ফিচার

ডাকাতদের নিয়ে গড়েছিলেন রক্ষীদল, বন্দুক হাতে জমিদারি সামলাতেন ঠাকুরবাড়ির এই মেয়ে

সুচেতনা দত্ত Sep 25, 2022 at 7:41 pm ফিচার

একে বাঙালি, তায় মেয়ে। তার মানেই সে হবে নরমসরম লতার মতো, এমনটাই ধারণা করেন অনেকে। যদিও এ ধারণা বারে বারে বালির বাঁধের মত ভেঙেচুরে দিয়েছে বাঙালি মেয়েরাই। আর প্রথা ভাঙার ইতিহাসে চোখ রাখলে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের দৃষ্টান্ত আজও আমাদের অবাক করে। আসলে বোধহয় এই বাড়ির জলহাওয়াতেই ছিল স্বাতন্ত্র্যের বীজ। তাই এ বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়েও সেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক মেয়ে, সুদক্ষিণা দেবী। না, সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতি জগতে তিনি কোনও নিজস্ব অবদান রেখেছেন, এমনটা নয়। কিন্তু তবুও তিনি আলাদা। সেকালের মেয়েদের তুলনায় আলাদা তো বটেই, আলাদা ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের থেকেও।

সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাকা। রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে সুদক্ষিণা ওরফে পূর্ণিমা। ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিসরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ভাইবোনেদের মতো কলম চালানো বাড়ির নিজস্ব পত্রিকা 'পুণ্য'-র পাতায়। তারপরই অবশ্য এই পরিমণ্ডল থেকে অনেকটা দূরে সরে যেতে হয় তাঁকে। রাজরানির মতো রূপ যে মেয়ের, তার জন্য অভিভাবকেরা পাত্র খুঁজেছিলেন রাজার ঘরেই। বিয়ে হয় উত্তরপ্রদেশের হরদই জেলার জমিদার, আইসিএস অফিসার পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ পান্ডের সঙ্গে। বাংলা তথা ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন বটে সুদক্ষিণা, তবে স্বামী হাতে ধরে শেখালেন ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক চালানো, জমিদারির কাজ, সবকিছুই। জ্বালাপ্রসাদ কি জানতেন যে তাঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে! কে জানে! তিনি যখন মারা যান, তখন সুদক্ষিণার বয়স মাত্র সাতাশ বছর। বিদেশ বিভুঁইয়ে, অন্য ভাষা, অন্য গোষ্ঠীর মানুষজনের মধ্যে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েটি। 

কিন্তু গল্পটা বদলে গেল এর পর থেকেই। অভিভাবকহীন জমিদারির দিকে নজর পড়েছিল অনেকেরই। জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল ব্রিটিশ সরকারও। সকলের মতলবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন একা মেয়েটি। ঘোড়ায় চড়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লেন জমিদারি পরিদর্শনে। প্রজাদের দুঃখকষ্টের কথা শোনা, অন্যায় অবিচার কঠোর হাতে দমন করা, সব ভার তুলে নিলেন নিজের হাতেই। আর তাঁর সহায় হল কারা? দুর্ধর্ষ একদল ডাকাত। তাদের নিয়েই নিজস্ব রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এরপর আর তাঁর কাছে ঘেঁষবে কে! শোনা যায় তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন এক তরুণ ইংরেজ অফিসার, তবে গল্প এগোয়নি। আর রাজত্বের বাকি ইংরেজ অফিসারেরা রীতিমতো তটস্থ থাকতেন রানি সুদক্ষিণার দাপটে।


জমিদারের মৃত্যুর পর জমিদারি লাটে ওঠেনি তাঁর জন্যেই। যে দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি সামলাতেন সুদক্ষিণা, তা দেখে ইংরেজ সরকার তিনবার 'মহারানি' খেতাব দিতে চেয়েছিল তাঁকে। কিন্তু যিনি এরপর অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করবেন, তিনি ইংরেজের দেওয়া খেতাব নেবেন কেন! তাই 'মুকুটহীন রানি' হয়েই তাঁর প্রজাদের মনে বেঁচে রইলেন সুদক্ষিণা। সুশাসক তো সুদক্ষিণা ছিলেনই, সেই সঙ্গে সমাজসেবার আদর্শকে সামনে রেখেই তিনি জমিদারি সামলাতেন। নিজের চেষ্টায় শাহজাহানপুরে একটি চিনির কল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশে অশিক্ষিত ও প্রান্তিক অধিবাসীদের জন্য একটি বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন।ওই সব অঞ্চলে নারীশিক্ষা প্রসারের দিকেও তিনি সচেতন দৃষ্টি দিতেন।

এই মেয়ে যে কেবল ঘোড়ায় চড়ে রাইফেল ছুড়েই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। 'পুণ্য' পত্রিকার পাতায় তাঁর লেখালেখি চলত রীতিমত। রান্নার লখনৌ প্রণালী নিয়ে লিখতেন সুদক্ষিণা। দিদি প্রতিভা অভিজ্ঞার মতই সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। একটা গানে সুরও দিয়েছিলেন তিনি। সেই সুরের নাম 'দি ইন্ডিয়ান ভিলেজগার্ল'। রেকর্ডে এই অর্কেস্ট্রা বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল।

আরও পড়ুন : দেশে প্রথম মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের ‘মানবাধিকার’-এর দাবিতে লড়েছিলেন সাবিত্রী / তোড়ি সেন

ঠাকুরবাড়ির মেয়ে হলেও স্বজন স্বদেশ থেকে বহু দূরে কেবল নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতায় স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন সুদক্ষিণা। তিনি ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়েদের মত সাহিত্য রচনা করেননি বটে, কিন্তু তাঁর রোমাঞ্চকর জীবনের দিকে তাকালে মনে হয়, তা যেন সরাসরি সাহিত্যের পাতা থেকেই উঠে এসেছে।

..........................

সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র 


#সুদক্ষিণা দেবী #ঠাকুরবাড়ি #Sudakshina Tagore #silly পয়েন্ট #নারীপক্ষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

74

Unique Visitors

185786