পাখির টানে রাজস্থানে
২০২০ সারা বিশ্বের কাছে এক বিভীষিকার বছর। যেন কোনও ক্রুদ্ধ দেবতার অভিশাপে মারণ ভাইরাসে কাবু ধনী-দরিদ্র সবাই। আর এই মারণ ভাইরাসের থেকে মুক্তির পথ হল নিজেকে চার দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ রাখা। বাঙালি, যার পায়ের নিচেই সর্ষে থাকার বদনাম, সেই বাঙালিই নাকি গৃহবন্দি। মার্চ থেকে এক-এক করে দিন গুনে যাচ্ছি সেই দলে থাকা আমিও। ২০২০ সালের সমস্ত পরিকল্পনা গুলিয়ে গেল। জীবন যেন এক বছর পিছিয়ে গেল। এমতাবস্থায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব এসে গেল দোরগোড়ায়। মাস তখন অক্টোবর, আমাদের রাজস্থানের টিকিট কাটা।
অনেক দিনের ইচ্ছে রাজস্থানের মরু প্রদেশের জীববৈচিত্র্য চাক্ষুষ করব। হ্যাঁ, যে জায়গা বিখ্যাত তার বালি, উট, ক্যাকটাস এবং সোনার কেল্লার জন্য, সেখানের জীববৈচিত্র্য। শুনতে একটু অবাক লাগলেও সত্যি। ঊষর বালিয়াড়িতে আমাদের প্রথম গন্তব্য তাল ছাপর কৃষ্ণসার অভয়ারণ্য। রাজস্থানের উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত চুরু জেলার অন্তর্ভুক্ত ছাপর গ্রামের নামে এই অভয়ারণ্যটির নামকরণ। স্থানীয় ভাষায় তাল মানে ছোট জলা - মূলত বর্ষার জল জমিয়ে রাখার একটা প্রচেষ্টা। বাকি সময় সেখানে নুন জমা হয়ে থাকে। থর মরুভূমির প্রাণকেন্দ্র এই তাল ছাপার অভয়ারণ্য।এখানে মূলত কাঁটা জাতীয় কাছ ও ঘাস জাতীয় ঝোপ বেশি দেখা যায়। সমগ্র অভয়ারণ্যটি এই কারণে একটি আদর্শ সাভানা তৃণভূমির রূপ নিয়েছে। এখানে তৃণভূমিতে একটি বিশেষ ধরনের ঘাস জন্মায় স্থানীয়রা যাকে "মোথিয়া" নামে ডাকে। আসলে এই গাছের ফলটি দেখতে একদম মুক্তোর মতো। ‘মুক্তো’ এখানের চলতি কথায় ‘মোতি’, সেখান থেকেই মোথিয়া। যেগুলি আবার কৃষ্ণসারদের প্রধান খাদ্য।
আরও পড়ুন : লাট্টু পাহাড়ের দেশে / অনীশ দাস
যাই হোক, পরিকল্পনামতো ১৮ই অক্টোবর কলকাতা থেকে তাল ছাপার এর উদ্দেশে রওনা হলাম আমার সঙ্গী আমার শ্বশুরের কন্যা, অর্থাৎ সহধর্মিণী। নিউ নরমালের জন্য সময়ের বেশ খানিকটা আগেই আমরা গিয়ে হাজির হলাম বিমানবন্দরে। লটবহরগুলোকে একপ্রস্থ স্যানিটাইজ করার আমাদের পরিচয়পত্র সরেজমিনে পরীক্ষা করে তারপর ভিতরে প্রবেশাধিকার মিলল। আগে থেকেই চেক-ইন করা বাধ্যতামূলক, তাই সোজা ব্যাগপত্র বিমান কর্তৃপক্ষের জিম্মায় দিয়ে এবার বিমানে চড়ার অপেক্ষা। বিমানে ওঠার আগে এই করোনা মহামারির জন্য নতুন নিয়মে বেশ কাহিল হতে হল। মাঝের সিটের সব যাত্রীকে বাধ্যতামূলক পি.পি.ই কিট পড়িয়ে মাথায় মুখে ফেস শিল্ড, মাস্ক ইত্যাদি চড়িয়ে রীতিমতো সং সাজিয়ে বিমানে তোলা হল আমাদের। দীর্ঘ দু ঘন্টার বিমানযাত্রা শেষে নিজেদের ঠিকুজি-কুষ্ঠি এবং আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করে বিমান বন্দর থেকে মুক্তি পেলাম। আগে থেকেই উপস্থিত আমাদের গাড়ির চালক দীনেশজি। যাত্রা শুরু হল ছাপরের উদ্দেশে। পথে একটু ভোজন সেরে জয়পুরের কিছু কেল্লা ঘুরে রাতে পৌঁছলাম আমাদের তাল ছাপরের