ফিচার

পুরুষের ছদ্মবেশে প্রথম মহিলা বিশ্বভ্রমণকারী : জাঁ বারে

মন্দিরা চৌধুরী Sep 26, 2022 at 5:18 am ফিচার

সভ্যতার ইতিহাসে মেয়েদের স্বতন্ত্র, স্বনির্ভর পদক্ষেপ পড়েছে পুরুষের তুলনায় দেরিতে। এর কারণ যতটা না মেয়েদের অক্ষমতা, তার চাইতে বহুগুণ বেশি মানবসভ্যতার প্রায় শুরু থেকে চলে আসা পিতৃতন্ত্র। এই সামাজিক অভিশাপের জন্যই নিজেদের প্রমাণ করতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল মেয়েদের, যথেষ্ট সদিচ্ছা আর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। তবে প্রথা ভাঙার জন্য কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হয়, যেমন এসেছিলেন জাঁ বারে। নামটা অচেনা ঠেকে, কারণ চর্চার অভাব।

জাঁ বারে বিশ্বের প্রথম মহিলা যিনি পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছিলেন। আঠেরো শতকে ফ্রান্সে মেয়েদের বাড়ির বাইরে পা রাখার ক্ষেত্রেই ছিল হাজারো বিধিনিষেধ, নৌযাত্রা তো সেখানে দুরস্ত। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, আর সেই দুর্দম ইচ্ছার ওপর নির্ভর করেই জাঁ বারে করে ফেললেন অসাধ্য সাধন। এই অসাধ্য সাধনের পিছনে অনেকটা অবদান আছে ডাক্তার ফিলিবার্ট কমারসন-এর। ছোট থেকেই লতাপাতা, গাছগাছড়া সংগ্রহ করার নেশা ছিল জাঁ বারের। সেই সূত্রেই আলাপ কমারসন-এর সঙ্গে। আলাপ ক্রমে গড়ায় প্রেমে। ফ্রান্স থেকে সমুদ্রপথে পৃথিবী পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরোয় একটি জাহাজ। এই জাহাজের উদ্দেশ্য নিছক ভ্রমণ ছিলনা, তাই নির্বাচিত কিছু মানুষ সুযোগ পেয়েছিলেন এই জাহাজের অভিযাত্রী হওয়ার। রুগ্ন কমারসন যখন এই অভিযানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলেন, তখন তাঁর প্রয়োজন ছিল একজন যোগ্য অনুচরের। আর সেই কাজে জাঁ বারের চেয়ে বেশি যোগ্য যে কেউ হতেই পারে না, সে কথাও ভালমতোই জানতেন তিনি। কমারসনের সঙ্গী হয়েই সমুদ্রযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন জাঁ বারে, তবে নিজের পরিচয়ে নয়, পুরুষের ছদ্মবেশে। কারণ, সেই সময়ে মেয়েরা যাতে নৌযাত্রা না করতে পারে সে বিষয়ে ফরাসি নৌবাহিনীর কঠোর বিধিনিষেধ ছিলো। তাই জাহাজযাত্রার শরিক হতে পরিচয় ভাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলো না জাঁ বারের।


এই পর্যন্ত গল্পটা রূপকথার মতো শোনালেও জাঁ বারের গল্প কিন্তু রূপকথার চেনা ছকে শেষ হয়নি। রূপকথাকে মাটি পাথরের পৃথিবীতে এনে ফেলেছিল কঠিন বাস্তব। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় মাঝে মধ্যেই জাহাজ বিভিন্ন বন্দরে থামতো। তেমনই একবার এসে ভিড়ল তাহিতি বন্দরে। বন্দরে নেমেছে জাহাজের যাত্রীরা, নাবিকেরা বাজারে ঘুরছে, সওদা করছে। অভিযাত্রী দলের কেউ কেউ নিজেদের গবেষণার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। এমন সময়েই কানে এল ফরাসি ভাষায় মহিলা কণ্ঠের চিৎকার। কিন্তু তাহিতি দ্বীপে যেখানে তথাকথিত সভ্য লোকের বাস প্রায় নেই, সেখানে ফরাসি ভাষায় চিৎকার করে কে? কৌতুহলী অভিযাত্রীরা চিৎকারের উৎসস্থলে পৌঁছে দেখে মহিলাকণ্ঠে চেঁচাচ্ছে জাহাজের ফিলিবার্ট কমারসনের সঙ্গী যুবক জন! প্রায় দু'বছরের যাত্রাকালে সকলেই দেখেছেন কমারসন একটু রুগ্ন গোছের, তবে তার সঙ্গী ছেলেটি বেশ চটপটে। সবসময় যেন উৎসাহে ফুটছে, কখনও কখনও নাবিকদের কাজকর্মেও হাত লাগায়। কিন্তু কোন জাদুতে তার গলা হঠাৎ করে এমন মেয়েলি হয়ে গেল, সেটাই তখনও বুঝে উঠতে পারছে না হতভম্ব জনতা। স্থানীয় কিছু লোকের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি বেধে যায় সে ছেলের। তখন তাড়াতাড়ি তাকে সরিয়ে নিয়ে যায় জাহাজের লোকেরা, আর তারপরেই সামনে আসে এক চমকে দেওয়া তথ্য। জন আসলে পুরুষই নয়! সে আসলে মহিলা! এরপর জাঁ বারের আসল পরিচয় জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই রোমাঞ্চকর যাত্রা থেকে রোমাঞ্চ অংশটাই বাদ পড়ে, বাদবাকি যাত্রা হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। অন্যান্য অভিযাত্রীদের বয়ান থেকে জানা যায়, নাবিকদের নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণেরও শিকার হয়েছিলেন তিনি। অবশেষে মরিশাস বন্দরে নেমে যান জাঁ বারে ও কমারসন। কমারসনের মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা।

আরও পড়ুন : ডাকাতদের নিয়ে গড়েছিলেন রক্ষীদল, বন্দুক হাতে জমিদারি সামলাতেন ঠাকুরবাড়ির এই মেয়ে / সুচেতনা দত্ত

প্রথম মহিলা বিশ্বভ্রমণকারী হসাবে ইতিহাসে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করা ছাড়াও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই যাত্রাকালে করেছিলেন জাঁ বারে। গোটা অভিযানে প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকতেন কমারসন। একার উদ্যোগে প্রায় ছয় হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন জাঁ বারে। উদ্ভিদবিদ্যার জগতে এক বিশাল অবদান রেখে গিয়েছিলেন তিনি। অথচ নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাননি এই মেয়ে।

..................... 



#Jeanne Baret #voyage #expedition #silly পয়েন্ট #নারীপক্ষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

35

Unique Visitors

217850