বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (ষষ্ঠ পর্ব)

অর্পণ পাল Jan 6, 2024 at 5:18 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পর্ব ৬। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল-এর কথা

........................

তড়িৎ আর চুম্বক যে একই মুদ্রার দুটো আলাদা পিঠ, এটা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েই গিয়েছিল ফ্যারাডের হাত ধরে। ‘ক্ষেত্র’ বা ফিল্ড ধারণারও সূচনা হয় তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই। আহিত (চার্জড) বা চৌম্বকীয় বস্তু ত্রিমাত্রিক যে স্থানের মধ্যে অবস্থান করে, সেই স্থানেরই মধ্যেকার বিশেষ একটা এলাকাকেই ‘ক্ষেত্র’ বলে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়ে থাকে। যে ক্ষেত্রের মধ্যে অন্য কোনও চার্জযুক্ত বস্তু বা চৌম্বকীয় বস্তুকে আনা হলে সে একটা টান অনুভব করে। সে টান আকর্ষক হতে পারে, বা বিকর্ষক। 

কিন্তু এই চার্জ বা চুম্বকের উপস্থিতিতে তৈরি হওয়া দু-ধরনের ক্ষেত্র কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে বিশেষ পরিস্থিতিতে, আর সেটা ঘটলে তার ফল কী হতে পারে, সেটাকেই নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়মের বাঁধনে বেঁধে দেখালেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। সে গাণিতিক পদ্ধতি এতটাই যুগান্তকারী যে ওই ঘটনাকে পরে মেনে নেওয়া হয়েছে উনিশ শতকের পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় কীর্তি হিসেবে। এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। 


২. 

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (জন্ম ১৮৩১) ছিলেন স্কটল্যান্ডের এক বিরাট ধনী-জমিদার পরিবারের মানুষ। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী, তবে মাত্র আট বছর বয়সে তিনি মা-কে হারান। ছোট থেকেই তাঁর অজানাকে জানবার বা বিভিন্ন দৈনন্দিন ঘটনার পেছনের আসল কারণ খুঁজে বের করার আগ্রহ ছিল প্রবল। পারিবারিক প্রথা মেনে তাঁর প্রাথমিক পড়াশুনোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল বাড়িতেই। পরে তাঁর বছর দশেক বয়সে তাঁকে স্কুলে ভরতি করা হয়। এই স্কুলে থাকাকালীন সময়েও তিনি বইয়ের পাতা থেকে যা শিখতেন, সেগুলো বাস্তবে ঘটে কি না তা দেখার জন্য হাতেকলমে করে দেখায় উৎসাহ ছিল খুব। স্কুলে পড়ার সময়েই মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এরপরেও তাঁর একাধিক পেপার প্রকাশিত হতে থাকে ওই অল্প বয়সেই। 

সতেরো বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল ভরতি হন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছর তিনেক এখানে থেকে প্রাকৃতিক দর্শন নিয়ে পড়বার পর তিনি গণিত নিয়ে পড়াশুনো করেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। বিজ্ঞানের ইতিহাস আর অতীতের বিজ্ঞানীদের কাজ সম্বন্ধে নিয়মিত পড়াশুনো করতেন তিনি। ১৮৫০ সালে তাঁর সঙ্গে মোলাকাত হয় স্যার উইলিয়াম থমসন-এর। যিনি পরবর্তীকালে লর্ড কেলভিন নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন (উষ্ণতার একটি একক ‘কেলভিন’-এর নামকরণ করা হয়েছে তাঁরই নামে)। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাব্বিশ বছরের এই তরুণ অধ্যাপক ততদিনে ফ্যারাডে-র তড়িৎচুম্বকীয় আবেশ সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলো নিজের হাতে করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনিই ম্যাক্সওয়েলকে উৎসাহিত করেন, যাতে তিনি তাঁর গ্যালোওয়ে-র প্রাসাদোপম বাড়িতে চৌম্বকীয় বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। 

কেমব্রিজ থেকেই ম্যাক্সওয়েল গণিতে শিক্ষণ সমাপ্ত করেন ১৮৫৪ সালে। আর এই সময় থেকেই তাঁকে আকর্ষণ করতে থাকে ফ্যারাডে-র তড়িৎ প্রবাহ এবং চৌম্বকীয় নানাবিধ ঘটনা। ওই ১৮৫৪ সালেই এই বিষয়ে তাঁর প্রথম পেপার ‘অন ফ্যারাডে’স লাইন অভ ফোর্স’ প্রকাশিত হয়। এই বিষয়টা নিয়ে তিনি এতটাই মেতে ওঠেন যে ওই সময়ে তিনি আবার গেলেন লর্ড কেলভিনের কাছে, যাতে গবেষণার কাজে কিছু সাহায্য মেলে। অবশ্য কেলভিন ততদিনে মেতে উঠেছেন অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে। সে প্রসঙ্গে আমরা আসব পরের অংশেই। 


৩. 

