন্ধে নানা আলোচনাদি হইয়াছিল; তাঁহারাও সাহায্য করিতে আগ্রহান্বিত। তিনি শ্রীমতী বসুর স্কুল, বেথুন স্কুল, মাতাজীর পাঠশালা প্রভৃতি দেখিয়া আসিয়াছেন; উদ্দেশ্য এখানকার বিদ্যালয়গুলি সম্বন্ধে একটা মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা।’ (মুক্তিপ্রাণা-র নিবেদিতা জীবনী, ৬০-৬১ পৃ)

ঠিক কবে জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ঘটে নিবেদিতার? এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। নিবেদিতা নিজে বছর কয়েক পরে ১৯০৩-এর ১৮ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘When I came to calcutta I first knew Pr. and Mrs. Bose in the end of the year 1898.’ (রবীন্দ্রনাথকে লেখা নিবেদিতার চিঠি, letters of nivedita, vol 2, 555 pp.) আবার অন্যদিকে পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কেউ-কেউ মনে করেন যে বছরের শেষের দিকে নয়, তা ঘটেছিল প্রথম ভাগেই। আর সেই আলাপের মূল কারণ জগদীশচন্দ্রের ভগ্নিপতি আনন্দমোহন বসু সম্বন্ধে স্বামীজীর উচ্চ ধারণা। বিদেশ থেকে ফেরবার পরে তাঁর সঙ্গে প্রথম হাতে হাত মিলিয়েছিলেন এই আনন্দমোহনই, এ কথা স্বামীজী মনে রেখেছিলেন সব সময়। 


নিবেদিতা-জগদীশচন্দ্র: প্রথম পরিচয়ের পরের কিছু কর্মকাণ্ড

১৮৯৮-এর প্রথম দিকে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে পরীক্ষার কাজ সরিয়ে রেখে জগদীশচন্দ্র মেতে উঠেছিলেন জীব আর জড়ের মধ্যেকার পার্থক্য মুছে ফেলার মানসে বিবিধ পরীক্ষায়। ততদিনে তাঁর প্রথম বিদেশ-সফর সেরে এসেছেন তিনি, এবং বিদেশের বহু জায়গাতেই পেয়েছেন উষ্ণ সংবর্ধনা। তবে ওই সফরের শেষে দেশে ফেরবার কিছু পরে জগদীশচন্দ্র গবেষণার গতিমুখ বদলান, যে বদলের সাক্ষী হয়েছিলেন নিবেদিতা। 

কলকাতায় আসবার দিন কয়েক পরেই নিবেদিতা আর সারা চ্যাপম্যান বুল চলে এলেন জগদীশচন্দ্রর কাছে, তাঁর বাসা-বাড়িতে। জগদীশচন্দ্রের গবেষণাগারে এসে নিবেদিতা দেখলেন, এখন আর তিনি বেতার তরঙ্গ প্রেরণ বা গ্রহণ সংক্রান্ত কাজ আর করছেন না, বরং তাঁর কাজের গতিপথ এখন ঘুরে গেছে অন্য দিকে— প্রাণ-অপ্রাণের ধূসর সীমারেখায় বিচরণ করছেন তিনি। 

এরপরে দুজনের পুনরায় সাক্ষাৎ ২৩ এপ্রিল, এমেরাল্ড থিয়েটারে। স্বামী সারদানন্দ এখানে আয়োজন করেছিলেন ‘The Hindu Mission in America’ শিরোনামে একটি বক্তৃতার। এখানে উপস্থিত ছিলেন নিবেদিতা, সারা বুল, জগদীশচন্দ্র, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু জগদীশচন্দ্র কি সত্যিই এই বক্তৃতা শুনবার জন্যেই গিয়েছিলেন? অন্যত্র এই ঘটনার উল্লেখ আমরা এখনও পাইনি। তাই নিশ্চিত করে এখনও কিছু বলা সম্ভব না। 


রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতা: আলাপের সূচনা পর্ব 

এবার আমরা সামান্য প্রসঙ্গ বদলে সংক্ষেপে আলোচনা করে নেব নিবেদিতার সঙ্গে আরও এক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রথম আলাপের ব্যাপারে। যেহেতু জগদীশ-নিবেদিতা সম্পর্কের গতিরেখা নির্মাণে এই মানুষটির ভূমিকা ছিল বিশাল। 

কলকাতায় আসবার পর এ দেশকে প্রকৃতরূপে চেনবার জন্য এখানকার মানুষদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা আকাঙ্খা মার্গারেটের মধ্যে ছিলই। যে কারণে তিনি প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন ব্রাহ্ম-পরিবারগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হতে। আর এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তখন কিঞ্চিৎ ‘স্টার-সুলভ’, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনেই নিবেদিতা আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন রূপে-গুণে মোহিত করে দেওয়ার আদর্শ উদাহরণ এই মানুষটির প্রতি। 

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতাকে প্রথম দিকে ভেবেছিলেন আর পাঁচজন বিদেশিনী মিশনারি মহিলার মতো একই শ্রেণীর, ‘কেবল ইঁহার ধর্মসম্প্রদায় স্বতন্ত্র।’ তাই আলাপ হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি যেন তাঁর ছোট মেয়ে মীরাকে ইংরেজি শেখাবার ভার নেন। নিবেদিতা সেই দায়িত্ব নিতে সঙ্গে-সঙ্গে অস্বীকৃত হন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য আদবকায়দা শেখাবার ভার দিচ্ছেন তাঁকে, যাতে তাঁর মেয়ে ওঁদের দেশের মেয়েদের মতো মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। যদিও আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের মনে সেরকম কোনও অভিপ্রায় ছিল না। নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথকে তখনও ঠিক চিনে উঠতে না পারবার দরুন এইরকম ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেছিলেন। যদিও পরে দুজনেই নানা কাজে একত্রিত হওয়ার এবং চেনাজানা হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথ নিবেদিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক-সত্বার দিকে নজর রেখেই। লিজেল রেঁম এই প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘রবি ঠাকুর তাঁর ছোট মেয়েকে ইংরেজি শেখাবার জন্য নিবেদিতাকে অনুরোধ করেন। নিবেদিতা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। ‘সে কী! ঠাকুরবংশের মেয়েকে একটি বিলাতি খুকি বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে?’ রাগে দুই চোখ জ্বলে ওঠে নিবেদিতার। ‘ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতায় আপনি এমনই আবিষ্ট হয়েছেন যে নিজের মেয়েকে ফুটবার আগেই নষ্ট করে ফেলতে চান?’ (লিজেল রেমঁ লিখিত নিবেদিতা জীবনীর বাংলা-অনুবাদ, ১৮২ পৃ) 

যদিও পরের দিকে এই দু-জনের একে অন্যের প্রতি মানসিকতায় অনেকটাই বদল এসেছিল। তবে সে আলোচনা, পরের পর্বে। 

...................

আগের পর্ব পড়ুন : জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (তৃতীয় পর্ব) 

#Jagadish Chandra Bose #Sister Nivedita #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

216065