শাড়ির দোকান থেকে উদ্ধার হলো ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র, আলম আরার শেষ স্মৃতিচিহ্ন
এক রাজপুত্র আর এক জিপসি কন্যার প্রেমের আখ্যান। যুদ্ধ, রেষারেষি আর রোমান্সের অলিগলি ঘুরে সে গল্প এগিয়ে যাবে তার পরিণতির দিকে। রুপোলি পর্দায় জীবন্ত হয়ে উঠবে এর চরিত্ররা। নায়িকার ভূমিকায় আছেন জুবেইদা, যিনি তীব্র শরীরী আবেদনের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারেন তাঁর অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্যের সংরাগ। তার চেয়েও বড়ো কথা, কেবল পর্দায় ভেসে-ওঠা ছবি দেখেই মন ভরাতে হবে না দর্শকদের। শোনা যাবে অভিনেতাদের সত্যিকারের গলার স্বর। কথোপকথন। সঙ্গীত।
আলম আরা। ভারতের প্রথম এই সবাক চলচ্চিত্রকে নিয়ে সেদিন কম শোরগোল ওঠেনি দর্শকমহলে। ১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ হলিউডের ‘Show Boat’ ছবির অনুপ্রেরণায় তৈরি আলম আরা মুক্তি পেলে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল সিনেমাহলের বাইরে। এতদিন তো দর্শক নিছক টাইটেল কার্ড পড়ে ছবি দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। সিতারা দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ছবি চলার সময় শব্দ কোথা থেকে আসছে ভেবে বেশ বেকুব বনে গিয়েছিল দর্শকেরা।
তারপর আরও অনেক কিছুর মতো এ ছবির স্মৃতিও মুছে গেল কালের অমোঘ নিয়মে। যাকে নিয়ে একসময়ে দেখা দিয়েছিল আগ্রহ আর উৎসাহের প্রবল জোয়ার, সেও নাম লেখাল বিস্মৃতির খাতায়। প্রাথমিক রোমাঞ্চের রেশটুকু সরে গেলে কোন অন্ধকার প্রদেশে হারিয়ে গেল তার চিহ্ন, কেউ আর খোঁজও রাখল না।
বঙ্কিম একদা আক্ষেপ করেছিলেন বাঙালির ইতিহাসের অনুপস্থিতি নিয়ে। শুধু বাংলা নয়, এ আক্ষেপ বোধহয় গোটা ভারতের জন্যেই প্রযোজ্য। অতীতকে সংরক্ষণের ব্যাপারে ভারতীয় সিনেমাক্ষেত্রেও অবহেলা আর অনীহা লক্ষ করা যায়। ১৯১২ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত নির্মিত ১১৩৮টি নির্বাক চলচ্চিত্রের বেশিরভাগেরই আজ নিশ্চিহ্ন। পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউট মাত্র ২৯টি ছবি সংরক্ষণ করতে পেরেছে। বহু প্রিন্ট আর নেগেটিভ হেলায় পড়ে থেকেছে বাড়ি, দোকান, গুদামঘর, বেসমেন্ট ইত্যাদির আনাচেকানাচে।
তেমনই একটি দোকানঘর থেকে এ বছরের মে মাসে উদ্ধার করা হয়েছে আলম আরার ফিল্ম-প্রিন্টিং মেশিন। মুম্বাইয়ে শাড়ি বিক্রির জন্য ভাড়া দেওয়া ঘরটিতে লুকিয়ে ছিল শিকাগোয় তৈরি বেল এন্ড হাওয়ার্ড কোম্পানির সেই ঐতিহাসিক মেশিন। চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও গবেষক শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুরের নেতৃত্বে ফিল্ম-সংরক্ষণের জন্য তৈরি একটি দল খুঁজে পেল সেই ঐতিহ্যবাহী দলিল। আলম আরার পরিচালক ও প্রযোজক আর্দেশির ইরানির কাছ থেকে ১৯৬২ সালে ২৫০০ টাকার বিনিময়ে মেশিনটি কিনে নেন মুম্বইয়ের এক ফিল্মস্টুডিও ও ল্যাবরেটরির মালিক নলিন সম্পত। ডিজিটাল ছবির রমরমার আগে পর্যন্ত এই মেশিনে ফিল্ম প্রিন্ট করা অব্যাহত ছিল। এটিই আলম আরার শেষতম স্মৃতিচিহ্ন। কয়েকটি স্থিরচিত্র, পোস্টার আর একটি প্রমোশনাল বুকলেট ছাড়া এ সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই।
মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র আর্কাইভ ‘Film Heritage Foundation’-এর অধিকর্তা দুঙ্গারপুর আলম আরার কপি খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন দীর্ঘ এক দশক ধরে। সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যও নিয়েছিলেন এই কাজের জন্য। আলজিরিয়ায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক পুরনো আর্কাইভের সন্ধান পেলেও সেখানে সশরীরে গিয়ে খোঁজ করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে।
যে সময়ে আলম আরার শ্যুটিং চলছিল সেই একই সময়ে একই স্টুডিওতে চলছিল ‘লোর গার্ল’ নামে ইরানীয় ছবির শ্যুটিং। ‘আলম আরা’ এবং ‘লোর গার্ল’-এ একই অপ্রধান অভিনেতাদের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ‘লোর গার্ল’ পারস্যদেশের প্রথম সবাক ছবি হওয়ায় তার ফিল্ম ইরানের আর্কাইভে সযত্নে রক্ষিত আছে। সেই কারণে চলচ্চিত্র-গবেষক পি কে নায়ার অনুমান করেছিলেন আলম আরার কপি খুঁজে বের করাও একেবারে অসাধ্য নয়।
কিন্তু তার পরেও বহুদিন পাওয়া যায়নি এই ছবির কোনও হদিশ। আলম আরার ছবি তোলা হয়েছিল নাইট্রেট-ফিল্মে, যে ফিল্মের রুপোর পরিমাণ অন্য ধরনের ফিল্ম-বেসের তুলনায় কিছুটা বেশি। বিক্রি করে টাকা পাওয়ার আশায় রুপোর অংশটুকু আলাদা করে নেওয়ার পর ফিল্ম নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে এরকম উদাহরণ নাইট্রেট-ফিল্মে তোলা ছবির ক্ষেত্রে বিরল নয়। আলম আরাও বোধহয় তার ব্যতিক্রম নয়। কারণ পরিচালক ইরানির পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছিলেন, রুপো আলাদা করে নেওয়ার পর তিনি তিনটি রিল ফেলে দিয়েছেন!
আরও পড়ুন: অনগ্রসর এলাকার পড়ুয়ারা শিখছে রোবোটিক্সের কৌশল : সৌজন্যে ‘রোবোটেক্স ইন্ডিয়া’
আলম আরার রিল পাওয়া না গেলেও তার প্রিন্টিং মেশিন পাওয়া গেল – এও হয়তো ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইরানি নিজেই ১২৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ছবির সাউন্ড রেকর্ডিঙের কাজ করেছিলেন। রেকর্ডিঙের খুঁটিনাটি তিনি শিখে নেন মিস্টার ডেমিং নামে মুম্বাইয়ে আসা এক বিদেশি সাউন্ড রেকর্ডিস্টের কাছ থেকে। বুম মাইকের প্রচলন না হওয়ায় অভিনেতাদের আশেপাশেই তখন লুকিয়ে রাখা হত মাইক্রোফোন। মিউজিশিয়ানদের গান বা সাউন্ডট্র্যাক বাজানোর লুকিয়ে থাকতে হত গাছের ওপরে বা পেছনে! এ ছবির অন্যতম অভিনেতা ওয়াজির মহম্মদ খানের গাওয়া গানই ভারতীয় ছবিতে ঠাঁই পাওয়া সর্বপ্রথম গান।
সদ্য আবিষ্কৃত প্রিন্টিং মেশিন ছাড়াও একাধিক কারণে তাৎপর্যময় আলম আরার স্মৃতি রয়ে গেছে আর একটি প্রমোশনাল বুকলেটে। মুম্বাইয়ের একটি ফিল্ম-প্রপ দোকানের মালিক হুসেন মন্সুরির পরিবার সেটি আগলে রেখেছে বিগত ষাট বছর।
তথ্যসূত্র: Indias first talking film
#alam ara #first takling flim #সবাক চলচিত্র #ফিচার #ভালো খবর