একটি নীল রঙের খাতা আর সত্যজিতের লেখা বড়দের গল্প
...........................
[হিরে মানিক জ্বলে : সপ্তদশ পর্ব]
....................................
সত্যজিৎ রায়ের বড়দের জন্য লেখা গল্প বেশ কমই। ‘ময়ূরকন্ঠী জেলি’, ‘আর্যশেখরের জন্ম ও মৃত্যু’, ‘পিকুর ডায়েরি’ ছাড়া বড়দের জন্য সত্যজিৎ সম্ভবত খুব বেশি কিছু লেখেননি। হ্যাঁ, ‘পুরস্কার’ আর ‘বর্ণান্ধ’কেও হয়ত বড়দের গল্প হিসেবে গ্রেসমার্ক দিয়ে পাস করানো যায়। এভাবেই আরও কিছু গল্প বড়দের কোটায় পড়ে যেতেও পারে। যদিও সাহিত্যের বয়সভিত্তিক বর্গীকরণ কতটা উচিত সে নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। তবে এ কথা অস্বীকারের জায়গা বিশেষ নেই, সাহিত্যিক সত্যজিতের অধিকাংশ গল্পের টার্গেট অডিয়েন্স কিন্তু শিশু-কিশোর।
বড়দের জন্য লেখা কম সংখ্যক গল্পের মধ্যেও একটি গল্পের কথক একজন শিশু। আমরা ‘পিকুর ডায়রি’র কথা বলছি।
পিকুর বয়স ঠিক কত তা গল্পের সূত্রে বোঝা মুশকিল। এইটুকু বলা যায় তার বয়স কোনোভাবেই ছ-সাত বছরের বেশি নয়। ডায়রিতে পিকু লিখছে “দাদা অনেক বড় আমারচে বারো বছর তাই দাদার টিপ। দাদা কলেজে পড়ে আর আমি ইসকুলতো”। কলেজে পাঠরত দাদার চেয়ে বারো বছরের ছোট পিকুর বয়স ছয় সাত হওয়াই স্বাভাবিক। চিত্রনাট্যে পরিষ্কার বলা হয়েছে পিকুর বয়স ছয় বছর। এই গল্পের লেখকের বয়স কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বছর। (‘পিকুর ডায়রি’ প্রথম প্রকাশিত হয় শারদীয় আনন্দবাজার ১৯৭০ এ। তখন সত্যজিতের বয়স ঊনপঞ্চাশ)। সুতরাং কথক ও লেখকের বয়সের ব্যবধান চল্লিশ বছরেরও বেশি। সত্যজিৎ এই ব্যবধানকে পেরিয়ে যেতে চাইলেন। অনুকরণ করতে চাইলেন এক শিশুর বাক্ভঙ্গিমা। এমনকি এক শিশুর ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার। মায় সম্ভাব্য ভুল বানান ও উচ্চারণভিত্তিক বানান লেখার প্রবণতা। ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ সত্যজিৎ লিখেছিলেন, “ছেলেবেলার কোন ঘটনা মনে থাকবে আর কোনটা যে চিরকালের মত মন থেকে মুছে যাবে সেটা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। মনে থাকা আর না থাকা জিনিসটা কোনোরকম নিয়ম মেনে চলে না”। তবে পিকুর ডায়রি কিন্তু স্মরণ নয়। স্মৃতিকথা তো নয়ই। ‘পিকুর ডায়রি’ বস্তুত এক প্রৌঢ়ের শিশু ছদ্মবেশ। এক আশ্চর্য আত্মঅপসারণ। প্রৌঢ়ের জীবনদর্শনকে শিশু-মনস্তত্ত্বের প্রিজমে ফেলা। এবং সেই প্রতিফলিত অভিসারী আলোকগুচ্ছের দ্বারা এক আপাত শিশুজগতের মায়াবিভ্রম নির্মাণ।
এ এক শিশুর দিনলিপি। কিন্তু এ লেখা শিশুদের জন্য নয়। শিশুর ন্যারেশন ধার করে বস্তুত বড়দের ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার নির্মাণ করছেন সত্যজিৎ। Bruce Merry তাঁর “The Literary Diary as a Genre” নিবন্ধে লিখছেন, “…the diary is an intimate journal, a personal dialogue between the writer and his private persona…” এখন প্রশ্ন হল, কোনও ছয় বছরের শিশু কি তার নিভৃত অস্মিতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ দ্বিরালাপে যেতে সক্ষম?
