বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

অলির কথা শুনে

স্বপন ভট্টাচার্য Nov 10, 2020 at 8:21 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

সাম্প্রতিক একটা গবেষণা আমাদের ভীষণভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা। তিনি তো কবেই আমাদের জানিয়ে গেছেন – “অলির কথা শুনে বকুল হাসে…”! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কোন সন্দেহ নেই, তাঁর এই শতবার্ষিকীতেও অমলিন রয়ে গেছেন ওই অলির কথায় আর বকুলের হাসিতে। কিন্তু অলির দংশনেও যে বকুল হেসে ওঠে সে আর কে জানত যদি না সায়েন্স পত্রিকায় অতি সম্প্রতি প্রকাশিত ফোতেইনি পাশালিদৌ ও তাঁর সহকর্মীদের সাম্প্রতিকতম গবেষণাটি সামনে আসত।

মৌমাছির জীবনচক্র প্রায় সম্পূর্ণভাবে উদ্ভিদ থেকে আহৃত পুষ্টির উপর নির্ভরশীল। ফুলে ফুলে মধু খেয়ে আসলে যা মৌমাছি যা করে তা হল পরাগসঞ্চয়। ফুলের রেণু হল মৌমাছির মৌচাক বানানোর প্রথম শর্ত। উদ্ভিদের জীবনচক্রে ফুল ফোটার সময় নির্দিষ্ট। যে ঘড়িটিকে মেনে তাদের ডালে ডালে কুঁড়ির সঞ্চার হয়, প্রস্ফুটন ঘটে, বসে যায় ফুলের জলসা, সেই ঘড়িটি হল সূর্যঘড়ি। বছরের কোন সময়টায় কোন ফুল ফুটবে তা নির্ভর করে কোন সময়ে কতটা সূর্যালোক পাওয়া যাবে তার উপর। সৌরসময়, যা গাছকে ফুল ফোটানোর প্রণোদনা দেয়, তাকে বলে ফোটোপিরিয়ড (Photoperiod)। শীতকালে যে অ্যাস্টার, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকায় আপনার বাগান সেজে ওঠে এবং গ্রীষ্মে যে আপনি স্বাভাবিক পরিবেশে তাদের কথা বলাতে পারবেন না তার কারণ হল এরা হ্রস্ব দিনের গাছ; সূর্যালোক প্রাপ্তির সময়কাল শীতে কমে এলে তাদের গর্ভাধানের ঋতু আসে। দেখা গেছে, আসলে গাছ কতক্ষণ সূর্যের আলো পেল তা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার কতটা পেল। ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকা হল ‘খাটো দিনের উদ্ভিদ’ বা Short Day Plant। শীতের দীর্ঘ অন্ধকার কালের মধ্যেই রয়েছে এদের ফুল ফোটানোর বাহ্যিক এবং শারীরবৃত্তীয় সংকেত। অপরপক্ষে ‘বড় দিনের উদ্ভিদ’ বা Long Day Plants-এর ফুল ফোটানোর চাহিদা ঠিক উল্টো। এরা বারো ঘণ্টার বেশি দিনের আলো পেলে এবং অন্ধকার সময়কাল অপেক্ষাকৃত কম হলে তবেই ফুটে উঠবে, নতুবা নয়। পালং, লেটুস, আলু, নিম, জারুল ফুটে ওঠার এই হল শর্ত। কিছু গাছের ফুল সারা বছরই ফোটে, আলো আর অন্ধকার কালের হেরফের এদের ফুল ফোটানোর জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এরা হল ‘আলোক নিরপেক্ষ উদ্ভিদ’ বা Day Neutral Plant; ভুট্টা, শশা এরা হল এমন আলো-অন্ধকার পাত্তা না দেওয়া উদ্ভিদ। এসব ঠিক আছে, কিন্তু এতদিন যেটা জানা ছিল না তা হল এই যে, ফোটোপিরিয়ড অপরিবর্তিত থাকলেও মৌমাছিরা প্রয়োজনে গাছকে প্রায় বাধ্য করতে পারে ফুল ফোটাতে। এমনিতে মৌমাছির সঙ্গে উদ্ভিদের সম্পর্ক দেওয়া নেওয়ার। তুমি আমায় তোমার রেণু দাও, তোমার মধু দাও, আমি তোমার ফলধারণের, বীজধারণের এবং বংশ রাখবার ব্যবস্থা পাকা করে দেব – এই হল ‘অলির কথা’। কিন্তু এই সম্পর্ক এযাবৎ জানা ছিল কেবল ফোটা ফুলের সঙ্গে। ফুল না ফোটা উদ্ভিদের সঙ্গেও যে তার কিছু কথাবার্তা থাকতে পারে এ কথা জানা গেল এই প্রথম এবং ব্যবহারিক জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা এমন একটা উন্মোচন যার সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব থাকতে বাধ্য। 

