বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মুখ ও মুখোশ

স্বপন ভট্টাচার্য July 19, 2020 at 7:37 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মাস্ক। এ বস্তু যেভাবে আমাদের জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে বসেছে এই অতিমারিকালে, তাতে বিশ্বাস করার কারণ থাকে এই যে পরিপূর্ণ বদনখানি বহির্জগতে বহুলাংশে ডিসপোজেবল। কেবল চোখে, চুলে, কপালে আমি ইমেজায়িত, বাকি অংশ রকমারি আবরণে আবৃত - মাস্কড। মুখোশধারী না হলে ভূলোক, দ্যুলোক মায় ডেথবেডেও আপনি ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’। সুতরাং মুখোশে থাকুন। মুখোশে আমরা কোনোদিন খুব অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি, এ আমাদের অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না। যদিও, আমাদের ভাষায় ও কাব্যে, গদ্যে ও ইতিহাসে, লৌকিকে ও দর্শনে, মাস্ক বা মুখোশ কোনদিনই খুব সম্ভ্রমের জায়গা অর্জন করতে পারে নি। মুখোশের আড়ালে থাকা মুখ প্রায়ই হন্তারকের, শঠের, প্রবঞ্চকের বলেই ভেবে এসেছি বরাবর। বস্তুত, যে সমস্ত মুখ আমরা আমাদের রোজকার চেনা পরিসরে, হাটে বা বাজারে, ছাপায় বা ছবিতে রোজ দেখতে পাই - দেখতে দেখতে ভরসা পাই, লজ্জা পাই, ভয় পাই, সেগুলি মুখ না মুখোশ কে বলতে পারে হলফ করে? সুতরাং, মুখোশ নিয়ে বসবাস আমাদের কাছে ‘নভেল’ নয় কোনোমতেই।

