বাংলার প্রথম কো-এডুকেশন স্কুল : শান্তিনিকেতনে সহশিক্ষা প্রচলনের বিতর্কিত অধ্যায়
শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কেটে গেছে প্রায় সাত বছর। ১৯০৮ সাল নাগাদ এই বিদ্যালয়েরই ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক বালিকা বিদ্যালয়ও। বালিকা বিদ্যালয় বলতে মেয়েদের জন্য কোনও স্বতন্ত্র স্কুল শান্তিনিকেতনে ছিল না। মেয়েরা একটি আলাদা বোর্ডিংয়ে থাকত এবং ছেলেদের সঙ্গে একই ক্লাসে বসে পড়াশোনা করত। আসলে আশ্রমে পড়ুয়া-বয়সের মেয়েদের অভাব ছিল না। সেসময় শান্তিনিকেতনের আশ্রমেই বাস করছিলেন রাজলক্ষ্মী দেবী, দীপেন্দ্রনাথের স্ত্রী হেমলতা দেবী, দিনেন্দ্রনাথের স্ত্রী কমলাদেবী, সুবোধ মজুমদারের স্ত্রী, কন্যা লতিকা, জগদানন্দ রায়ের কন্যা দুর্গেশনন্দিনী, তরুলতা, পারুল, সুধীন্দ্রনাথের কন্যা রমা দেবী, কবির বড় মেয়ে মাধুরীলতা, আর ছোট মেয়ে মীরা। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই মেয়েদের পড়ানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে যখন, প্রসন্নকুমার সেনের দুই মেয়ে, অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে সাগরিকা এবং আরো অনেকেই এই পড়ুয়া দলে নাম লেখায়। এভাবে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের একটি অংশ হিসেবেই শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাথমিক সূত্রপাত।
বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন মোহিতচন্দ্র সেনের স্ত্রী সুশীলা দেবী। তাঁর দুই কন্যা মীরা ও উমাও ছিল এই বিদ্যালয়েরই ছাত্রী। ছাত্র-ছাত্রী একই সাথে বসে পড়াশোনা করলেও আশ্রমে মেয়েদের অবাধ ঘোরার অনুমতি সে সময় ছিল না। তবে খুবই স্বল্প সময়ের জন্যই এই ব্যবস্থাপনা নিরুদ্বেগে চলতে পেরেছিল। সহশিক্ষা তখনও বাংলার কোন স্কুলেই চালু হয়নি। শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের একবছরের মধ্যেই নানারকম সমস্যা দানা বাঁধতে থাকে। বিদ্যালয়ের কিশোর কিশোরীদের একই সঙ্গে লেখাপড়া ও সময় কাটানোকে ঘিরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষত আশ্রমকন্যা লাবন্যলেখার সঙ্গে অজিতকুমার চক্রবর্তীর প্রণয় ও বিবাহ সমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। এমনকি আশ্রমের এক ছাত্র সরোজ মজুমদারের মৃত্যু নিয়েও নারীঘটিত কদর্য পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। মেয়েদের উপস্থিতি আশ্রমের পরিবেশকে নষ্ট করছে এই অভিযোগের ভিত্তিতে অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ১৯১০ সালে বালিকা বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক প্রচেষ্টাটি অঙ্কুরে বিনষ্ট হলেও পুনরায় দ্বিতীয় অবকাশ তৈরি হয় ১৯২২ নাগাদ। এবার বোর্ডিংয়ের দায়িত্ব নেন কবি বিহারীলাল গুপ্তের কন্যা স্নেহলতা দেবী। তাঁর কন্যা মালতী ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা মঞ্জুশ্রী এই দুজন ছিলেন বোর্ডিংয়ের প্রথম ছাত্রীদ্বয়। পরে ছাত্রী সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় মেয়েদের বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন হেমন্তবালা দেবী। ১৯৩৪ সালের দিকে এই বোর্ডিংয়ে প্রণেত্রী ও পরিদর্শিকা পদ দুটি তৈরি করা হয়। যার দায়িত্বে ছিলেন প্রতিমাদেবী ও হৈমন্তীদেবী। পরবর্তীকালে মিস বোসেনেক, মার্জোরি সাইকস, মেরি বার- এর মত বিদেশিনীরাও বোর্ডিংয়ের তত্ত্বাবধায়ক হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : আমেরিকা থেকে উপহার হিসেবে এসেছিল শান্তিনিকেতনের প্রথম ছাপার মেশিন
শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এর মূল স্বাতন্ত্র্যের দিকটি ছিল সহশিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রথমবারের মতই দ্বিতীয় উদ্যোগের ক্ষেত্রেও আশ্রমে বালক বালিকাদের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা ছিল একইসঙ্গে। এমনকি খেলার মাঠে ভলিবল, হকি, লাঠিখেলা থেকে শুরু করে স্নেহলতা দেবীর উৎসাহে বয়েজ স্কাউটের মত গার্ল-গাইড দলও তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ এদের নাম রাখেন গৃহদীপ। পরে অবশ্য এই মেয়েদলের নাম বদলে হয় সহায়িকা। বোর্ডিংয়ের মেয়েরা অল্পদিনের মধ্যেই ‘কণিকা’ নামে একটি সাহিত্যসভাও শুরু করে। এই সাহিত্যসভার উদ্যোগে মেয়েরা ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’, ইংরেজি নাটক Pied Piper, ‘বিসর্জন’-এর ইংরেজি অনুবাদ ‘The Sacrifice’ মঞ্চস্থও করেছিল।
আরও পড়ুন : শান্তিনিকেতনের পড়ুয়াদের জন্য ইংরেজি নাটক লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
যে সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে ১৯১০ সালে আশ্রমে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছিল, মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে তা সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের ডালপালা মেলতে শুরু করে। এই বছর দশ-পনেরোর মধ্যে শান্তিনিকেতনের জীবনে যে পরিবর্তন ঘটে গেছে, বালিকা বিদ্যালয়ের সাফল্য তারই ইঙ্গিতবাহী। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি এবং বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা, বালিকা বিদ্যালয়ের সফলতায় অনুঘটকের কাজ করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সঙ্গে বিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর সংযোগ সহশিক্ষার পরিসরকে অনেক সহজ ও সাবলীল করে তোলে। বিশের দশকের বদলের হাওয়ায় বিগত অধ্যায়ের অসমাপ্ত উদ্যোগ ধীরেধীরে সফলতায় উত্তীর্ণ হতে দেখা যায়। এভাবেই পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের দরবারে বারে বারে প্রমাণ করতে থাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব আর তার সক্রিয় অংশীদারিত্ব শক্ত হাতে ধরে রাখে আশ্রমকন্যারা।
********************************