প্রলাপ (চতুর্থ কিস্তি)
[৭]
ওই আবার শুরু হল। মাঝেমধ্যেই কান পাতা দায়। চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে বটে লোকটা। সারাটা দিন থেকে থেকে বকবকানি শুরু হবে। খানিকক্ষণ চলতে চলতে হঠাৎ ক্ষেপে উঠবে, অদৃশ্য কোন প্রতিপক্ষের উদ্দেশে ছুঁড়তে শুরু করবে তীব্র বাক্যবাণ। চিৎকার একবার শুরু হলে থামানো যায় না। অবশ্য থামানোর মতো কেউ নেইও। আশেপাশের মানুষেরা ছেড়ে চলে গেছে কবেই। অমন ঝগড়ুটে লোকের সঙ্গে থাকার বালাই কেউ নেয়নি। কাছের মানুষ অবশ্যই ছিল কিছু। কিন্তু অহরহ অশান্তি, ঝগড়া নিয়ে ঘর করা যায়নি।
তবে তাতেও কি শিক্ষা হয়েছে? এখনও সারাদিন কেমন তারস্বরে অকথ্য ভাষায় বাণীবর্ষণ চলছে। রোজ রোজ ঝগড়া অশান্তি করতে ভালো লাগে? শরীর খারাপ করে না? ঝগড়া করার সময় তো সারা শরীরেই রাগের একটা অদ্ভুত গরম হাওয়া বয়ে যায়। কান লাল হয়ে যায়, চোখে-মুখে অসহ্য একটা উত্তপ্ত ভাপ টের পাওয়া যায়। অনেকের শুনেছি হাত-পাও কাঁপতে থাকে। এইসমস্ত প্রতিদিন নিয়মমাফিক চালিয়ে যেতে ভালো লাগে? তাই তো গেরস্ত বাড়ি বলুন বা রাস্তাঘাট, অফিস-কাছারি হোক বা ইস্কুল-কলেজ - সবাই দু-তিনটে দিন ছেড়ে ছেড়ে অশান্তি ঝগড়া করে। মাঝের দিনগুলোয় শরীর তার বেরিয়ে যাওয়া শক্তিকে ফিরিয়ে নেয়। এই লোকটার কাছে সেসব যেন ঘোর অবাস্তব। ঝগড়াটা লোকটার কাছে প্রতিদিনের স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়ার মতোই।
একা মানুষ হয় না, তা নয়। কত মানুষই তো একা থাকে। কিন্তু একটা দুটো বন্ধু বা দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয় বা অন্তত চেনা একজন সবজিওয়ালাও কী থাকতে নেই, যারা খোঁজ খবর নেবে কিংবা রাস্তাঘাটে দেখা হলে একটু গল্প করবে? সেইসব তো দূর অস্ত। বন্ধু আত্মীয়রা কোন মুলুকে জানা নেই। বাজার-দোকানের লোকেরাও এড়িয়ে চলে। এই বুঝি কোনও একটা কথায় ক্ষেপে উঠে একখানা ঝগড়া বাঁধিয়ে বসল। চোখের আড়াল হলে নিজেদের মধ্যে শুধু বলাবলি করে, “জন্মের সময় মুখে বোধহয় মধু দেয়নি কেউ।” সত্যিই দেয়নি হয়তো। বা দিলেও হয়তো থু-থু করে ফেলে দিয়েছিল। শুধু কিছু ফচকে ছোকরা অকারণ পিছনে লাগে। খেপিয়ে দিয়ে মজা দেখে। নতুন নতুন গালি শেখার বাজি রেখে মানুষটাকে দেয় রাগিয়ে। লোকটা এদের অভিসন্ধি বোঝেও না। খ্যাপা ষাঁড়ের মত তেড়ে ফুঁড়ে ঝগড়া করে। লোকজন ভয়ে ভয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। একটানা অনেকক্ষণ ধরে চেঁচালে হাঁফ ধরে - সম্বিতও ফেরে হয়তো অল্পস্বল্প। চিৎকার থেমে গিয়ে বিড়বিড়ানি আসে। আর সেই বিড়বিড়ানির তোড়েই বাড়ির পথটা মনে পড়ে যায়। পথটুকুই যা। আলাদা তো কিছুই হবে না বাড়ি ফিরলে।
