বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (চতুর্থ পর্ব)

অর্পণ পাল Dec 22, 2023 at 7:35 pm বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পর্ব ৪। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে আরও দু-চার কথা

তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ একেবারেই অদৃশ্য, বাধা না পেলে এর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। আলোর গতির মানও এটাই। বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এটাই দেখিয়েছিলেন যে আলো এক ধরনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। আর সব তরঙ্গের মতোই এই তরঙ্গও প্রতিফলন, প্রতিসরণ, বিক্ষেপণ বা ব্যাতিচারের মতো বেশ কিছু ধর্ম পালন করে। এই সব কথা এক দিনেই জানা গিয়েছিল এমনটা নয় কিন্তু। এই ধর্মগুলো নিয়ে কিছু কথা আমরা পরে একটা পর্বে আলোচনা করব।

এই তরঙ্গ তির্যক; মানে হল এর গতি যেদিকে, সেই দিকের সঙ্গে তড়িৎ ক্ষেত্র আর চৌম্বক ক্ষেত্রের কম্পনের দিক সমকোণে থাকে। মাধ্যম ছাড়াও এই তরঙ্গ এগোতে পারে, এর একটা উদাহরণ, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসে মাঝখানের দীর্ঘ শূন্যস্থান পেরিয়েই।

শব্দ (sound) যেমন এক রকমের তরঙ্গ, সেরকম আলোও। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে একটা প্রধান তফাৎ হচ্ছে শব্দ এক ধরনের অণুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ, আর আলো হচ্ছে তির্যক তরঙ্গ। যে তরঙ্গের ক্ষেত্রে তরঙ্গ যেদিকে এগোচ্ছে তার সঙ্গে সমকোণে মাধ্যমের কণাগুলো কম্পিত হয়, সেই তরঙ্গ তির্যক (Transverse Wave)। আর যে তরঙ্গের বেলা তরঙ্গের অগ্রসর হওয়ার দিকের সঙ্গে মাধ্যমের কণাগুলোর কম্পন সমান্তরালভাবে হয়, সেটা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal Wave)।

শব্দের বেলা এই কম্পাঙ্কের ওপরেই নির্ভর করে আমাদের শুনতে পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারটা। আমরা যে শব্দ শুনি, সেটার বাইরেও আরও অনেক ধরনের শব্দের অস্তিত্ব আছে, যেগুলো আমাদের কানে ধরা পড়ে না। শুনতে পাওয়া না পাওয়ার ওপরে ভিত্তি করে শব্দকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়— শ্রুতিগোচর শব্দ (Audible sound), শব্দেতর তরঙ্গ (Subsonic or infrasonic sound), আর শব্দোত্তর তরঙ্গ (Ultrasonic sound)।

যে সব শব্দের কম্পাঙ্ক কুড়ি হাৎর্জের কম সেগুলো শব্দেতর (subsonic বা ultrasonic) তরঙ্গ, কম্পাঙ্ক কুড়ি হাৎর্জ থেকে কুড়ি হাজার হাৎর্জ সীমানার মধ্যে থাকলে সেটা শ্রুতিগোচর শব্দ (audible sound), আর কুড়ি হাজার হাৎর্জের বেশি হলে সেটা শব্দোত্তর তরঙ্গ (supersonic)। আমাদের কানে এই কুড়ি থেকে কুড়ি হাজার হাৎর্জের মধ্যে থাকা শব্দই আসতে পারে, এর কম বা বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ আমরা শুনতে পাই না। বাদুড় আবার শব্দোত্তর তরঙ্গ শুনতে পায়। ওদের কান ওইভাবেই তৈরি।

একইভাবে আলোর বেলাতেও আমাদের দেখতে পাওয়ার একটা সীমানা আছে। কম্পাঙ্কের স্কেলে (বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যেরও) একটা নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থাকা আলোকে (যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মোটামুটি চারশো থেকে সাতশো ন্যানোমিটারের মধ্যে হয়) আমরা দেখতে পাই, এর কম বা বেশি হলে পাই না। কম্পাঙ্ক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পাল্লার কম-বেশি অনুযায়ী তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সীমানাকে মোটামুটি সাতটা ভাগে ভেঙে দেখানো হয়, প্রত্যেকটা ভাগের আলাদা নাম দেওয়া আছে। এই ভাগগুলো, এবং প্রত্যেকটা ভাগের কম্পাঙ্ক আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কী ধরনের হতে পারে তা এখানে দেখানো হচ্ছে :