আসলে জেমস ম্যাক্সওয়েল এই তড়িৎচুম্বকীয় কাজকর্ম নিয়ে মেতে ওঠবার সময়টা বেছেছিলেন একদম ঠিকঠাক। ওই সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের তড়িৎ বা চৌম্বকীয় ঘটনা নিয়ে পড়াশুনো করবার বা গবেষণা করবার কোনও ব্যবস্থা তো ছিলই না। যে ক-জন এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করছিলেন, সকলেই তাঁদের কাজ ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সম্পন্ন করতেন। ঠিক কেন তিনি ওই সময়টায় ইউরোপে যে ধরনের বিষয় নিয়ে চর্চা হচ্ছিল, সে সব থেকে একদম আলাদা একটা বিষয় নিয়ে মেতে উঠলেন ম্যাক্সওয়েল, তার একটা জবাব হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে তিনি মূলত উৎসাহ পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে, এবং কিছুটা লর্ড কেলভিনের সঙ্গে আলাপের পরেও। কারণ উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের ওই সময়টায় ইউরোপে একটা বড় ব্যাপার ঘটে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে একটি চুক্তি হয় সে দেশের ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ সিস্টেম নিয়ে কাজ করছিল এমন এক কোম্পানির, যাতে লন্ডনের সঙ্গে অন্য বড় শহরের মধ্যে কেবলের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। টেলিগ্রাফের সাহায্যে বার্তা প্রেরণ করা নিয়ে আমরা কিছু কথা আমরা এই ধারাবাহিকের প্রথম দিকেই বলেছিলাম, তবে এই ব্যবস্থার বেশ কিছু অসুবিধা এই সময় লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। পাশাপাশি আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করবার যে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছিল সেই দেশ (ইংল্যান্ড), যে দেশের নীচ দিয়েই চলে গিয়েছিল বিশ্বের প্রথম টেলিগ্রাফের তার। ইউরোপের অন্য দেশে তখনও মাথার ওপর দিয়ে তার টেনে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তাই ইংল্যান্ডই টের পেয়েছিল যে সমুদ্রের নীচ দিয়ে পাতা তারের মধ্যে দিয়ে বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে কী কী অসুবিধে হতে পারে। 

এইরকম কিছু সমস্যার দিকে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সেই মাইকেল ফ্যারাডে-ই। ১৮৫৩ সালের দিকে ফ্যারাডে জানতে পারলেন যে লন্ডন আর ম্যানচেস্টারের মধ্যে যে কেবল লাইন পাতা রয়েছে, সেখান দিয়ে বার্তা যাওয়ার সময় বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে। ফ্যারাডে বুঝলেন, এই সমস্যার সমাধান করতে পারলে তার তড়িৎচুম্বকীয় আবেশ বিষয়টাকে জনগণের কাছে পরিচিত করে ফেলা যাবে। 

মাস কয়েক বাদে ফ্যারাডে রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে ব্যাখ্যা দেবেন, কীভাবে জলের নীচ দিয়ে বার্তা এগিয়ে যাওয়া বাহক-কেবলের তারের ধারকত্ব সামুদ্রিক জলের প্রভাবে বেড়ে যায়, এবং এরই ফলে তড়িৎচুম্বকীয় আবেশ কমে যায় বলেই সিগন্যাল বা বার্তা যেতে দেরি হতে থাকে। 


৪. 

ফ্যারাডে-র ওই বক্তৃতা থেকে দু-জন মানুষ খুবই উপকৃত হয়েছিলে, একজন অবশ্যই ম্যাক্সওয়েল, অন্যজন লর্ড কেলভিন। এই কেলভিন সাহেব তো এরপর এক ব্রিটিশ টেলিগ্রাফ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার মধ্যে টেলিগ্রাফিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলবার কাজে বেশ বড় ভূমিকা নেন, যার ফলে পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি এই সংক্রান্ত বেশ কিছু পেটেন্ট নিয়ে বহু টাকা উপার্জন করে নিয়েছিলেন। উইলিয়াম থমসন থেকে অভিজাত লর্ড কেলভিন হয়ে ওঠার পথে এই ঘটনা খুব বড় সাহায্য করেছিল তাঁকে। 