চিৎকার করতে করতে গলার শিরায় আঘাত লেগেছে হয়তো। আজকাল আওয়াজটা তাই খানিক ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনায়। কাল কালো কুকুরটার সঙ্গে একদফা অশান্তি হয়ে গেছে। শেষের দিকের কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। গলার আওয়াজটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। যাচ্ছেতাই বলে চুপ করিয়ে দেওয়ার কথা সকলেই কমবেশি ভাবে। কিন্তু ঝগড়ুটে মানুষের কোনও বাহানা লাগে না মনে পড়তেই পিছু হটে। লোকটা তাই থেকে গেছে। সয়ে যায় ক'দিন পর থেকে। সবাই জানে শুরু করেছে যখন, একটু বাদেই ইতি টানবে। দৈনন্দিন বেঁচে থাকার পথে কটা মানুষের সঙ্গে একচিলতে হলেও আদানপ্রদান তো হবেই। সকলেই এখন সাবধানী হয়েছে। তাই ঝগড়া করবার পাত্র কমতে কমতে এসে ঠেকেছে হাতে গোনা দুটো-একটায়। সবথেকে বেশি ঝগড়া হয় নিজের ছায়াটার সঙ্গেই। সবাই ছেড়ে চলে গেলেও ছায়ার তো কোনও উপায় ছিল না। তাই অনিচ্ছাতেও থেকে যেতে হয়েছে। অহরহ ঝগড়া অশান্তির মূল অংশীদার এখন সে-ই।
একেকদিন চূড়ান্ত অশান্তি, একেকদিন আবার ঝগড়ার মাঝে ক্লান্তি আসে খুব। দীর্ঘশ্বাসের মতো দমকা হাওয়া এসে জায়গা করে বুকের মধ্যে। অনেক কথাই তখন হুড়মুড় করে মনে পড়ে যায়। আচ্ছা ঝগড়া কি কেউ একা করতে পারে? প্রতিপক্ষ লাগে না? পৃথিবীময় লোকের কানে গেছে ঝগড়ার খ্যানখ্যানে আওয়াজ। অথচ জীবনজোড়া গোঙানি, ফোঁপানির ফল্গুস্রোত ধাক্কা মারেনি কারোর কানের পর্দায়। সব দোষ হয়ত বা তারই ছিল। কিন্তু একবারের জন্যেও কি ঠিক হতে নেই একটা গোটা মানুষের? ঠোঁটের ডগায় খারাপ কথাগুলো বিশ্রীভাবে ঝুলে থাকে সারাক্ষণ। সহজেই তাই দোষী সাব্যস্ত করা যায় সেইসব কথা লুফে নিয়ে। অথচ ঠিক তার অর্ধমুহূর্ত আগের যন্ত্রণাটুকু কারোর বুকে কোথাও আঁচড় কাটেনি। হাতে, পায়ে, বুকে বৈদ্যুতিক তার জড়িয়ে এবড়োখেবড়ো রেখায় হৃৎপিণ্ডের কষ্ট কাগজে ছেপে ফেলা যায়। মানুষের মনের ভিতরেও ফালাফালা দগদগে যন্ত্রণার দাগ কাটা থাকে। শুধু সেটার ছবি এঁকে কাউকে দেখানো যায় না, এই যা।