ওপরের টেবিল থেকে বোঝাই যাচ্ছে, সমস্ত বিকিরণের পাল্লার মধ্যে দৃশ্যমান আলো কত সামান্য একটু মাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই তালিকায় থাকা বিকিরণগুলির মধ্যে গামা রশ্মির কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এর শক্তিও বেশি, অন্যদিকে রেডিও তরঙ্গের শক্তি সবচেয়ে কম। এইবার আমরা আসি আসল প্রশ্নে— এই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের ধারণাটা প্রথম দিয়েছিলেন কে? কোন গবেষকদের পথ অনুসরণ করে রেডিও তরঙ্গের স্থানান্তরণ নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের জগদীশচন্দ্রের মতো বিভিন্ন দেশের একাধিক বিজ্ঞানী? তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের ধারণার সূত্রপাত যাঁর হাতে, সেই জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের কথা তো বলব বটেই, তবে তার আগে এই আলোচনা শুরু করা যাক তড়িৎবিদ্যার প্রাথমিক কিছু ধারণা দিয়ে।

তড়িৎ ও চুম্বকের মেলবন্ধন: গোড়ার কথা
তড়িতের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ইলেক্ট্রিসিটি’ এসেছে গ্রিক ‘elektron’ থেকে। অ্যাম্বার (amber) নামে এক বিশেষ ধরনের গাছের আঠা থেকে উৎপন্ন বৈদ্যুতিক চার্জকে বোঝাতে এই শব্দেরই ল্যাটিন প্রতিশব্দ ‘Electricus’ প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সতেরো শতকের ব্রিটিশ প্রকৃতি-দার্শনিক উইলিয়াম গিলবার্ট, সেটা ১৬০০ সালে তাঁর লেখা ‘ডি ম্যাগনেটে’ নামের বইয়ে। আবার ‘Electric’ কথাটা প্রথম দেখা যায় ফ্রান্সিস বেকন-এর লেখায়, সেখানেও প্রসঙ্গ ছিল ওই অ্যাম্বারের আকর্ষণের ব্যাপারটা। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাপারটা অনেক কাল আগে থেকেই মানুষের জানা ছিল। তবে ইলেকট্রিক কথাটা এখন যে অর্থে প্রযুক্ত হয়, সেটা এসেছে অনেক পরে।

আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তড়িৎ-আধান বা ইলেকট্রিক চার্জ নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত কাজটি করলেন ফরাসি বিজ্ঞানী চার্লস অগাস্টিন দ্য কুলম্ব (১৭৩৬-১৮০৬ খ্রি), তাঁর বিপরীত বর্গের সূত্র আবিষ্কার করে। দুটো বিচ্ছিন্ন চার্জকে কিছু দূরে রাখলে সে দুটো নিজেদের মধ্যে কী পরিমাণ বল প্রয়োগ করবে, এই সূত্রে জানানো হল তা। যদি চার্জদুটো একই চিহ্নবিশিষ্ট হয়, তবে তাদের মধ্যে কাজ করবে বিকর্ষণ বল, আর বিপরীত ধরনের হয়, তবে আকর্ষণ। এই আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল চার্জদুটোর পরিমাণের গুণফলের ওপর যেমন সমানুপাতিক হবে, তেমনই তাদের মধ্যেকার দুরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে বদলাবে।

তখনও পর্যন্ত এই চার্জ নিয়ে কী করা হবে, তার স্পষ্ট দিশা ছিল না। প্রবাহিত হয় এমন তড়িৎশক্তি (যাকে ইংরেজিতে বলে Dynamic electricity), যা আমাদের বাড়ির আলো-পাখা-টিভি চলার মূল চালিকাশক্তি, তা তখনও বেশ দূরে। ১৭৯১ সালে এক ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি (১৭৩৭-১৭৯৮ খ্রি) দেখালেন তড়িতের প্রভাবে মরা ব্যাঙেরও পা নেচে ওঠে। এর থেকেই পরে জন্ম নেয় প্রাণী-তড়িৎ বিদ্যা বা ‘অ্যানিম্যাল ইলেক্ট্রিসিটি’র ধারণা।