তাত্ত্বিকভাবে দেখলে এই কাল্পনিক আলাপচারিতা খুব অসম্ভবও নয়। জা পিঁয়াজের মতে এই বয়স Pre-Operational Stage। এই স্তরের চারটি বৈশিষ্ট্য। Realism, Animism, Artificiality এবং Transductive Reasoning। প্রায় সাত বছর বয়স থেকেই একজন শিশু বহির্জগত ও অন্তর্জগৎকে আলাদা করতে শেখে। পিকুরও কিন্তু এই বাইরের আর ভেতরের দুনিয়ার জ্ঞান আছে। নিজের চোখে দেখা বাইরের দুনিয়াটার কথাই লেখে পিকু। কিন্তু সে জানে তাকে এই ডায়রি লুকিয়ে রাখতে হবে। সে জানে তার ছদ্মঘুমের সময় মা বাবার ঝগড়ার কথা। কিন্তু এই বাইরের জগৎ কি তাকে আলোড়িত করে? পিকুর শৈশব ‘Disturbed Childhood’। তার বাবা মার ঝগড়ার দৃশ্য তার কলমে বারবার আসে। এমনকি পিকু যাতে সেই ঝগড়ার বিষয় বুঝতে না পারে, তাই ইংরেজিতে ঝগড়া করার ছলটুকুরও উল্লেখ আছে ডায়রিতে। তার দাদার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে বাবা মায়ের সঙ্গে দাদার দ্বন্দ্ব। হিতেশকাকুর সঙ্গে মায়ের অবৈধ সম্পর্ক। একসঙ্গে বাবাকে লুকিয়ে সিনেমা যাওয়া। যেটা নাকি “বড়দের সিনেমা”। সে এও বোঝে বাবা আর মা তাঁদের ছন্নসম্পর্ককে সমাজের থেকে লুকিয়ে রাখে। পার্টিতে প্রদর্শন করে ছদ্ম সুখের বিজ্ঞাপন।
পিকুর পরিবারে দুটি একা মানুষ। একজন করোনারি থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত তার দাদু। যিনি এক সময়ে ডায়রি লিখতেন। আরেকজন পিকু। বড়দের দুনিয়ায় একা হয়ে যাওয়া ছয় বছরের বালক। যে এখন ডায়রি লেখে। সত্যজিৎ রচিত ‘পিকু’ চিত্রনাট্যে পর পর রং নাম্বারে পিকুর ফোন করা কেবল তার শিশুসুলভ কৌতূহল নয়। সেখানে প্রকট হয়ে ওঠে তার একাকিত্ব ও একলা হয়ে যাওয়ার বোধ থেকে উঠে আসা সংযোগের আকাঙ্ক্ষা। ‘রং নাম্বার’ শব্দবন্ধই বুঝিয়ে দেয় পিকুর পরিস্থিতিগত অসহায়তা। সে একের পর এক অপরিচিত জায়গায়, অচেনা মানুষকে ফোন করে চলে। কারণ-- তার সবচেয়ে চেনা, সবথেকে আপন দুজন মানুষের সঙ্গে মানসিক যোগের একান্ত অভাব। অন্যদিকে একইরকম অসহায় পিকুর দাদুও। বৃদ্ধ চলচ্ছক্তিহীন মানুষটি নিজের অনুভব দিয়ে সংসারের ছিঁড়ে যাওয়া গ্রন্থিগুলি একভাবে নিশ্চয়ই বোঝেন কিন্তু কিছুই করতে পারেন না। পিকুও প্রায় সবটাই তার নিজের মত করে বোঝে। অন্তত সংসারের অসংসক্তিটুকু তো বোঝে নিশ্চয়ই।
এই একাকিত্বের সূত্রেই কাছাকাছি এসে যায় পিকু আর তার দাদু। পিকুর দেখা স্বপ্নে ঘোড়সওয়াররূপী পিকুকে কাউবয়বেশী দাদু ‘চল যাই’ বলে ডাক দেন। এ কি আসলে স্নেহহীন সংসক্তিহীন সংসার থেকে পালানোর বার্তা নয়?