বিষম ঝগড়ুটে, অপাংক্তেয় মানুষটার কথা কারোর চিন্তাতেই আসে না। গলার আওয়াজ বা গোঙানি শুনলেই যা একটু খেয়াল পড়ে লোকজনের। পারে বটে ঝগড়া করতে। ওই মারাত্মক গলার স্বরেই বেঁচে থাকে লোকটা। খোঁজখবর না নিলেও লোকে নিশ্চিত জানতে পারে যে 'বেঁচে আছে।' আলাদা করে একে নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ কারোর নেই। যদিও অবকাশ একদিন না একদিন আসবেই। গলার আওয়াজ একদিন ক্ষীণ হয়ে আসবে। তারপর ক্ষীণতর। একদিন হঠাৎ করে থেমে যাবে সবরকম শব্দোচ্চারণ। নিস্তব্ধ বাড়িটার দিকে দৃষ্টি ঘুরবে সবার। 'মরে গেল নাকি?' চিন্তায় জড়ো হবে পাড়ার মাতব্বরেরা। আশপাশ থেকে সাহসী গৃহিণীর দল উপদেশ দেবে কী করণীয়। আরও কিছু ছেলেমেয়ে, বউবাচ্চা জুটে যাবে জটলায়। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে পা বাড়াবে ঝগড়ুটে বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভয়, বিস্ময় মিলিয়ে এই জনতার উত্তেজনার পারদ থাকবে তুঙ্গে। এ-ওর গা ঠেলাঠেলি করে দরজার পাল্লায় ধাক্কা মারা চলবে। দমাস করে একটা আওয়াজে কব্জা ভেঙে খুলে যাবে দরজা। ইতিউতি খুঁজে সবাই হয়ত ভারী হতাশ হয়ে দেখতে পাবে লোকটা বেঁচে আছে। শুধু ভীষণ জ্বর। উত্তপ্ত শরীরে খাটের উপর মানুষটা নিথর হয়ে পড়ে। ছায়াটাকে দেখা যাবে না আশেপাশে কোথাও। সুযোগ বুঝে পালিয়ে বেঁচেছে হয়তো।
লোকটা হয়তো তখনও ক্ষীণ শক্তিতে হাত পা নেড়ে ঝগড়া চালিয়ে যাবে সিলিং ফ্যানটার সঙ্গে। মুখ থেকে অনর্গল দুর্বোধ্য শব্দ বেরোবে। ভাষা বলা যায় না তাদের। সবাই দেখবে, প্রায় নিঃশব্দ লড়াইয়ে লোকটা নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সব লড়াই তো সশব্দে হয় না। মৃত্যুর খবর মুখে মুখে ছড়াবে বলে যাবে যারা, ফিরবে একরাশ বিরক্তি নিয়ে। পাড়ার কোনও এক মা নিজের মুখরা মেয়েকে হয়তো উপদেশ দেবে, 'এখন থেকে মুখ না কমালে বয়সকালে এমন দশাই কপালে আছে।' অনেকেই মুখে না বললেও মনে মনে স্বস্তি পাবে। আবার অনেকেই এরপর কী হবে সেই ভাবনার অস্বস্তিতে পড়বে। এক-দুই-তিন করে ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে সবাই। একজন শুধু আর দু-তিন মুহূর্ত অপেক্ষা করবে ইতস্তত মুখে। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে কিছুটা সময়। ঠোঁটের কাঁপন, বুকের ওঠা-পড়া লক্ষ করবে। সবটা দেখেশুনে বুঝতে পারবে একনাগাড়ে মানুষটার মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ঠিক তিনটে শব্দ।
শব্দগুলো কী? তা আমরা জানব কেমন করে? আমরা তো কেউ শুনতে চাইনি, জানতে চাইনি।
যে দু-দন্ড সময়টুকু অন্তত দিতে পারবে, শুধু সেই জানুক নাহয়।
........................
