জগদীশ-নিবেদিতা সংবাদ (পঞ্চম পর্ব)
.......................
কলকাতায় প্লেগ ও নিবেদিতার অংশগ্রহণ
বন্য ইঁদুর আর এক বিশেষ জাতের মাছি— এই দুই প্রাণীর কল্যাণে আমাদের দেশে এন্ট্রি নেয় প্লেগ। এই রোগটা মানব-সভ্যতার বুকে আঘাত করেছে একাধিকবার, সে ক্ষত সহজে শুকোয়নি। কখনও তো কোটির ঘর অতিক্রম করেছে এই রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু-সংখ্যা। কয়েক শতক আগে ইউরোপে একবার এই রোগ যখন হানা দেয়, সেই মহামারির প্রকোপে বাধ্য হয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়, যে কারণে বাড়ি চলে আসেন আইজ্যাক নিউটন নামে এক কলেজ-পড়ুয়া। এবং পরবর্তী যে আঠেরো মাস এইভাবে তাঁকে বাড়িতে কাটাতে হয়েছিল সেই সময়কালেই তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসের যুগান্তকারী কয়েকটা আবিষ্কার করে ফেলেন।
আমাদের দেশও এই রোগের ভুক্তভোগী, সেই উনিশ শতক থেকেই। ১৮৯৬-এর দিকে বোম্বে শহরে ছড়িয়ে পড়ে এই মারণ রোগ। শুধু ওই মহারাষ্ট্র রাজ্যেই ১৮৯৬ থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত, মানে প্রায় দু-বছরের মধ্যে পৌনে দু-লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই রোগে। পরে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে গুজরাত, পাঞ্জাব আর সিন্ধু এবং মাদ্রাজের মতো বেশ কিছু রাজ্যে বা শহরে। সকলেই তখন আতঙ্কিত, এবার না এই রোগ কলকাতায় হানা দেয়। কিন্তু সব আশঙ্কা সত্যি করে কলকাতাতেও পাওয়া গেল এই রোগে আক্রান্ত রোগীর হদিস।
ওই সময়টায়, গোটা দেশই প্লেগের আতঙ্কে ভুগছিল কারণ এই রোগটা শুধু কলকাতায় না, সারা ভারতেই বেশ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। ১৮৯৮-এর ৪ মে তারিখে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় একটি খবর, ‘আতঙ্কের রূপ অদৃষ্টপূর্ব। আর কখনো কলকাতার বিপুল জনসংখ্যা এইরকম প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়নি। যেসব জেনানার মুখ ‘সূর্যও দেখেনি’, তাঁরাও শহরের পথের উপর দিয়ে দৌড়েছেন, বা ট্রামে-চড়ে পালাতে চেয়েছেন। ... গত কয়েকদিনের বিপুলসংখ্যক মানুষের পলায়ন, সেইসঙ্গে দোকানপাট বন্ধ এবং পথে গাড়ি-ঘোড়ার অনুপস্থিতি— সব মিলিয়ে কলকাতা পরিত্যক্ত নগরীর চেহারা ধরেছিল।’
২.
আসলে এই রোগের প্রাদুর্ভাবের চেয়েও, মানুষের মনে রোগটা সম্বন্ধে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা বা এই রোগ সম্বন্ধে সকলের মনে জেগে থাকা এক অজানা আতঙ্ক— এই ব্যাপারটাই ঘটছিল তখন। অথচ ব্রিটিশ সরকার তখন টিকা দিতে প্রস্তুত। অথচ সাধারণ মানুষের মনে কোনও অজানা কারণে তখন অন্য এক আতঙ্ক— এই টিকা বা ভ্যাকসিন নিলে মৃত্যু আরও ত্বরান্বিত হবে! তাই টিকার বিরুদ্ধে প্রচার বা টিকাগ্রহণে অনীহা। সেই কারণে তখন কলকাতা থেকে বাইরের দিকে মানুষের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও ক্রমবর্ধমান। রাস্তাঘাটে গাড়ি-চলাচল বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ, সব মিলিয়ে যেন সম্প্রতি সময়ের সেই লকডাউন পরিস্থিতি।
এই সময় কলকাতায় পাওয়া যাচ্ছিল ওয়ালডেমার হপকিন্স-এর তৈরি ভ্যাকসিন। কিন্তু সরকার থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়, এই ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি নয়। ফলে বহু মানুষ সরকারের কথা শুনে ভ্যাকসিন নেওয়া থেকে বিরত থাকে। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় এক ভীতি। আর যেহেতু গুজব বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ে, তাই বহু ভ্রান্ত ধারণা ছড়াতেই লাগল। যেমন অনেকে বলতে থাকে যে এই টিকা নিলে দশ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হবে। অনেকে আবার বলতে লাগল, রোগীর পেট থেকে এক পয়সা মাপের একটি মাংসখণ্ড তুলে নিয়ে সেই জায়গায় প্লেগের জীবাণু ঢুকিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে তখন কলকাতা শহর প্রবলভাবে আলোড়িত। শহরের বাসিন্দারা যে যেখানে পারছিলেন পালিয়ে যাচ্ছিলেন। যেমন রোগের কারণে, তেমনই রোগ-মুক্তির ভরসা পেয়েও।