পিকুর দাদু আর ডায়রি লেখেন না। পিকু লেখে। ডায়রি এক এমন সুতো যা দুজন দ্রষ্টাকে এক করেছে। তবে সেও এক দ্রষ্টা মাত্র। ডায়রি বস্তুত এক অসংসক্তির আখ্যান।
লক্ষণীয়, পিকু যে খাতায় ডায়রি লেখে তার রং নীল। নীল রং ভরতের নাট্যশাস্ত্র অনুযায়ী বীভৎস রসের দ্যোতক। জুগুপ্সা নামক স্থায়িভাব থেকে জন্ম নেয় বীভৎস রস। অপ্রিয়, অপবিত্র, অনিষ্টকর প্রভৃতি বিষয় শ্রবণ দর্শনাদি বিভাবের দ্বারা এর উৎপত্তি। পরকীয়া অপবিত্র কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন চলবে। তবে তা সামাজিকভাবে যে অপ্রিয় তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আর একজন শিশুর কাছে তার বাবা মার অসুখী দাম্পত্যের চেয়ে অনিষ্টকর আর কীই বা হতে পারে? তা তাকে ক্রমশ একা করে। যদিও, “আজকাল মা খুব জিনিস দেয়।” কিন্তু প্রাণহীন সেইসমস্ত উপহার একপ্রকার উৎকোচ ছাড়া আর কিছুই নয়। হয়তো কিছুটা অপরাধবোধের থেকে মুক্তির চেষ্টা। লক্ষণীয় ‘আজকাল’ শব্দটি। সম্ভবত হিতেশের সঙ্গে সম্পর্কের পরবর্তীকালে ছেলেকে সময় না দিতে পারার ক্ষতিপূরণ মা করতে চান উপহার দিয়ে। কিন্তু এর ফলে মাতৃসান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ছয় বছরের ছেলেটির কি সত্যিই কোনও ক্ষতিপূরণ সম্ভব? হিতেশের দেওয়া এয়ারগান উপহারটিও শেষ পর্যন্ত হিতকর নয়। একজন ছয় বছরের শিশু সেই এয়ারগান পেয়ে ভাবছে, “আমিও একটা চড়াই রোজ বসে রেলিংয়ে সেটাকে মারবো টিপ করে দম করে মরেই যাবে”। সে আরও ভাবছে, “চড়াইটা আজ আসেনি বদমাইস আছে কাল আসবেই আসবে আর আমিতো রেডি হয়ে থাকবো।” এই জিঘাংসা কিন্তু এক ছয় বছরের বাচ্চার পক্ষে মারাত্মক। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই জিঘাংসার উৎপত্তি কোথায়?
ফ্রয়েড শিশুর বিকাশকে পাঁচটি Psychosexual Stages দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেই অনুসারে ছয় বছর বস্তুত Phallic stage এর শেষ পর্যায়। এই স্তরে Superego তৈরি হয়ে যায়, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে, ফ্রয়েডের মতে এই স্তরে Oedipus Complex বিকাশলাভ করে। লিবিডো শব্দটিকে যদি আমরা বাদও দিই, তবুও, মায়ের প্রতি ছয় বছরের শিশুর অধিকারবোধ থাকাই স্বাভাবিক। এবং তা তার মানসিক চাহিদাও বটে। কিন্তু পিকু তো পায় না তার মাকে। সে জানে হিতেশকাকুর গাড়ির হর্ন তার এবং মায়ের বিচ্ছিন্নতার সংকেত। হিতেশ এলেই মা হয় তাকে তার বন্ধু ধিংড়ার বাড়ি যেতে বলে, না হয় এয়ারগান নিয়ে ছাদে খেলতে পাঠায়, অথবা চাকর অনুকূলের কাছে পাঠাতে চায়। সে রাজি না হলে মা তাকে থাপ্পড় পর্যন্ত মারে। এবং ঐ ছয় বছরের ছেলেটি জানে তার কান্নার কোনো মূল্য নেই বড়দের কাছে। এমনকি তার মায়ের কাছেও। তাই সে বারবার লেখে, “আমি একটু কানলাম বেশি কিন্তু না”। এমনকি খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে কেটে গেলে সে নিজেই ডেটল লাগিয়ে নেয়। মাকে আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলতে থাকা, এবং ক্রমাগত একাকিত্ববোধের জন্যই কি এই ছয় বছরের মনে এত জিঘাংসা? সে তার রোজ দেখা চড়াইটিকে মারতে চায়। পায়রাও মারতে চায়। হয়তো সে তার জিঘাংসাকে অবচতনেই প্রতিস্থাপিত করে দেয় চড়াই বা পায়রার দিকে।