[৮]
গাছেরা সব আদ্যিকালের বুড়োদাদু। ওদের আত্মার যাতায়াত বীজ থেকে বীজে, যুগ থেকে যুগে। তাই ধুলোময় বিশাল মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট গাছটার বয়স হিসাব করা ভারী মুশকিল। কিন্তু বয়স যাই হোক, খেলার স্বার্থে, খেলোয়াড়দের স্বার্থে এ গাছ কাটা পড়বেই।
মানুষ ভাবে গাছেরা বোবা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝি কালাও। অথচ ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ডায়নোসর পতনের সেই উল্কাও যাদের নির্বংশ করতে পারেনি তারা কি এতটাই হাবাগোবা? গাছেরা সব শোনে, সব বোঝে। বোঝানোর চেষ্টাও কম করে না। তবে মোটা দৃষ্টির চোখে ওদের সূক্ষ্ম ভাষা ধরা পড়ে না।
গাছটার পাশে দাঁড়িয়েই ওরা ওকে কেটে ফেলার কথা বলছে। কতবার ওদের মাথায় টুপটাপ ছোটো ছোটো শক্ত ফল এসে পড়ল। কতবার পাতার ছায়া সরে মুখে চোখে রোদ লাগল। ওরা তবুও কিছু বুঝল না। এই ছেলেগুলোই এতদিন ধরে এই গাছের চারপাশে বড়ো হয়েছে। খেলা, লুকোচুরি, আড্ডা, প্রেম। তারাই আজ ফুটবল স্টেডিয়াম করার উৎসাহে নিঃশেষ করে ফেলতে চাইছে এতদিনের অস্তিত্বটাকে। ঠাকুরদাসুলভ অভিমানে পারলে কষিয়ে চড় মারত এদের। কিন্তু বোবা-কালা না হলেও হাত-পা যে সত্যিই বাঁধা। তাই রোদে পুড়িয়ে, মাথায় নোংরা ফেলেই যেটুকু যা শোধ নেওয়া।
ছেলেগুলো তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চাইছে। অথচ ওরা চলে যেতেই একাকীত্বের অদৃশ্য কুয়াশা ঢেকে ফেলে গাছটাকে। পুরোনো কথা মনে পড়ে। আবছা আবছা। ভুলভ্রান্তিও হয় স্মৃতিচারণার ফাঁকফোকরে। যেমন আজ হঠাৎ নিজেকে তার মনে হল পৃথিবীর আদিমতম গাছ। প্রথম লজ্জার অনুভূতিতে হয়তো এই গাছের ভীষণ মোটা গুঁড়িটার পিছনেই লুকিয়েছিল ইভ। হতেই তো পারে। আবার না-ও হতে পারে। আসলে হওয়া বা না হওয়াটা আমাদের ধরে নেওয়ার উপরেই একান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই ভেবে নিতে দোষ নেই যে গাছটা যুগে যুগে ঘুরে বেরিয়ে চষে ফেলেছে গোটা দুনিয়া। ছুঁয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জীবন। হয়ত কখনও ইতিহাসের কোনও ক্ষমতাশীল রাজার বাগানের শোভা হয়েছিল সে। ওর মিঠে ছায়ায় রাজরানি তাদের ছানাপোনাদের নিয়ে বনভোজনে মাততেন। খাবারের গন্ধে ম-ম করত গোটা বাগান। মনে হয়, কামানের গোলার আঘাতে সেই জন্মে প্রাণ গিয়েছিল তার। আরেকরকমও ভাবা যেতে পারে। বিরাট ফাঁপা কোটরে হয়তো লুকিয়েছিল ডাকাতের দল। ঠিক মধ্যরাতে হামলা করবে বলে। আবার ডাকাতের বদলে কিছু বিপ্লবীকেও লুকানোর সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। হয়তো ভোর হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অত্যাচারীর কুঠিতে। কোনো একবার হয়তো মাটি ফুঁড়ে বেরোনোর মুহূর্তে চোখ মেলে বড়ো বিস্মিত হয়েছিল। আধো