আরও পড়ুন : মুখ ও মুখোশ / স্বপন ভট্টাচার্য

মৌমাছিদের অনেক প্রকরণের মধ্যে একটির নাম Bumble bee (Bombus terrestris), ইউরোপে মধুমক্ষিকা হিসাবে যার কদর আছে। শ্রমিক মৌমাছিরা নিজেদের এবং মৌচাকে পালিত হওয়া লার্ভা ও রানির জন্য ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে এ আমরা সবাই জানি। সমাজবদ্ধ জীব তারা। কোথায় আছে মধুভরা ফুলের সন্ধান, একটা গাছের কোন কোন ফুলে মধু আর পরাগ বেশি, কোন মঞ্জরী থেকে মধু আর পরাগরেণু সংগৃহীত হয়েছে আগেই আর কোন ফুল এখনও পূর্ণতা পায় নি – এসব খবর তারা নিজেদের মধ্যে চালাচালি করে ওড়ার ভঙ্গিমায় (bee dance) এবং রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে। কিন্তু যে গাছে ফুলই ফোটেনি, কুঁড়িও আসেনি তার সঙ্গে মৌমাছির লেনাদেনা নেই বলেই জানা ছিল। এই কারণে জুরিখে অবস্থিত সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ছাত্রী-গবেষক ফোতেইনি পাশালিদৌ ফুল না ফোটা গাছের আশেপাশে এদের ওড়াউড়ি দেখে অবাকই হয়েছিলেন প্রথমটায়। আর একটু নজর করে ফোতেইনি এও দেখলেন যে বেকার ওড়াউড়ি নয়, এই শ্রমিক মৌমাছিরা আসলে গাছগুলোর গায়ে ছোট্ট ছোট্ট অর্ধচন্দ্রাকৃতি ক্ষত তৈরি করে যাচ্ছে। ফোতেইনি দেখতে পান কামড় খাওয়া গাছগুলোতে ফুল এসে গেল সময়ের আগেই। এর পর ল্যাবরেটরিতেই পরীক্ষা সাজানো হল। অসময়ের টোম্যাটো ও কালো সর্ষের চারা নেওয়া হল দুটো সংরক্ষিত জায়গায়। মৌমাছিদেরও প্রতিপালন করা হল দু’ভাগে। একদলকে খুব করে জোগান দেওয়া হল এই দুই ফুলের পরাগরেণু আর অপর দলকে সম্পূর্ণভাবে পরাগে বঞ্চিত রাখা হল। বাগানের একটা অংশে বাড়তে দেওয়া গাছেদের সঙ্গে রেখে দেওয়া হল পরাগে পালিত মধুমক্ষিকাদের আর অপর অংশে রাখা হল পরাগের জোগান না পাওয়া তাদেরই জাতভাইদের। দেখা গেল পরাগে পালিত কমরেডরা গাছের গায়ে তেমন আঁচড়টাচড় কাটতে উৎসাহী নয়, কিন্তু পরাগে বঞ্চিত যারা, তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের মুখ-উপাঙ্গ ম্যান্ডিবলের সাহায্যে সর্ষে এবং টম্যাটো – দু’রকম গাছের পাতার গায়েই অর্ধবৃত্তাকার ক্ষত তৈরিতে। যেসব গাছে পাঁচ-ছ’টা এমন ক্ষত হয়েছে, তাদের গবেষকরা সরিয়ে আনলেন সংরক্ষিত অংশ থেকে গ্রিনহাউসে। দেখা গেল সর্ষেয় ফুল এসেছে সময়ের পনের দিন আগে আর টম্যাটোয় ফুল এসেছে সময়ের পাক্কা একমাস আগে। পরাগে পালিত মৌমাছিরা কিন্তু তাদের অংশের গাছগুলোতে এভাবে ফুল ফোটাতে পারেনি। গবেষকরা নিজেরাই কিছু গাছে মৌমাছির মত ক্ষত করে দিলেন ফরসেপ দিয়ে। দেখা গেল এই গাছগুলিতে অল্প হলেও স্বাভাবিকের তুলনায় আগে ফুল আসে কিন্তু কখনই এই প্রতিক্রিয়া মৌমাছির দংশনের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এটা যে কেবল গবেষণাগারের সীমায়িত পরিবেশের প্রতিক্রিয়া নয় তা জানার দরকার ছিল, সুতরাং জুরিখের ইন্সটিটিউটের ছাদে বাগান বানালেন ফোতেইনিরা। মৌমাছির দল যেখানে বাসা বেঁধেছে তার কাছাকাছি রাখলেন তাদের পছন্দের এখনো ফুল-না-ফোটা উদ্ভিদের চারা আর দূরে দূরে অন্যান্য অনেক গাছ যার কিছু কিছু থেকে চাইলেই মৌমাছিরা পেতে পারত পরাগরেণু বা মধু । কিন্তু তারা তা করল না, বরং কাছাকাছি বাড়তে থাকা পছন্দের গাছগুলোর পাতায় দংশনের কাজ শুরু করে দিল মহা উৎসাহে। জুরিখের বসন্তের শেষে এই পরীক্ষা আর এপ্রিলমাসে গ্রীষ্মের শুরু হতে না হতেই এই সব দংশিত গাছে ফুল এসে গেল। মৌমাছিদেরও এই স্বভাব আর চোখে পড়ল না, পরাগরেণুর জোগান পেয়ে তারা তখন বেজায় খুশি। 

আরও পড়ুন : টাইকো, কেপলার আর হ্যামলেটের ‘অনুপ্রেরণা’ / অর্পণ পাল

ব্যবহারিক জীববিজ্ঞানের দিক থেকে এই পর্যবেক্ষণ নতুন এক দিকনির্দেশ। পরাগরেণু সংগ্রহের জন্য এটি একরকম অভিযোজন কিনা তা বলার আগে আর কিছু পরীক্ষা বাকি। এই সংকেত অনুসরণ করে উদ্ভিদের ফুল ফোটানোর ক্যালেন্ডারই বদলে দেওয়া যাবে কিনা তা বলার সময়ও এখনও আসেনি, কিন্তু অলির দংশনে বকুলের হাসি যে কেবল রূপকার্থে বলা নয়, তা ইতিমধ্যেই ফোতেইনিদের সৌজন্যে প্রমাণিত।


তথ্যসূত্র: 

Foteini G. Pashalidou et al (2020), Science, 22 May 2020: Vol. 368, Issue 6493, pp. 881-884 DOI:10.1126/science.aay0496


#বাংলা #নিবন্ধ #মৌমাছি #Photoperiod #Bumble bee #Bee dance #Science

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

219135