জগদীশচন্দ্র তখন থাকতেন ধর্মতলার বাড়িতে। তাঁর বাড়ির এক ভৃত্য প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর ওই ঘটনার পর তিনিও চলে যান ধর্মতলা স্ট্রিটে, আর বন্ধুকে লেখেন এই চিঠিটি:
১৩৯ নং ধর্মতলা স্ট্রিট
শনিবার
সুহৃদ্বরেষু,
উপরের ঠিকানা হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন যে আমি পলাতক— প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটী লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়— আর ৩০ ঘন্টার মধ্যেই মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া আসিয়া উক্ত ঠিকানায় আছি— কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না। আমার কেবল মনে হইতেছে যে কাগজগুলি লেখা শেষ হইল না। এখানে থাকিলে লেবরেটরীতে না আসিয়া থাকিতে পারি না, সুতরাং লিখিবার সময় পাই না। এজন্য মনে করিতেছিলাম যে দিন চার জন্য আপনাদের ওখানে আসিয়া অন্তত লেখাটা শেষ করিব। মঙ্গলবার কলেজ হইয়া তার পর সোমবার পর্যন্ত ছুটী। আপনি যদি থাকেন তবে আসিতে চেষ্টা করিব। লোকেনকে খবর দিয়া আনিতে পারিবেন কি?
এইরকম আতঙ্কের মধ্যে মাস তিনেক কাটবার পর শুরু হল আসল সমস্যা। মানুষ নিজেরাই দাঙ্গা বাঁধানোর পরিকল্পনা করছিল না তো?
জগদীশচন্দ্র সাময়িকভাবে বাসস্থান পরিবর্তন করছেন, এইটুকুই জানতে পারি তাঁর সম্বন্ধে, প্লেগের আক্রমণকালের ওই সঙ্কটজনক সময়ে। কিন্তু নিবেদিতা? তাঁর ভূমিকা?
মে মাসের শুরুতে বা জুন মাসে কলকাতায় শুরু হয় প্লেগের নতুন আক্রমণ। আর নিবেদিতাকে কলকাতা ওই সময় থেকেই চিনতে শুরু করে নতুন রূপে। কলকাতাকে প্লেগের হাত থেকে বাঁচাতে শুরু থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েন রামকৃষ্ণ মঠের কর্মীরা, বিশেষ করে স্বামীজী এবং নিবেদিতা। স্বামীজী নিজে নিবেদিতাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই রোগ প্রতিরোধের। এই কাজে রামকৃষ্ণ মিশন যে কমিটি তৈরি করল তার সম্পাদিকা হলেন নিবেদিতা; স্বামী সদানন্দ প্রধান কার্যাধ্যক্ষ, আর অন্যান্য সদস্য হিসেবে থাকলেন স্বামী শিবানন্দ, স্বামী আত্মানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ। প্লেগ পুরোপুরি আক্রমণ করবার আগেই, মার্চ মাসে এই কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয়েছিল বস্তি এলাকায়, কারণ এখান থেকেই এই রোগ বেশি ছড়ায়। ধাঙ্গড় সঙ্গে নিয়ে এই ধরনের এলাকাগুলি পরিষ্কার করবার দায়িত্ব ছিল স্বামী সদানন্দের হাতে, আর তাঁকে প্রায় সবসময়েই সাহায্য করতেন নিবেদিতা। তিনি নিজে বস্তি-এলাকায় গিয়ে কাজকর্ম তদারক করতেন। বন্ধু-পরিচিতদের কাছে চাঁদার জন্য হাত পাততেন, এমনকি একবার নিজের হাতে ঝাড়ু তুলে রাস্তা সাফ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এ ছাড়া একাধিকজনকে তিনি নিজের হাতে সেবা করেছেন, ওষুধ-পথ্য খাইয়েছেন।
স্নেহময়ী মায়ের মতো নিবেদিতার এইসময়কার সেবাকর্ম নানাজনের স্মৃতিকথায় ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন, রাধাগোবিন্দ কর লিখেছিলেন, ‘এই সঙ্কট-সময়ে বাগবাজার পল্লীর প্রতি বস্তীতে ভগিনী নিবেদিতার করুণাময়ী মূর্তি লক্ষিত হইত। আপনার আর্থিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া তিনি অপরকে সাহায্য দান করিতেন। একবার একজন রোগীর ঔষধপথ্যাদির ব্যয়-নির্বাহার্থে তাঁহাকে কিছুদিনের জন্য দুগ্ধ-পান পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল। তখন দুগ্ধ ও ফলমূলই ছিল তাহার আহার।’
