নিজের লেসবিয়ান সত্তাকে লুকিয়ে রাখেননি বিশ্বের প্রথম পেশাদার মহিলা লেখক আফ্রা বেন
“সব মহিলার উচিত একসঙ্গে আফ্রা বেনের সমাধিতে গিয়ে ফুল দিয়ে আসা, কারণ তিনিই প্রথম নারী যিনি মনের কথা বলার অধিকার অর্জন করেছিলেন”, ‘A Room for One’s Own’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ।
উলফের মতে, জেন অস্টেন থেকে শুরু করে ব্রন্টি-বোনেরা (চার্লট ব্রন্টি ও এমিলি ব্রন্টি), জর্জ এলিয়ট (আসল নাম মেরি অ্যান ইভানস, সাহিত্যরচনায় সুবিধার জন্য পুরুষের নাম নিতে হয়) বা মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত নারী-লেখকরা অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কিংবদন্তীর স্তরে পৌঁছতে পারেননি শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। যদি নিজস্ব একটা ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তাহলে নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারত। কিন্তু এঁদেরও অনেক আগে পেশাদার লেখক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করার সাহস দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ কবি-নাটককার আফ্রা বেন (Aphra Behn)। এই কারণেই উলফ আফ্রাকে নারীবাদী আলোচনায় অগ্রগণ্য বলে মনে করেছেন। সে সময় শুধু লেখালেখি করেই তিনি স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। বিপুল জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁকেই প্রথম পেশাদার নারী সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয়।
আফ্রা বেন জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের ক্যান্টাবেরির কাছে ১৬৪০ সালের ১৪ ডিসেম্বর। পৈতৃক নাম আফ্রা জনসন। তাঁর শৈশব-কৈশোরের সময়টা ছিল ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের সময়। ধারণা করা হয়, তিনি ১৬৬৩-৬৪ সালের দিকে আফ্রিকার সুরিনামে ছিলেন। আর সেখানেই তিনি অরুনোকোর কাহিনী বর্ণনাকারীর দেখা পান। ১৬৬৪ সালে লন্ডনে ফিরে তিনি মিঃ বেন নামের এক বণিককে বিয়ে করেন। মিঃ বেন ১৬৬৫ সালে মারা যান। তবে অনেকে মনে করেন, আফ্রা আত্মরক্ষার স্বার্থে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করতেন, বাস্তবে তিনি বিয়েই করেননি। কিছুদিন তিনি ব্রিটিশরাজ দ্বিতীয় চার্লসের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিলেন। গুপ্তচর হয়ে বিদেশেও গেছিলেন বলে জানা যায়। তবে দেশে ফেরার টাকা না পেয়ে টাকা ধার করেন এবং ঋণের দায়ে তাঁকে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। লেখালিখির দুনিয়ায় আসার আগেই এত্রকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ফলে তিনি যে কখনোই নিরাপদ ভীতু জীবন বেছে নেবেন না সেটাই স্বাভাবিক। গুপ্তচরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি নাটক লেখায় মনোনিবেশ করেন। নিজে লিখে নিজের বেঁচে থাকার রসদ জোটাবেন - তখনকার দিনে এমন ঘটনা অভাবনীয় বললেও কম বলা হয়।
আফ্রার প্রথম নাটক ছিল ‘দ্য ফোর্সড ম্যারেজ’ (১৬৭০), যা তাঁকে খ্যাতি ও অর্থ, দুই-ই এনে দেয়। ১৬৭১ সালে মঞ্চস্থ হয় ‘দি আমোরাস প্রিন্স’। এরপর একে একে ‘দ্য ডাচ লাভার’ (১৬৭৩), ‘আবদেলাজার’ (১৬৭৬), ‘দ্য টাউন ফপ’ (১৬৭৬), ‘দ্য ডেবাউচে’ (১৬৭৭), ‘দ্য কাউন্টার ফিট ব্রাইডগ্রুম’ (১৬৭৭)-এর মতো বেশ কয়েকটি সফল নাটক রচনা করেন। তাঁর সবচেয়ে সফল নাটক ১৬৭৭ সালে মঞ্চস্থ করা ‘দ্য রোভার’। তাঁর লেখা সতেরোটি নাটক লন্ডনের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হলে সাড়া পড়ে যায়। পুরুষদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইংল্যান্ডের মেয়েরাও সে সময় তীব্র নিন্দা করেছিলেন আফ্রার। লেখক হিসেবে তাঁর কোনও ছুঁৎমার্গ ছিল না। ফলে যৌন প্রসঙ্গও খুব খোলাখুলি প্রকাশ করেছেন নিজের লেখায়। নিন্দিত হবার একটা বড় কারণ ছিল সেটাও।
তাঁর কবিতার বইয়ের মধ্যে ‘পোয়েমস আপন সেভারেল অকেশনস’ (১৬৮৪), ‘লাভ লেটারস বিটউইন এ নোবেল ম্যান অ্যান্ড হিজ সিস্টার’, ‘দি আমোরস অব ফিল্যান্ডার অ্যান্ড সিলভিয়া’ (১৬৮৭) উল্লেখযোগ্য। কবিতাতেও আফ্রা ছিলেন একইরকম সাহসী। এমনকী নিজের সমকামিতার কথাও গোপন রাখেননি তিনি। কবিতা, নাটকের বাইরে তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি রচনা হল আফ্রিকার দাস মালিকদের বিরুদ্ধাচরণ করে লেখা উপন্যাস ‘অরুনোকো’। আফ্রার মৃত্যুর এক বছর আগে ১৬৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি।
আরও পড়ুন : রাচেল কারসন : পরিবেশ-আন্দোলনের জননী / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়
মৃত্যুর আগে আফ্রা রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে ভুগেছিলেন। ১৬৮৯ সালের ১৬ এপ্রিলে মারা যান। তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়। যে বিশ্বে আজও নারীরা স্বাধিকার অর্জনের লড়াই লড়ছেন, সেখানে সপ্তদশ সতকে একজন নারী মাথা উঁচু করে নিজের শর্তে বেঁচে গেছেন - এ বড় কম কথা নয়। নারীবাদী আলোচনায় অনেকসময় অনুচ্চারিত থেকে যায় তাঁর নাম। কিন্তু অর্ধেক আকাশের অধিকারের জন্য যে লড়াই বয়ে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, তার ইতিহাস আফ্রা বেনকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব হবে না।
........................
#Aphra Behn #playwright #poet #Restoration era #Virginia Woolf # Westminster Abbey #The Rover #The Forc'd Marriage #The Dutch Lover #Feminism #নারীবাদ #Lesbian Literature #সমকাম #লিঙ্গসাম্য #Gender Equality #ব্যক্তিত্ব #টিম সিলি পয়েন্ট #silly পয়েন্ট