তড়িৎ নিয়ে আরও কিছু কাজ করছিলেন ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেক্সান্দ্রো ভোল্টা। উনিশ শতকের একেবারে শুরুর বছরে তিনি একাধিক ধাতুর পাত আর কিছু রাসায়নিক তরল দিয়ে তৈরি করলেন এমন এক জিনিস, যেটাকে আজকের ভাষায় আমরা অনায়াসে ব্যাটারি বলতে পারি। তখন এই জিনিসটার নাম ছিল ‘ভোল্টেইক পাইল’। তিনি পরে এই ব্যাপারটার উন্নতি ঘটালেন আরও, তাঁর এই কাজের সম্মানেই আজকে আমরা তড়িৎ-বিভবের একক হিসেবে ‘ভোল্ট’ কথাটা ব্যবহার করি।


অন্যদিকে চুম্বক নামক বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যযুক্ত পদার্থের ধর্মাবলী নিয়েও মানুষের জ্ঞান ছিল বহুকাল আগে থেকেই। চুম্বক যে মাঝসমুদ্রে নাবিককে দিশা দেখায় বা তার কাছে লোহাকে আনলে সে টেনে নেয় তা, এ সবই জানত মানুষ। কিন্তু এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীত জাতীয় ঘটনা যে একেবারেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, আর তারই সঙ্গে আবার যুক্ত হয়ে আছে আলোর মতো আরও একটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়, এ কি কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা? অন্তত আঠেরো শতক অবধি, বা উনিশ শতকের প্রথম দিকেও?

উনিশ শতকের প্রথম দিকে, ১৮২০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড-ই (১৭৭৭-১৮৫১ খ্রি) প্রথম দেখালেন যে কোনও তারের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হলে তার প্রভাবে সেটার চারপাশে তৈরি হয় এক চুম্বকীয় ক্ষেত্র। এই ঘটনাটি প্রদর্শনের জন্য তাঁর পরীক্ষাটা এতই সহজ যে কোনও স্কুল-পড়ুয়া ছাত্রই এটা নিজে-নিজে করে দেখতে পারবে। লম্বা একটা অন্তরিত তার নিয়ে যদি সেটার মধ্যে দিয়ে তড়িৎ পাঠানো হয়, তবে ওই তারের কাছাকাছি তারটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে রাখা একটা ছোট দণ্ড চুম্বক (যার দু-মাথা সূচলো। দোকানে কিনতে পাওয়া যায়) সামান্য বেঁকে যায়। তড়িৎপ্রবাহ এখানে প্রভাবিত করছে চুম্বককে, এর অর্থ এই দুটো বিষয়ের মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক আছে। তাঁর পরে আরও বেশ কয়েকজন এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে বলতে হয় আন্দ্রে মারি অ্যাম্পিয়ার, মাইকেল ফ্যারাডে, কার্ল ফ্রেডারিখ গাউস-এর মতো কয়েকজনের নাম। যেমন ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যামপিয়ার দেখালেন যে তড়িৎবাহী তারের প্রভাবে এই যে চুম্বকের মধ্যে গতির সৃষ্টি হওয়া, অর্থাৎ ওর বেঁকে যাওয়া, এটাকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।


তড়িৎ এবং চৌম্বকীয় ঘটনার এই যে মেলবন্ধন, এর থেকেই জন্ম নিল ‘ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম থিওরি’ বা তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্ব। যে ক্ষেত্রটিতে এরপরে অবদান রাখবেন জাঁ ব্যাপ্টিস্ট বায়োট, ফেলিক্স সাভার্ট, আন্দ্রে মারি অ্যামপিয়ার বা জর্জ সিমন ওহম প্রমুখ বিজ্ঞানীরা। তড়িৎ আর চুম্বক সম্বন্ধে বছর কয়েকের মধ্যেই বেশ কিছু নতুন ধারণার জন্ম হল, যদিও এই দুইয়ের মধ্যে যথাযথ সম্পর্ক অনুধাবন করা তখনও বেশ দূরে।

.............................

আগের পর্ব পড়ুন : বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (তৃতীয় পর্ব) 

#Jagadish Chandra Bose #Radio #Radiowave #জগদীশচন্দ্র বসু #অর্পণ পাল #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

31

Unique Visitors

215000