অন্যদিকে আমাদের মনে এই প্রশ্নও আসে যে ঠিক ওই সময়েই কেন ম্যাক্সওয়েল তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে কাজ করতে মেতে উঠলেন? তখনকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কেমব্রিজ থেকে গণিত নিয়ে পড়াশুনো করা কেউ এই বিষয় নিয়ে ভাবতেনই না। পদার্থবিদ্যার ছাত্ররা বেছে নিতেন মূলত গতিবিদ্যা, আলোকবিদ্যা বা উদস্থিতিবিদ্যা-র (যেখানে জল বা অন্যান্য তরলের গতি নিয়ে চর্চা করা হয়) মতো প্রচলিত কিছু বিষয়কে। আর তখনকার ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পদার্থবিদ্যার গবেষণার জন্য কোনও পরীক্ষাগারও ছিল না। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে তিনি এই সম্পূর্ণ অপরিচিত বিষয়টা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন বলেই আবিষ্কৃত হতে পেরেছিল অত বড় মাপের একটা তত্ত্ব। 

১৮৫৬ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার বছর দুয়েক পর তিনি বিয়ে করেন। ওই সময় ম্যাক্সওয়েল গবেষণা করছিলেন অন্য আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে, যার মধ্যে ছিল শনি গ্রহের বলয়, রঙিন ছবি তোলার উপায় এরকম বৈচিত্র্যময় সব প্রসঙ্গ। ১৮৬০ সালে, উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে অধ্যাপনার কাজ পান, কিন্তু বছর পাঁচেক বাদে তাঁকে সেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়; মনে করা হয় যে ক্লাস সামলানোয় তাঁর অদক্ষতা আর পড়ানোয় অক্ষমতার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। 

এটা অবশ্য তাঁর পক্ষে ভালোই হয়েছিল, কারণ দেখা যায় যে প্রায় সমস্ত তড়িৎ এবং চুম্বক নিয়ে তাঁর আবিষ্কারগুলো এই ১৮৬৫ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে ঘটেছিল।  শাপে বর হওয়া বোধ হয় একেই বলে! অবশ্য বছর ছয়েক বাদে, ১৮৭১ সালে তিনি কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির অধ্যাপক নিযুক্ত হন, এই পদেই আমৃত্যু ছিলেন। ওই সময়ে তিনি দুটো বই লেখেন: ‘দ্য থিওরি অভ হিট’ আর ‘ট্রিটিজ অন ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম’, পরে বইগুলো খুব বিখ্যাত হয়েছিল। 

১৮৭৯ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মায়েরও এই একই বয়সে, একই রোগে মৃত্যু হয়েছিল, চল্লিশ বছর আগে। 


   তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বের জন্ম ও তারপর 

১৮৬৫ সালের জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখে ম্যাক্সওয়েল তার এক আত্মীয় চার্লস কেয় (Charles Cay)-কে প্রথমবার জানালেন তাঁর এই আবিষ্কারের কথা: ‘I have also a paper afloat, with an electromagnetic theory of light, which, till I am convinced to the contrary, I hold to be the great guns.’ যদিও ‘A dynamical theory of the electromagnetic field’ নামে বিখ্যাত ওই পেপারটা তাঁর লেখা শেষ হয়েছিল কয়েক মাস আগেই, এবং রয়্যাল সোসাইটির সভায় সেটা পাঠ করাও হয় আগের বছরের ডিসেম্বরে। এর পর ওই বছরের জুন মাসের ১৫ তারিখে পেপারটি প্রকাশের জন্য মনোনীত হয়। বছরের শেষ দিকে নভেম্বরের তিরিশ তারিখে অবশেষে ইউরোপের প্রথম সারির পত্রিকা ‘ফিলোসফিক্যাল ট্র্যানজ্যাকশনস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি’-তে লেখাটি প্রকাশিত হয়, আর বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঘটে যায় উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। 

মোটামুটি ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে ম্যাক্সওয়েল গুছিয়ে ফেলেছিলেন এই সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার সারমর্ম। যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ওই ১৮৬৪ সালে, যখন তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকতত্ত্ব সংক্রান্ত কয়েকটি সমীকরণকে একসঙ্গে সংযুক্ত করে তিনি বানিয়ে ফেলেন চারটে সমীকরণ, যেগুলো ক্রমে হয়ে দাঁড়াল পদার্থবিদ্যার এক একটি দিকস্তম্ভ। এগুলোকেই বলা হয় ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্র সমীকরণ। তিনিই প্রথম বললেন যে কম্পমান তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্রের মিলনে তৈরি হয় এক তরঙ্গ, যার একটা ছোট্ট অংশ হল আলো। যে আলো তার বহুবর্ণতা নিয়ে আমাদের সামনে বস্তুজগতকে দৃশ্যমান করে তোলে, চারপাশকে আলোকিত করে রাখে, সেই আলো আসলে তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্রের মিশ্রণে তৈরি হওয়া এক ধরনের তরঙ্গ। শুধু আলো নয়, আরও অনেক রকমের তরঙ্গ আমাদের চারপাশে ব্যপ্ত হয়ে আছে— মহাবিশ্ব পরিব্যপ্ত হয়ে আছে বিবিধ তরঙ্গের ঝর্ণাধারায়। 