ঘুম, আধো জাগরণের চোখে সামনে পেয়েছিল এক পাহাড়কে, যার অস্তিত্বের সামনে নিজেকে ক্ষুদ্রও মনে করতে পারেনি। মনে হয়েছিল সবটাই ভ্রান্তি। মহাসমুদ্রে ভাসমান একটা রঙিন কাগজের নৌকার মত। তারপর একটু একটু বড়ো হয়ে পূর্ণ শরীর পেয়েছে। তখন নিজেকে অতটাও তুচ্ছ মনে হয়নি আর। পাহাড়ের রূপের সঙ্গে, মেজাজের সঙ্গে একাত্ম হতে শুরু করছিল। ভালো লাগছিল জীবনটা। পাহাড়টা এখনও অটল। শুধু একবার গা থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলার সময় আর রেহাই দিল না। আবার খুঁজতে হয়েছে নতুন মাটি। কোন জীবনটা যে কতকাল আগের, সেই হিসেবে গুলিয়ে যায়। আবছায়া ভাবনাগুলোই ভরসা।
এই জন্মে ওর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য স্মৃতি তৈরি হয়নি। ওই একবার অনেক অনেক শীতের পাখি গোটা শরীর জুড়ে বাসা করেছিল, সেইটে বড্ড মনে পড়ে। কিন্তু ওই একবারই। জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছিল সেইবার। আর কখনও পথ ভুল করেও পাখিগুলো এমুখো হয়নি। কত যে ঝড় হল, কেউই কাবু করতে পারেনি এই বিশালবপু গাছটিকে। কত ছেলেপিলেকেই কচি থেকে পাকা, পাকা থেকে বুড়ো হতে দেখা হয়ে গেল। এই মাঠের ধরে নেহাত কম দিন তো হল না। বরাবর একাই ছিল যদিও। বিশাল খেলার মাঠের ধারে এই একখানাই মহীরুহ। কিন্তু তাতে কী? সারাদিন জীবজন্তু, পাখি, কাঠবেড়ালি, মানুষের কোলাহলেই দিন গুজরান হয়ে এসেছে তার। কোনোদিন মনে হয়নি এরা আমার আপন নয়। আজ যে মিথ্যে হয়ে গেল সেই বিশ্বাস। পুরনো দিনের কথার ভিড়ে আজকের সত্যিটাকে ঢাকা যাচ্ছে না। আবার যন্ত্রণার শীতল চাদরে ঢেকে যাচ্ছে শাখা-প্রশাখা। এই সত্যির বিরুদ্ধে জেতা যাবে কিনা গাছটা জানে না। শুধু জানে শেষ চেষ্টা করতে হবে। বিনা প্রতিরোধে একটি পাতাও তার বৃথা খসে পড়বে না।
কিন্তু প্রতিরোধটা করবে কী উপায়ে? যুগে যুগে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার দায় তার অস্তিত্বের মর্মমূলে নিহিত। অথচ নিজের জন্য লড়বার কোনো পথই বাতলে দেওয়া হয়নি তাকে। বিশাল একখানা শরীর থাকলেও তার সুতো নিজের আয়ত্বে নেই। টুঁ শব্দটি উচ্চারণের মতো জিভ নেই। সব দিক দিয়েই যেন পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। যাকে বড়ো বেশি দরকার, তাকেই যেন অসহায় করে হাতের মুঠোয় রাখার ষড়যন্ত্র। ক্ষমতার থেকে অক্ষমতার বড়াই অনেক বেশি। এত কিছু বুঝে ফেলে বড়ো ক্লান্ত বোধ হয়। লড়াই করতে হবে। কিন্তু এই অসম্ভব অসম লড়াই কেন করবে সে? এই জীবন শেষ হলে আরেক জীবনের বাকিটুকু আসবে, জানা আছে। আসলে মাঝেমধ্যে এই অসীম চলাচল আর ভালো লাগে না। মনে হয় এইবারে শেষ হোক। আবার পরমুহূর্তেই অন্য চিন্তা আসে। এইটুকুই কি দেবার ছিল? আরও সামান্য ধারবাকি রয়ে গেল না কি? আবার যদি সেই পাখির দল ফিরে আসে? তাহলে?