রোগ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে তিনি রাস্তাতেও নেমে পড়েন, হাতে প্যামফ্লেট নিয়ে। এই কাজে তিনি পাশে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। এডওয়ার্ড টমসন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর— এঁদের লেখায় ধরা রয়েছে সেই প্লেগের আক্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ আর নিবেদিতার একসঙ্গে মিলে পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা বাড়াতে নেমে পড়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে দুটি স্মৃতিচারণ উদ্ধৃত করি: ১) অবনীন্দ্রনাথ: ‘সেই সময় কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলছি, চুন বিলি করেছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন।’
প্লেগের প্রাদুর্ভাব শুরুর সময় স্বামীজী ছিলেন দার্জিলিং–এ, প্লেগ ছড়াচ্ছে খবর পেয়ে তিনি ফিরে আসেন এবং মঠের তরফে সব কিছু তদারক করেন। সেবাকাজে প্রয়োজন হলে প্রস্তাবিত মঠের জমি বিক্রি করে দেওয়া হবে, এমনটা অব্দি ভাবা হয়ে গিয়েছিল। তবে সেবারে প্লেগ অতটা ভয়াবহ আকার নেয়নি, যেমনটা নেবে তার পরের বছর, ১৮৯৯-এর মার্চ মাসে।
সেবারে প্লেগ ছড়াতে শুরু করে মার্চ মাসের একুশ তারিখে। নিবেদিতা অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে পাশে পাননি। সম্ভবত তখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শিলাইদহে।
হিমালয় যাত্রা
কলকাতা শহরে মে-জুন মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে। স্বামীজীর পক্ষে এইসময় এখানে থাকাটা কষ্টকর। তাই প্লেগের প্রকোপ কমলে পাঁচ সন্ন্যাসী— স্বামীজী, তুরীয়ানন্দ, নিরঞ্জনানন্দ, সদানন্দ, স্বরূপানন্দ; এবং চার মহিলা— নিবেদিতা, সারা বুল, মিসেস প্যাটারসন আর মিস ম্যাকলাউড; এই আট জন হিমালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ১৮৯৮-এর ১১ মে তারিখে।
নৈনিতালে এসে দেখা হল খেতরির মহারাজার সঙ্গে, তারপর যাত্রা আলমোড়ার দিকে। সেভিয়ার দম্পতির কাছে তাঁরা আশ্রয় পেলেন। এখানে থাকবার সময়ে স্বামী স্বরূপানন্দের কাছে নিবেদিতা বাংলা ভাষা তো শিখতেনই, পাশাপাশি শিখতেন হিন্দুশাস্ত্র, গীতা। নিবেদিতাকে গীতা পড়াতে গিয়েই স্বরূপানন্দের মনে গীতার ইংরেজি অনুবাদ করবার কথা জেগে ওঠে, পরবর্তীকালে এই অনুবাদকর্মটি সম্পাদন হয়েছিল, এবং নিবেদিতাই সেই বইটির প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন। [* মুক্তিপ্রাণার নিবেদিতা-জীবনী, ৮৬ পৃ]
এই সফরে কাশ্মীরের শ্রীনগর, পহেলগাম এইসব জায়গায় ঘুরলেন সবাই। স্বামীজী আর নিবেদিতা অমরনাথ দর্শনও করলেন। শেষে অক্টোবরের ১৮ তারিখে স্বামীজী মঠে ফিরলেন কারণ এখানে দুর্গোৎসবের দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে, আর নিবেদিতা অন্যদের সঙ্গে ঘুরতে লাগলেন উত্তর ভারতের ঐতিহাসিক শহরগুলিতে। যদিও দিন কয়েক পরেই নভেম্বরের ১ তারিখে বাকিদের রেখে নিবেদিতা একাই কাশী থেকে ফিরে এলেন কলকাতায়। তাঁর এখন প্রচুর কাজ, নিজের স্কুলটি এবার তৈরি করতেই হবে।
প্রসঙ্গত কলকাতায় ফেরবার পর এইরকমই এক সমবেত সভায়, স্বামীজী আবেগের বশে বলে দিয়েছিলেন যে এই প্লেগের আক্রমণকে প্রতিহত করতে গেলে চা-কফি বেশি করে খেতে হবে।
চলুন কফি খেয়ে আসি।
.....................
#Jagadish Chandra Bose #Sister Nivedita