মাথা গোঁজার ঠাঁই র্যাপটর্স ইনে। মালিক অতুলজি একতলায় নিজে পরিবার নিয়ে থাকেন এবং উপরে দুটো তলায় পাঁচটি ঘরে অতিথিদের থাকার জায়গা। আগে থেকেই ঘর স্যানিটাইজ করা। করোনার জন্য শুধু দোতলা ও তিনতলায় একটি করে ঘর খোলা আমরা পৌঁছে ডিনার করলাম বাজরার রোটি, বাটার পনির, আলু বেগম বাহার দিয়ে। সাথে ছিল অসাধারণ একটা চাটনি স্থানীয় সবজি কারি, রসুন আর লাল লঙ্কা সমপরিমাণে মিশিয়ে বেটে তৈরি। রাত ৯ টার মধ্যে আমাদের ঘুমোতে বলে দিয়েছিলেন অতুলজি, কারণ ভোর-ভোর আমাদের বেরোতে হবে জঙ্গলের উদ্দেশে।
পরদিন ভোর ভোর চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম তাল ছাপার ব্ল্যাকবাক স্যাংচুয়ারির উদ্দেশে। এখানে প্রচুর পরিমাণে raptors অর্থাৎ শিকারি পাখি পাওয়া যায়। বলা যায় এই জায়গাটাই আমাদের এখানে আসার অন্যতম কারণ। সকাল থেকেই এখানে পাখির খেলা শুরু হয়ে যায়। এন্ট্রি পয়েন্টে ৩৩০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। এই টিকিট সারাদিনের জন্য বৈধ। আমরা ব্রেকফাস্টের আগে অবধি থেকে সেখান থেকে ব্রেকফাস্ট করে ফিরে যাব গো-শালা বলে একটি জায়গায়, যেখানে পাওয়া যায় ‘স্পাইনি টেইল্ড লিজার্ড’ যা এই শিকারি পাখিদের প্রিয় খাদ্য। এখানে প্রবেশমূল্য ২০০ টাকা, সারাদিনের লাইসেন্স। আজকে আমাদের গাইড শ্রবণজি, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভদ্রলোক আমাদের পাখি দেখালেন। শুধু দেখানো না, ভালো ছবি তোলার ব্যাপারেও সাহায্য করতে চেষ্টা করে গেলেন। অভয়ারণ্যের নাম যখন কৃষ্ণসার অভয়ারণ্য, তখন বলাই বাহুল্য এখানে কৃষ্ণসারের পরিমাণ প্রচুর।
আর কোনও শিকারি জন্তু না থাকায় এদের সংখ্যাও কমেনা সেভাবে। স্থানীয় মানুষরাও খুব যত্ন করে এদের। এছাড়া পাওয়া গেল ইন্ডিয়ান গেজেল বা চিঙ্কারা, ডেজার্ট ফক্স, জারবিল।
পাখিদের মধ্যে, আগেই বলেছি, শিকারি পাখিই বেশি; যাদের মধ্যে রয়েছে লাগার ফ্যালকন, কমন কেস্ট্রেল, বাজার্ড ও বিভিন্ন রকমের ইগল। সারাদিন এই অভয়ারণ্য এই পশু-পাখিদের কাণ্ডকারখানায় মুখর হয়ে থাকে। সকাল-সকাল দেখা যায় পুরুষ কৃষ্ণসারদের নিজের অঞ্চল সুরক্ষিত রাখার জন্য শিঙে শিঙ লাগিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন। কখনও বা প্রাণের আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াতেও দেখা যায় এদের।
এরই পাশাপাশি চলে শিকারি পাখিদের নিজেদের খাদ্যের খোঁজ। অপেক্ষাকৃত ছোট পাখি, যারা এদের শিকার, তাদের পালিয়ে বাঁচার লড়াইও চলে। অনবরত চলতে থাকে খাদ্য-খাদকের টিকে থাকার যুদ্ধ। দুদিন এখানে সময় কাটিয়ে আমরা ২১ তারিখ রওনা হলাম বিকানিরের উদ্দেশ্যে সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে রয়েছে মৃতদেহ ফেলার একটি অঞ্চল। সেখানেই নিয়ম করে এসে জড়ো হয় বিভিন্ন প্রজাতির শকুন, তবে শীতকালে এরা বেশি আসে।