মাস্ক জিনিসটা সম্ভবত মানুষের লিখিত ইতিহাসের থেকেও পুরোনো। বোধহয় হোমিনিডরা হাতের ব্যবহার ভালো করে শিখে উঠবার আগেই নিজেকে সবলতর শত্রুর থেকে অথবা শিকারের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে মাস্কের ব্যবহার শিখে গিয়েছিল। দশহাজার বছর আগেকার গুহাচিত্রে, ফারাওদের ইজিপ্টে মৃতের মুখের আদলে, ইউরিপিডিসের গ্রীসে নাটকের ডাইনি বা শয়তানের ছদ্মরূপ হিসাবে, জাপানী ‘নো’ নাচে, আফ্রিকায় ফসল তোলা ও ডাকিনীবিদ্যায়, পেরুতে ইনকাদের ডেথ মাস্ক - কত বলব? এরকম সমস্ত ক্ষেত্রেই মাস্ক অবশ্য পরিপূর্ণ মুখাবরণ। তার উদ্দেশ্য একটাই- অন্তরাল। মৃতের বা দন্ডিতের মুখ থেকে যন্ত্রণার ছাপ মুছে ফেলা বা চেনামুখকে অচেনা চরিত্র দেওয়ার জন্যই মাস্কের ব্যবহার হয়ে এসেছে বরাবর। বলার কথা এই যে, চিকিৎসাশাস্ত্রসম্মত মাস্কের ব্যবহারের ইতিহাসও বেশ পুরোনো। চিত্রকলায় মাস্ককে বলা হয় – a membrane between the person and the world. কথাটি কাব্যিক, কিন্তু আর্টের পরিসর থেকে রোগজীবাণুর পরিসরে এলে একেবারে আক্ষরিক দ্যোতনার বিষয়। বস্তুত মেডিক্যাল মাস্ককে এক কথায় বোঝাতে গেলে এর চেয়ে ভালো সংজ্ঞা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আইসেনহাইম অল্টার-পিস “Temptation of St. Anthony”, যা ম্যাথিয়াস গ্রুনেওয়াল্ড (Isenheim Altarpiece, Matthias Grünewald) এঁকেছিলেন ১৫১২ থেকে ১৫১৬-র মধ্যে (ফ্রান্সের Museum Unterlinden-এ সংরক্ষিত), সেই ছবিতে শয়তানের মুখে দেখা যাচ্ছে লম্বা একখানা পাখির চঞ্চুর মত মাস্ক। মধ্যযুগের ইউরোপে এপিডেমিকের অভাব ছিল না। প্লেগ তো ছিলোই, তা ছাড়াও ছিলো স্মল পক্স, হাম, এবং উপর্য্যুপরি ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ। তখন পাতালের প্রতীক এই পাখির ঠোঁটের মত মাস্ক পরবার চল ছিল সেখানে। এই লম্বা ঠোঁটের কিছুটা কাজ ছিল তো বটেই। এই ঠোঁটের মধ্যে রাখা থাকতো নানা রকম সুগন্ধিমাখানো তুলো বা লিনেন, যার মধ্য দিয়ে বাতাস কিছুটা পরিস্রুত হয়ে ঢুকতো যিনি সেটি পরেছেন তার নাকে। Evil odour বা বাজে বাতাস যে রোগের উৎস, সেটা তখনই ধারণায় ছিল এবং একটি মুখাবরণী যে রোগকে কিছুটা দূরে রাখতে পারে তা তখন থেকেই অনুভূত হচ্ছিল। ভাইরাস কথাটার মানেই, এহ বাহ্য, ব্যাড এয়ার অর্থাৎ কুবাতাস। বার্লিনের হিস্ট্রি মিউজিয়ামে প্লেগ ডাক্তারের শির-আচ্ছাদনী বা headgear প্রদর্শিত আছে। সেটা পুরোদুস্তুর এখনকার পিপিই কিটের হেডপিসের মত একটা বস্তু যা আলগা পরে নেওয়া যায় মাথার উপর। এটির সঙ্গেও বাজপাখির ঠোঁটের মত একটা প্রলম্বিত নাসিকা জুড়ে দেওয়া আছে যার মধ্য দিয়ে বাতাস ফিল্টার করার টেকনিক আয়ত্ত করেছিলেন তখনকার ডাক্তারেরা।