ক'দিন আবার মানুষের চলাচল শুরু হতেই পাতায় পাতায় হাওয়ার সুর বাজে। অনেকেই শোনে। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয়তো। কিন্তু কিছু করে না। ডালপালা বেশি করে এগিয়ে দিয়ে ছায়া দেয় ঘেমেনেয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে। ছায়ায় বসে তারাই আলোচনা করে স্টেডিয়াম হলে এলাকার চেহারা পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। ফলগুলো যদি অখাদ্য না হয়ে অন্তত টক, মিষ্টি, তেঁতো কিছু একটা হত - তাহলে একবার সেদিক থেকেও চেষ্টা করেও দেখা যেত। পাখি, কাঠবেড়ালি, পোকামাকড় বন্ধুর দলও যেন পেয়েছে আসন্ন উচ্ছেদের নোটিশ। দেখতে দেখতে তাকে শূন্য করে দিয়ে চলে যাচ্ছে তারাও। কেমন ফোঁপরা মনে হয় নিজেকে। অবশ্যম্ভাবী শেষের ঘন্টা বাজতে থাকে অনবরত। গল্পের খাতিরেও মেনে নেওয়া যায় যেটুকু, সেই চেষ্টা হল। তবুও তোড়জোড়ের শেষ নেই। শেষের যে আর দেরি নেই তার খবর নিয়ে এল মোটা মোটা ক'গাছি দড়ি।
গাছেদের কাঁদবার বা চিৎকার করবার ক্ষমতা নেই। ভালোই হল তাতে। না হলে কানা আঙ্গুল চাপা দিতে হত সকলকে। সবাই মিলে সরিয়ে ফেলতে চাইছে তাকে। একজনকেও কী পাশে পাওয়া যায় না? একজনও কি শেষের আগে গুঁড়িটায় হাত বুলিয়ে চোখের জল ফেলবে না? এতটাই হীন সে? এতটাই ব্রাত্য? পাতার দল কেঁপে উঠে আকাশের দিকে চেয়ে আর্তি জানায় যেন।
এমন হেরে ভূত হয়ে যাওয়া সময়ে কোনো আগাম খবরাখবর ছাড়াই সেদিন সন্ধ্যায় উঠল বিষম ঝড়। আকাশ কথা শুনেছে বোধহয়। এই ঝড়ে ঐরকম চেহারায় সামান্য ভাঙাচোরা, সামান্য আঁচড়ের বেশি কিছুই হবার কথা ছিল না। তবুও অনেকে ঘরে বসে ভাবল, ঝড়েই কাজটা সহজ হয়ে যাবে হয়তো। গাছটাও যেন প্রাণের গভীরে অনুভব করল সেই কথাই। এতদিনের অভিমানে ফুঁসে উঠল গোটা দেহটা। নিজের সবটা উজার করে যুগের পর যুগ ধরে শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কী পেয়েছে? এই তুচ্ছ হাওয়াকে আটকে ঠায় দাঁড়িয়ে আর কী লাভ আছে? সেই তো অপরাধী না হয়েও শাস্তি কপালে জুটবেই। তার চেয়ে নিজে সরে যাওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। একটা বিরাট নিষ্প্রয়োজনের অনুভূতি নাড়িয়ে দিল মাটির একেবারে গভীরে চারিয়ে যাওয়া শিকড়টাকেও। বাজ পড়ার শব্দে মিলেমিশে গেল গাছটার শেষ প্রতিস্পর্ধার শব্দটুকু। পরদিন সকালে সবাই দেখল বিরাট মাঠে কাদা মাখামাখি হয়ে পরে আছে বিশালকায় গাছটা। খুশিই হল বেশিরভাগ। কাজ কমল কিছুটা। সত্যিই কমল। অনিবার্য উৎখাতের হাত থেকে বাঁচার আর তো কোনো উপায় ছিল না ওর কাছে - নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া।
[চলবে]
.................................
পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ুন : ১) প্রলাপ (প্রথম কিস্তি) / প্রজ্ঞা দেবনাথ
২) প্রলাপ (দ্বিতীয় কিস্তি) / প্রজ্ঞা দেবনাথ
৩) প্রলাপ (তৃতীয় কিস্তি) / প্রজ্ঞা দেবনাথ
.................................
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র