আরও পড়ুন : কিশোর ক্লাসিকসের অনুবাদে সত্যজিৎ / সায়নদীপ গুপ্ত
এভাবেই পিকুর নীল রঙের খাতায় আপাত শান্ত পৃথিবীর এক বীভৎস রূপ ফুটে ওঠে। যার চরম পরিণতি পিকুর দাদুর মৃত্যুদৃশ্যে। ফাঁকা বাড়িতে দাদু আর পিকু। চলচ্ছক্তিহীন মানুষটির অন্তিম ইলেকট্রিক বেলের ডাক যখন এসে পৌঁছয় পিকুর কাছে তখন সে জানলা দিয়ে থুতু ফেলছে। দাদুর কাছে পৌঁছে পিকু দেখে, “চুপচাপ দাদু শুয়ে আছে আর কিন্তু ঘুমোচ্ছে না”। মৃতের নিথর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে পুরোনো ঊষা ফ্যানটার দিকে। এই মৃত্যু কি বুঝতে পারে পিকু? হয়ত পারে। হয়তো পারে না। শুধু সে এইটুকু লেখে, না ঘুমোনো সত্ত্বেও দাদু তার ডাকে সাড়া দিল না। ঠিক যেভাবে এক আপাত ঔদাসীন্যে পিকু বিবৃতি দেয় নিজের মায়ের পরকীয়ার, মা বাবার অসুখী দাম্পত্যের। ঠিক সেভাবেই এক বীভৎস হৃদয়হীন মৃত্যুদৃশ্যের সামনেও সে উদাসীন। সে ফিরে যায় তার অভ্যস্ত একাকিত্বে। “আর আবার আমার বিছানাতেই লিখছি ডাইরি আর পাতাই কিন্তু নেই এখন আর কেউ নেই খালি আমি আর দাদু আর একটা খালি মাছি আছে খালি খালি আসছে জালাতোন ভারী বদমাইস মাছিটা আর বাস এইবার পাতা শেস, খাতা শেস, বাস শেস।” আমরা বুঝতে পারি এ কেবল দাদুর মৃত্যুদৃশ্য নয়। এ এক শৈশবের মৃত্যুদৃশ্যও বটে। যা লেখা হচ্ছে শিশুর বয়ানে। অসংগতিতে ভরা জগৎটাই যার কাছে স্বাভাবিক।
এক আপাত উদাসীন শিশুর বয়ানে এই বীভৎস জগৎটি বর্ণিত হয় বলেই এর বীভৎসতা আরও তীব্র আরও অনুপুঙ্খ হয়ে ওঠে। লক্ষণীয় সত্যজিতের আর যে দুটি তথাকথিত বড়োদের গল্প চয়িত হয়েছে ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য গল্পগ্রন্থ’-এ সেই দুটিতেই রয়েছে “Adultery”। ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’তে প্রদোষের স্ত্রী নিভার প্রতি আসক্ত তারই বন্ধু শশাঙ্ক। ‘আর্যশেখরের জন্ম ও মৃত্যু’তে আর্যশেখর নিজের মেধার উৎস খুঁজতে খুঁজতে এক সময় সন্দেহ করে সে জারজ সন্তান। ‘সবুজ মানুষ’ একটু অন্যরকম। সেখানে এমন এক মানুষের কথা রয়েছে সেখানে যে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যে আর বিশ্বাস করে না। আসলে এক সুতীব্র বিচ্ছিন্নতার বোধই ‘পিকুর ডায়রি ও অন্যান্য’ বইয়ের গল্পগুলিকে সত্যজিতের অন্য গল্পদের থেকে আলাদা করে। সেই বিচ্ছিন্নতার সব থেকে গাঢ় আর বেদনাদায়ক আখ্যান রচিত হয়েছে পিকুর নীল খাতায়। কেবল শিশুর ছদ্ম জবানিতে লেখা বলেই নয়, এই কারণেও পিকুর ডায়রি সত্যজিতের সাহিত্য জগতে অনন্য। সম্ভবত একক।
ঋণ: Bruce. “The Literary Diary as a Genre.” The Maynooth Review / Revieú Mhá Nuad 5, no. 1 (1979): 3-19. Accessed November 25, 2020. http://www.jstor.org/stable/20556925.