উনবিংশ শতাব্দীর প্যারিসে উঁচুঘরের মহিলাদের মধ্যে মুখাবরণী বা veil পরার চল হল খুব। ততদিনে লুই পাস্তুর আর রবার্ট কখের কাজের সুবাদে জার্ম থিয়োরি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সখের বিজ্ঞানীরা মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে দেখলেন ওড়নার নেটে আটকে গেছে অজস্র ব্যাকটেরিয়া। ১৮৭৮ সালে Scientific American পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে A. J. Jessup এবং A. Westtown লেখেন যে মুখের সামনে তুলোর আস্তরণ মহামারির সময় সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এবং এঁরা কেবল ডাক্তার বদ্যি নয়, জনসাধারণকেও মাস্ক পরার উপদেশ দিচ্ছেন এই বলে যে, কোয়ারান্টাইন এবং জীবাণুমুক্তির সাথে সাথে মাস্কের ব্যবহার এপিডেমিকের সময়ে প্রধান প্রতিপালনীয় ব্যাপারগুলোর মধ্যেই পড়া উচিত। এমনকি টেস্ট টিউবের মুখে তুলোর প্লাগ লাগিয়ে তাঁরা দেখিয়েছিলেন যে বায়ুবাহিত জীবাণু আটকানোর সেটা একটা মোক্ষম উপায়। তবে, বলাই বাহুল্য, তখন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ডাক্তার পরে পরুক, জনতা কেন পরবে - ভাবখানা এরকম! সার্জিক্যাল মাস্কের প্রথম ব্যবহারের রেকর্ড, ১৮৯৭ সালে যোহান রেডিকি (Johannes von Mikulicz-Radecki)। তিনি অপারেশনের সময় মুখে গজকাপড়ের আস্তরণ রাখার কথা বলেছিলেন এই কারণে যে, তাঁর অনুমান ছিল (এবং সঠিক অনুমান ছিল), শল্যচিকিৎসকের নিঃশ্বাসই হল বহু রোগীর পোস্ট-অপারেটিভ সেপসিসের কারণ। ১৮৯৮-তে জার্মান চিকিৎসক হেবনার প্রস্তাব আনলেন সার্জিক্যাল মাস্ক হোক দ্বিস্তরীয়। দু’খানা গজের টুকরো দিয়ে নাক ও মুখ ঢেকে অপারেশনে যাওয়া উচিত - পরামর্শ দিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে শ্রীমতী অ্যালিস হ্যামিলটন দেখালেন স্ট্রেপ্টোকক্কাস ঘটিত স্কারলেট ফিভার হাসপাতালে থাকা রোগীদের মধ্যে ছড়ানোর প্রধান কারণ, হাঁচি-কাশির ড্রপলেট বাতাসে বহুক্ষণ ভাসমান থাকে। ফলে শুধু ডাক্তার নয়, সেবিকাদেরও ওয়ার্ডে মাস্ক পরে থাকার চল হল। সংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য ডাক্তারবদ্যি ছাড়াও অন্য সবাই, যারা কোন না কোন ভাবে রোগীর সংস্পর্শে আসে, তাদেরও যে মাস্ক পরা বাঞ্ছনীয়, এটা প্রমাণ করার জন্য ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত সময়কালের ডিপথেরিয়া রোগে ভোগা বাচ্চাদের বাপ-মা-সেবক- সেবিকাদের একটা ডেটা দিলেন জর্জ উইভার এবং দেখালেন যে বাচ্চার থেকে বড়দের সংক্রমণ হার একেবারে শূন্যে নেমে এসেছে। তিনি এও বলেছিলেন যে মাস্ক দ্বিতীয়বার ব্যবহারের আগে জীবাণুমুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে এবং নাকে আর মুখে কোন কারণেই হাত দেওয়া চলবে না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এসব প্রস্তাবনা, যদি ভাবি, কী আর এমন তাহলে পাঠক, মনে করিয়ে দিই, এ হল সেই যুগ যখন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলে সেমেলউইজ (Ignaz Semmelweis) খুন হয়ে গিয়েছিলেন। উপরন্তু, সে যুগে ভাইরাস প্রতিরোধী N95 মাস্ক তো স্বপ্নেও ছিল না কারো। তাই ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু কান্ডে গজের তৈরি মাস্ক তেমন কাজে আসছিল না। তবু আমেরিকায় কোন কোন রাজ্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করায় খবরের কাগজে হেডলাইন হল- ‘Influenza Veils Set New Fashion’। কেউ কেউ আবার নিয়মরক্ষায় মাস্ক পরল বটে, তবে মুখে একখানা ছিদ্র রেখে দিল - স্মোকিং হোল। সেখানে দোকানদারেরা তো মাস্ক বয়কট করতে চাইছিল এই ভেবে যে খদ্দের হবে না। তবুও মাস্ক না পরার জন্য সেই যুগে জেল, জরিমানা এমন কি গুলি করে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল। আজও, এই কোভিডকালে, মাস্ক খুব জনপ্রিয় হয়েছে বলা যায় না। নিয়ম না মানার একটা প্রবণতা আমাদের বরাবরই আছে। কিন্তু মাস্ক যে শুধু নিয়ম নয়, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে একটা অনতিসূক্ষ্ম ব্যবধায়ক, তা বললেও লোকে আর শুনছে কোথায়!



তথ্যঃ
(১) https://www.bloomberg.com/opinion
(২) J L Spooner (1967) History of Surgical Face. AORN Journal p.76-80.

#বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

  • রাম প্রনয় গাঙ্গুলী
    July 22, 2020 at 3:15 am

    ১)মাস্ক ব্যবহারের ইতিহাস ২) সার্জিক্যাল মাস্ক ব‌্যবহারের কারন ৩) সাধারণ হাঁচি-কাশিতে নির্গত ড্রপলেট কতটা সংক্রামক তা তথ্য সহযোগে প্রমানিত হবার ইতিহাস এগুলি সুন্দর ভাবে তুলে ধরায় অভিনন্দন জানাই। কিন্তু প্রশ্নঃ-১)তাহলেতো অনেক আগেই মাস্কের প্রচলন হওয়া উচিত ছিল,কাদের জন্য তা হয়নি ? ২) সরকার কুসংস্কার প্রচার না করে,আঃবিঃবন্দরে খচিপচি(TTT)করে সক্কলকে মাস্ক+সাবান দিলেতো ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের কাঁথায় এভাবে আগুন ধরানো হতো না। এতে যাঁদের স্বার্থপূরন হয়, তাহলে কি বিশ্বব্যাপী সেই শক্তিই মানবতার বিরুদ্ধে সন্মিলিত যুদ্ধে অবতীর্ন ?

  • Subir Majumder
    July 22, 2020 at 2:24 am

    Apurbo akarshanio o tathyavittik lekha, je keo parbe to samriddha habe. Anek dhanyabad o subhechchha lekhakke.

  • লিলি মিত্র
    July 20, 2020 at 3:39 pm

    স্বপনের লেখার style এতই আকর্ষণীয় যে অনেকের মতো আমিও ওর লেখার বেশ ভক্ত হয়ে উঠেছি। লেখার বিষয় যাই হোক না কেন তা এতই সমৃদ্ধ হয় যে পড়তে পড়তে সে বিষয়ে অনেক কিছু জানার জন্য মনটা নেচে ওঠে। তাছাড়া জীববিজ্ঞান, বাংলা ও ইংলিশ ভাষা তে ওর ব্যুৎপত্তি কে নিঃশেষে কাজে লাগিয়ে সহজ ও তাৎপর্যপূর্ণ যে লেখা ও present করেছে তা অতি উত্তম তো বটেই।

  • Surangams Bhattachsrjee
    July 20, 2020 at 5:05 am

    Khub bhalo.tathyo somridhdho lekha

  • Nilachal Chakraborty
    July 20, 2020 at 4:59 am

    Khub sundir lekha. Onek information pelam... Bhalo laglo pore khub e.

  • Bhaskar Chakravorti
    July 20, 2020 at 4:36 am

    Well researched and equally well written paper of contemporary interest.

  • শুভ্র মুখোপাধ্যায়
    July 19, 2020 at 11:02 am

    তথ্যপূর্ণ চমৎকার লেখা।

  • Tapaja mitra
    July 19, 2020 at 10:59 am

    বেশ ভালো

  • DILIP DE SARKER
    July 19, 2020 at 10:44 am

    Very informative and as usual style of presentation is equally good. In this pandemic time most of us would tend to discuss about sergical mask , which the well knowledged author have dealt with. The vast area of social mask and its ramifications in our society is another area, the author has just cited a glimpse of that area. In Italy, in Slovenia , there are festivals of masks and likely many other. It very unfortunate that my work on a documentary on masks is lying to be finished due to some digital editing work. Anyway, thanks to my friend Dr. Bhattacharyya for this beautiful article.

  • Rahul Datta
    July 19, 2020 at 10:08 am

    অসাধারণ! সহজবোধ্য ভাষায় লেখা অত্যন্ত মনোগ্রাহী একটি লেখা। অনেক নতুন তথ্য পেলাম। ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা আপনার জন্য।

  • Souvik Sinha
    July 19, 2020 at 9:52 am

    মাস্ক নিয়ে এমন মাস্-কাটারি লেখার জন্য কুর্নিশ।

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

45

Unique Visitors

225541