ম্যাক্সওয়েল আরও বললেন যে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়েও প্রবাহিত হতে পারে, কারণ যেটাকে আমরা শূন্যস্থান বলে জানি, সেখানেও আছে ‘ইথার’ নামে এক গ্যাসীয় বস্তুর উপস্থিতি। এই ইথার মাধ্যমের ধারণা অনেক আগে থেকেই ছিল, যদিও উনিশ শতকের শেষ দিকে কয়েকটা পরীক্ষার মাধ্যমে এর অস্তিত্ব মুছে যায়। মহাশূন্যে ইথার বলে কিছু নেই, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। তবু ম্যাক্সওয়েলের কাজের গুরুত্ব একটুও কমে যায় না সে জন্য। 

এখানে এটাও বলে নেওয়া দরকার যে ম্যাক্সওয়েলের এই বিখ্যাত কাজের পেছনে অনেকটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল ব্রিটিশ টেলিগ্রাফ প্রেরণ ব্যবস্থার নানা খুঁটিনাটি। ওই একই কাজে যুক্ত ছিলেন লর্ড কেলভিনও, অথচ তাঁর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে তাঁর চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা ছোট ম্যাক্সওয়েল বানিয়ে ফেলেন মহান এই আবিষ্কারের ইমারত। আর মজার ব্যাপার, ম্যাক্সওয়েল প্রয়াত হওয়ার বছর পাঁচেক বাদে ১৮৮৪ সালে এই লর্ড কেলভিনই দাবি করেন যে তিনি ম্যাক্সওয়েলের অনেক আগে থেকেই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সম্বন্ধে জানতেন! আসলে তিনি তারের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রিক-বার্তার সঙ্গে শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর এই ভ্রান্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন ম্যাক্সওয়েলেরই এক ছাত্র জর্জ ফিৎজেরাল্ড। 

যাই হোক, একটু আগেই ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ম্যাক্সওয়েলের যে ‘A Treatise on Electricity and Magnetism’ নামের বিখ্যাত বইটির কথা বলেছিলাম, সেটা পড়বার পরেই মূলত স্যার অলিভার লজের মতো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে আরও বেশি করে কাজ করতে। ম্যাক্সওয়েল সাহেব নিজে কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গর ধর্ম বা নানান বৈশিষ্ট্য বা এর চরিত্র নিয়ে অনেক কথা জানাতে পারলেও এই তরঙ্গ কীভাবে তৈরি করা যেতে পারে, সেটা দেখিয়ে যেতে পারেননি। 

ম্যাক্সওয়েলের সেই খামতি-পূরণেই যেন এগিয়ে এসেছিলেন অলিভার লজ, হেইনরিখ হার্জ, জর্জ ফিটজেরাল্ড, অলিভার হেভিসাইড বা আমাদের দেশের জগদীশচন্দ্রের মতো এক দল বিজ্ঞানী। এঁরা সবাই-ই বলতে গেলে ম্যাক্সওয়েলেরই এই সংক্রান্ত কাজের উত্তরসূরি। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে পরবর্তী যুগের গবেষণায় জগদীশচন্দ্রের ভূমিকাকে বুঝতে গেলে আগে তাঁর সমসাময়িক এই বিজ্ঞানীদের কাজ বা অবদান সম্বন্ধে অল্প কিছু কথা বলে নেওয়া জরুরি। সে ব্যাপারে আমরা আসব, পরের পর্বে। 

[‘Nature’ পত্রিকায় ১৬ই মার্চ, ২০১১ সংখ্যায় Simon Schaffer-এর লেখা The Laird of Physics নিবন্ধটি থেকে এই পর্বের বেশ কিছু তথ্য নেওয়া হয়েছে] 

...................

আগের পর্ব পড়ুন : বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (পঞ্চম পর্ব)



#Jagadish Chandra Bose #Radio #Radiowave #জগদীশচন্দ্র বসু #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

32

Unique Visitors

215001