সেখান থেকে আমরা রওনা দিলাম খিচান বলে একটি গ্রামে। এই অঞ্চলে সেবারাম মালি বলে একজন ব্যক্তি আছেন যিনি দীর্ঘ বিশ বছর ধরে একই ভাবে সেবা করে যাচ্ছেন সুদূর কৃষ্ণ সাগর, চীন, মঙ্গোলিয়া থেকে আসা ডেমইসেল ক্রেন নামক পরিযায়ী পাখিদের, স্থানীয়দের কাছে যা কুর্যা নামে পরিচিত। সকাল থেকে বিকেল অবধি পাখিরা যেন সেবারামজির কথামতোই খাওয়া দাওয়া করে। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে একটি ফিডিং গ্রাউন্ড অর্থাৎ খাবার দেয়ার জায়গাও বানিয়ে ফেলেছেন, সেখানে রোজ সকালে নিয়ম করে হাজারে হাজারে কুর্যা পাখি দানা খেতে আসে। এ দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। "অতিথি দেবো ভব:" এই মন্ত্রকে যেন জীবনের আদর্শ করে রেখেছেন সেবারামজি। সরকারি বেসরকারি অনেক সংস্থা এই কাজের জন্য তাঁকে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করেছে।
একটা মন ভালো করা সময় কাটিয়ে আমরা পরদিন রওনা হলাম আমাদের অন্তিম গন্তব্য ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সবুজের রেশ কমতে কমতে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে, চারিদিকে শুধু বালি আর বালি। কখনও সখনও দেখা মিলছে উট আর কাঁটা গাছের।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চলে এলাম থর মরুভূমির একদম প্রাণকেন্দ্র স্যাম গ্রামে। সেখানে আমাদের কটেজ বানজারা ক্যাম্প। দুপুরের খাবার সেরে বেরিয়ে পড়লাম ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে।
এখানে আসার কারণ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাওয়া রাজস্থানের রাজ্য-পাখি গোদাবন বা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, যেভাবে এই পাখির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে তাতে ২০২৫ এর মধ্যে রাজস্থানকে নতুন রাজ্য-পাখি নির্বাচন করতে হবে। মানুষের লোভ আর দখলদারি এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে পাখিরা তার বাসস্থান হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এমনিতেই এরা খুব লাজুক প্রকৃতির হয়। এদের প্রজননকালও খুব স্বল্পমেয়াদি। তাই প্রজননকালে সামান্যতম গোলমাল এদের বংশবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শুরুর দিন থেকেই দেখা মিলল গোদাবনের। চক্ষু সার্থক হল - এক সাথে পাঁচটি। এক কথায় এখানে আসা সার্থক হয়ে গেল। গোদাবন ছাড়াও সিনেরাস ভালচার, গ্রিফোন ভালচার, ট্রাম্পেটার ফিঞ্চ, স্যান্ড গ্রাউজ, স্টেপ ইগল, টনি ইগলের দেখা মিলল।
দীর্ঘ ঘরবন্দী থাকার পর এমন সফল সফর বহুদিনের ক্লান্তিতে একটু প্রলেপ দিল। দশ দিনের সফর থেকে অনেকটা অক্সিজেন নিয়ে ফিরে এলাম নিজের রাজ্যে, নিজের ঘরে।
.......................................................
..................................
[ছবি : লেখক]
#Travel #Travelogue #Rajasthan #Birds #Biodiversity # Great Indian bustard # Laggar falcon #Chinkara #krishnasar deer #Tawny eagle # Steppe eagle #ভ্রমণ #ভ্রমণকাহিনি #রাজস্থান #পাখি #সপ্তর্ষি দাশগুপ্ত #সিলি পয়েন্ট